Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

যুগসন্ধির কবি হিসেবে ঈশ্বর গুপ্তের অবদান

যুগসন্ধির কবি হিসেবে ঈশ্বর গুপ্তের অবদান:

প্রাচীন বাংলা কাব্যের প্রাণশক্তি ভারতচন্দ্রেই নিঃশেষিত হয়েছিল। ভারতচন্দ্রের পরবর্তীকাল থেকে ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাব কাল পর্যন্ত পদ্যাকারে যা কিছু রচিত হয়েছে, সেই কবিগানে বা‌ জনরঞ্জনী অন্যান্য গীতিকবিতায় প্রাচীন ধারারই জের টানা হয়েছে। এইসব রচনায় যেটুকু অভিনবত্ব চোখে পড়ে তা নিতান্তই চটুল ভঙ্গিসরবস্ব, প্রাণশক্তির দৈন্য তার মধ্যে প্রকট। ইতিমধ্যে বাংলার নতুন সংস্কৃতিকেন্দ্ররূপে কলকাতা নগরী সর্বময় প্রাধান্য অর্জন করেছে। দীর্ঘদিনের ইংরেজ-শাসনজনিত একটা স্পষ্ট পরিবর্তন সমাজের সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষে নতুন ও পুরনাে ভাবধারার সংঘাত ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠেছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে এক বাস্তব জীবনাগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। এই আগ্রহটা সম্পূর্ণ নতুন এবং এটা আধুনিক মানসিকতার প্রধান লক্ষণ। ঈশ্বর গুপ্তের জন্ম ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে। জন্মস্থান কলকাতার অদূরবর্তী কাঁচরাপাড়ায়। গ্রামেই তিনি মানুষ হয়েছেন। তখন গ্রাম-জীবনে প্রাচীন সাংস্কৃতিক আবহাওয়া কিছু পরিমাণে জীবন্ত ছিল। সেই পরিবেশের প্রভাবেই ঈশ্বর গুপ্ত লালিত হয়েছেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি কবির দলের জন্য গান রচনা করতেন। এইভাবেই তার কবিত্বশক্তির উন্মেষ হয় বলা বাহুল্য তার ব্যক্তিত্বের ওপরে পাশ্চাত্ত্য প্রভাব পড়েনি। দেশের সংস্কৃতির মৃত্তিকাই তার প্রধান আশ্রয় ছিল।

ঈশ্বর গুপ্তের সাহিত্যকীর্তির মধ্যে স্বরচিত কাব্য ছাড়াও রয়েছে সাময়িকপত্র সম্পাদনা ও নব্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দান এবং পূর্ববর্তী সাহিত্যিক জীবনী বা রচনার উদ্ধার সাধন। তিনি ১৮৩১ স্ত্রীঃ সাপ্তাহিক পত্ররূপে যে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনা আরম্ভ করেন, ১৮৩৯ খ্রীস্টাব্দে এটিই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম দৈনিক পত্রের মর্যাদালাভ করে। ঈশ্বরচন্দ্রের জীবৎকালে প্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে- (১) কবিবর রামপ্রসাদ সেনের ‘কালীকীর্তন’ (১৮৩৩ খ্রীঃ), (২) ‘কবিবর ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত’ (১৮৫৫ খ্রীঃ) ও (৩) ‘প্রবােধ প্রভাকর’ (১৮৫৮ খ্রীঃ)। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘হিতপ্রভাকর’ (১৮৬১), ‘বােধেন্দুবিকাশ’ নাটক (১৮৬৩), এবং ‘সত্যনারায়ণ পাঁচালী’ (১৮১৩)। তিনি ‘কলি নাটক’ নামে একখানা নাটকও রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

এই গ্রামের মানুষ ঈশ্বর গুপ্ত কলকাতার উত্তরঙ্গ এবং বিচিত্র পথে ধাবিত জীবনের মুখরতার মধ্যে যখন এসে দাঁড়ালেন তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবেই মিলিয়ে নিতে পারেন নি। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবনের বেদনা-মিশ্রিত তিক্ত স্মৃতি, তাই আধুনিক জীবনের প্রতি সন্দেহ ও সংশয় এরূপ মানুষের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কোনদিনই ঈশ্বর গুপ্ত সে সংশয় থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। ঈশ্বর গুপ্তের বিদ্রুপপরায়ণতার মূল নিহিত আছে এই সংশয়বােধে। তিনি সতর্ক সমালােচকের দৃষ্টিতেই সমসাময়িক জীবনকে দেখেছেন। অথচ এই ঈশ্বর গুপ্তই ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদকরূপে দ্রুত রূপান্তরশীল আধুনিক জীবনের নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছেন। এই সং প্রভাকরেই বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, রঙ্গলাল প্রভৃতি আধুনিক সাহিত্যের ত্রিধারার পতাকাবাহী সাহিত্য-সাধকদের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। কলকাতা সমাজের একজন প্রধান পুরুষরূপে শিক্ষা ও সংস্কারমূলক নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাকে জড়িত হতে হয়েছে। তিনি বুঝেছেন, ভাল-মন্দয় মিশ্রিত এই নতুন যুগ একটা বাস্তব সত্য এবং সত্যকে স্বীকার না করে কোন উপায় নেই।

এইভাবে একই সঙ্গে প্রাচীনের প্রতি মমত্ববােধ ও প্রাচীন জীবনের মূল্যবােধগুলি অবসিত হয়েছে দেখে ঈশ্বর গুপ্তের মনে বেদনা এবং অন্যদিকে কর্মসূত্রে আধুনিক জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে এই জীবনের প্রগতিধারাকে বােঝবার চেষ্টা—এই দুই বিপরীত বৃত্তি একত্রে কাজ করতাে। তিনি যে-সমাজে, যে কালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই পটভূমিতে এই দোটানা একান্তই স্বাভাবিক ছিল।

কবিগান ও হাফ-আখড়াই-এর কবিরা কলকাতার অপরিমার্জিতরুচি শ্রোতাদের তৃপ্তির জন্য যে চটুল, শালীনতাহীন কাব্য রচনা করতেন তার পটভূমিতে দেখলে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় বুদ্ধিদীপ্ত, বস্তুনিষ্ঠ মননভঙ্গি প্রকাশকে অবশ্য নিঃসন্দেহেই নতুন কাব্যরীতির ইঙ্গিতবহ বলে মনে হয়। তিনি খণ্ড খণ্ড গীতিকবিতা রচনা করতেন। এই কবিতা ছিল সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এইসব কবিতায় বিষয় হিসাবে নীতিবাদ, সামাজিক রীতিনীতির সমালােচনা, খাদ্যবস্তুর বর্ণনা এবং সমসাময়িক বহু ঘটনা ব্যবহৃত হয়েছে। বিষয় যাই হােক, সর্বত্র তার বুদ্ধির আলােকে উজ্জ্বল ব্যঙ্গপ্রবণ মনের প্রকাশে কবিতাগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মহারানী ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে রচিত কবিতাটি তার তীক্ষ্মব্যঙ্গের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখযােগ্য।

“প্রাচীন রীতি পরিত্যাগ করে ঈশ্বর গুপ্ত যে খণ্ড কবিতা রচনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, পরবর্তীকালে ঐ রীতিটি অনুসৃত হলেও তিনি যে রঙ্গ ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন, তা কিন্তু কার্যতঃ পরিত্যক্ত হয়েছিল। কাজেই ঈশ্বর গুপ্ত যে নবধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তিনি তার একক শিল্পী।” (সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়’)।

অকৃত্রিম খাঁটি বাঙালা ভাষার ওপরে ঈশ্বর গুপ্তের অপরিসীম অধিকার ছিল। সেই ভাষাকেই তিনি আবশ্যক মতাে পরিমার্জিত করে নিয়েছেন। তাঁর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য বস্তুনিষ্ঠ জীবন পর্যবেক্ষণ, সুস্থ জীবনাগ্রহ এবং বিদ্রুপাত্মক মনােভঙ্গির প্রকাশ। জীবনের প্রতি তিনি কখনও বিমুখ ছিলেন না। জীবনের তুচ্ছ দিকগুলির প্রতিও তাই তার আগ্রহের অন্ত নেই। ‘আনারস’, ‘তপসে মাছ’, ‘পাটা প্রশক্তি’ প্রভৃতি কবিতায় ঈশ্বর গুপ্তের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং তীব্র কৌতুক প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘তপসে মাছ’ ঈশ্বর গুপ্তের বর্ণনায়—

‘কষিতকনক কান্তি, কমনীয় কায়।

গালভরা গোঁফ দাড়ি, তপস্বীর প্রায়।’

‘পাটা-প্রশস্তি’ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন,—

“রসভরা রসময় রসের ছাগল।

তােমার কারণে আমি, হয়েছি পাগল।।

তুমি যার পেটে যাও, সেই পুণ্যবান।

সাধু সাধু সাধু তুমি ছাগীর সন্তান।।

মজাদাতা অজা তােরা কি লিখিব যশ? 

যত চুষি তত খুসি হাড়ে হাড়ে রস।।”

তার গভীর ও বিস্তৃত সমাজ-চেতনা এবং স্বদেশপ্রীতির (দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া প্রভৃতি) পরিচয় পাওয়া যায় নীলকর বা মাতৃভাষা রচিত কবিতাগুলিতে। বাঙালি জীবনের তুচ্ছ ও মহৎ সমস্ত কিছুর প্রতিই তার অকৃত্রিম আকর্ষণ ছিল।

এই বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তব জীবনের প্রতি আগ্রহ, ভাবালুতাবর্জিত বুদ্ধির আলােকে জীবনকে বােঝবার চেষ্টা বাংলা কাব্যে একান্তভাবে নতুন। ঈশ্বর গুপ্তের মানসিকতার এই বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই বাংলা কাব্যে তিনি একটা নতুন স্বাদ আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এইভাবে তার কবিতায় আধুনিকতার লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।

বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সচেতন সাহিত্যিক দায়িত্ববােধসম্পন্ন লেখক। আপন কালের গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করার সচেতন প্রয়াস এবং সাহিত্যিক দায়িত্ববােধে তার ব্যক্তিত্বের আধুনিকতারই লক্ষণ পরিস্ফুট। ঈশ্বর গুপ্ত প্রথাসিদ্ধ খাদ্য বর্ণনাত্মক কবিতা লিখেছেন, কবিওয়ালাদের অনুপ্রাস-যমকে পূর্ণ কাব্যরীতি অনুসরণ করেছেন, ভাবে-ভাষায় তার অধিকাংশ রচনাতেই প্রাক-আধুনিক যুগের সাহিত্যিক মেজাজটা অনুভব করা যায়।

বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তের এই বিশিষ্টতার প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছিলেন, “যে ভাষায় তিনি পদ্য লিখিয়াছেন এমন খাঁটি বাংলায়, এমন বাঙালির প্রাণের ভাষায়, আর কেহ পদ্য কি গদ্য কিছুই লেখেন নাই। তাহাতে সংস্কৃতিজনিত কোন বিকার নাই ইংরেজিনবিশীর বিকার নাই। পাণ্ডিত্যের অভিমান নাই বিশুদ্ধির বড়াই নাই। ভাষা হেলে না, ঢলে না, বাঁকেনা সরল সােজা পথে চলিয়া গিয়া পাঠকের প্রাণের ভিতরে প্রবেশ করে।” বঙ্কিমচন্দ্রের এই বিশ্লেষণ যথার্থ।

কিন্তু তাঁর কবিতাগুলিতে সমাজবাস্তবতার প্রতি, প্রত্যক্ষ জীবনের প্রতি যে আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে তা একান্তভাবেই আধুনিক মানসিকতার লক্ষণ। এজন্য শেষ বিচারে তাকে একান্তভাবে প্রাচীন কাব্যধারার কবি বা একান্তভাবে আধুনিক কালের কবিকোনটিই বলা যায় না। তাঁকে যুগসন্ধিক্ষণের এক ক্রান্তিকালের সংশয়িত জীবনচেতনার ভাষ্যকার বলাই সঙ্গত। আধুনিকতার লক্ষণগুলি তাঁর কাব্য প্রকাশিত হয়েছে বলেই ঈশ্বর গুপ্ত বড় কবি না হয়েও বাংলা কাব্যে নবযুগের প্রবর্তক।

অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “..কতকগুলি বিষয়ে তাঁর মৌলিক স্বীকার করতেই হবে। প্রায় অশিক্ষিত হয়েও আধুনিক জীবনের ভাবাবেগ-সম্বন্ধে সচেতন থাকা কবিতাতে পুরাতন-পদ্থী হায়েও বাস্তব চিত্র অঙ্কন করা, স্বাদেশিক মনােভাব রঙ্গব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতাসৃষ্টি এবং নূতন পুরাতন যুগপৎ প্রভাব স্বীকার করে নেওয়া তার কবি-প্রতিভা ও মানসিক প্রবণতার একটা বড় বৈশিষ্ট্য। তাই একই সঙ্গে তাঁর রচনায় ভাড়ামি ও গম্ভীর ভাব লক্ষ্য করা যাবে। ঈশ্বর গুপ্ত যুগসন্ধিক্ষণের কবি তাই উচ্চশিক্ষিত তরুণের দল তাকে বিশেষ প্রশংসা করতেন।”

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.