Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান

বাংলা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা উপন্যাস সাহিত্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ১৮৭৭ সালে, কিশোর রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ রচনা করেন, যা কাদম্বরী দেবীর প্রেরণায় লেখা। প্রায় এক বছর ধরে এটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তবে লেখক নিজে এই উপন্যাসটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি এবং গ্রন্থভুক্তও করেননি। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উপন্যাসই কেবল গ্রন্থগৌরব অর্জন করেছে, তবে বিষয়বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে তাঁর উপন্যাসগুলি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর উপন্যাসগুলিতে বৈচিত্র্য, গভীরতা, এবং কাব্যিকতা রয়েছে যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিচে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো:

১. কাব্যিক ভাষা ও রূপক

রবীন্দ্রনাথ মূলত একজন কবি ছিলেন, এবং তাঁর উপন্যাসেও সেই কাব্যিক রূপ ফুটে উঠেছে। তাঁর ভাষা সবসময়ই সুন্দরের প্রতি অনুরাগী এবং তা প্রায়শই রূপক, প্রতীক এবং আভাসের মাধ্যমে গভীরতর ভাবনাকে প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে রূপক এবং প্রতীকের ব্যবহারে প্রেম ও জীবনের গভীরতা তুলে ধরা হয়েছে।

২. মানসিক ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রতিফলন

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে বাহ্যিক ঘটনার চেয়ে মানসিক এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলো তাঁদের মনের গভীরে যেসব অনুভূতি ও জটিলতার মুখোমুখি হয়, তা তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। যেমন, ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে কুমুদিনীর মানসিক সংগ্রাম এবং তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

৩. গভীর মানবতাবাদ ও সমাজচেতনা

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলোতে মানবতাবাদ ও সমাজচেতনা প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি সমাজের অসঙ্গতি, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, এবং সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে লিখেছেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে জাতীয়তা, ধর্ম, এবং সমাজের প্রতি মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে গভীর চিন্তাধারা উপস্থাপিত হয়েছে।

৪. নারী চরিত্রের জটিলতা ও শক্তি

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে নারীর জটিলতা এবং তাদের মানসিক শক্তি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তাঁর নারীরা প্রায়শই স্বাধীনচেতা, শক্তিশালী, এবং মানসিকভাবে দৃঢ়। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের বিনোদিনী একটি জটিল এবং গভীর নারী চরিত্র, যার মধ্যে সামাজিক ও মানসিক জটিলতার প্রতিফলন ঘটে।

৫. প্রেমের ধারণা ও রূপায়ণ

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে প্রেম একটি কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে। তবে তাঁর প্রেমের ধারণা সবসময়ই গভীর এবং আধ্যাত্মিক। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে অমিত ও লাবণ্যর প্রেমের সম্পর্ককে শুধু একটি রোমান্টিক সম্পর্কের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটি আধ্যাত্মিক সম্পর্ক হিসেবে রূপায়িত করেছেন।

৬. স্বদেশ চেতনা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ

রবীন্দ্রনাথের অনেক উপন্যাসে স্বদেশ চেতনা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশ ঘটেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে বয়কট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জাতীয়তা, সমাজ ও ব্যক্তির দ্বন্দ্বকে গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

৭. আধ্যাত্মিকতা ও দর্শন

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলোতে আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের গভীর প্রভাব রয়েছে। তাঁর উপন্যাসগুলিতে প্রায়শই জীবন ও জগতের গভীরতর সত্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে জীবন, ধর্ম, প্রেম এবং আধ্যাত্মিকতার জটিলতাকে চারটি চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

৮. সাহিত্যিক শৈলীর বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ভাষাশৈলীতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তন দেখা যায়। প্রথম দিকের উপন্যাসগুলোতে সাধু ভাষার প্রভাব থাকলেও পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে চলিত ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে ভাষার শৈলী পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলির তুলনায় অনেক সহজ এবং সাবলীল।

৯. রোমান্টিকতা ও ভাবপ্রবণতা

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলিতে রোমান্টিকতা এবং ভাবপ্রবণতা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি প্রায়শই চরিত্রগুলির মানসিক ও আবেগপূর্ণ দিকগুলোকে তুলে ধরেছেন, যা তাঁর রচনায় একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে।

১০. চরিত্রের গভীরতা ও বাস্তবতা

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের চরিত্রগুলি সাধারণত অত্যন্ত জটিল এবং বাস্তবসম্মত। তারা শুধুমাত্র গল্পের চরিত্র নয়, বরং মানব মনের বিভিন্ন স্তরের প্রতিফলন। এই চরিত্রগুলি তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং কর্মের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসগুলির এই বৈশিষ্ট্যগুলোই তাঁর রচনাকে বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদে পরিণত করেছে। তাঁর উপন্যাসগুলোতে সমাজ, ধর্ম, জীবন এবং প্রেমের গভীর তত্ত্ব ও দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং পাঠকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস

রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাস ধারার অন্তর্ভুক্ত। এই উপন্যাসগুলো ইতিহাসাশ্রয়ী হলেও, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রেরণা থেকে সৃষ্ট হলেও, তাদের মধ্যে দৃষ্টিকোণে পার্থক্য ছিল ব্যাপক।

‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাজা প্রতাপাদিত্যের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। তবে, উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু প্রতাপের পিতৃব্য বসন্ত রায়, পুত্র উদয়াদিত্য, এবং কন্যা বিভার অনৈতিহাসিক কাহিনি। এখানে প্রতাপের নির্মম আচরণের কারণে অন্তঃপুরের শাস্তি, ছেলে-মেয়ের জীবনে বিপর্যয়, এবং পিতৃব্যের মৃত্যু—এসবই উপন্যাসের করুণ বিষয়বস্তু। তবে, এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের পরিপক্ক প্রতিভার কিছুটা অভাব স্পষ্ট।

অন্যদিকে, ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি অনেক বেশি পরিপক্ক এবং শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। এই উপন্যাসের পটভূমি ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস, এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজা গোবিন্দমাণিক্য। এখানে ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে বলিদান বন্ধ করার কারণে রাজা ও পুরোহিত রঘুপতির মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, যা শেষে জয়সিংহের আত্মদানে নিষ্পত্তি পায়।

রবীন্দ্রনাথের সামাজিক উপন্যাস

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে সামাজিক ও মানসিক জটিলতা বিশেষভাবে উঠে এসেছে। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সমাজ এবং নব্য ধনতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে সংকট ও দ্বন্দ্ব চিত্রিত হয়েছে। নিঃসঙ্গ বিনোদিনীর মানসিক জটিলতা, আশার সীমাবদ্ধতা, মহেন্দ্রের অধিকারবোধ, এবং বিহারীর হৃদয়ের সংযম—এসবই উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটি, যদিও কিছু সমালোচকের মতে রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতম রচনা, তবুও এতে রমেশ, কমলা, এবং হেমনলিনীর মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে, উপন্যাসটির সম্ভাব্য মানসিক দ্বন্দ্বের বিকাশ ঘটেনি বলে অনেকে মনে করেন।

‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে কুমুদিনী বা কুমু নামের একটি চরিত্রের মানসিক সংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। এই উপন্যাসটি কুমুর মানসিক সংগ্রাম এবং দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পটভূমির বিশালতা এবং শিল্পনৈপুণ্যের বিচারে ‘যোগাযোগ’ বাংলা উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনামূলক উপন্যাস

রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে স্বদেশচেতনার প্রকাশ সবচেয়ে প্রকটভাবে দেখা যায়। গোরা প্রথমদিকে একজন গোঁড়া হিন্দু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, তবে পরে জানতে পারে সে আসলে আইরিশ। এই মর্মান্তিক সত্য জানার পর গোরা তার রক্ষণশীল মানসিকতার বন্ধন থেকে মুক্তি পায় এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠে।

‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসগুলোতে জাতীয় উন্মাদনা, সন্ত্রাসবাদ, এবং রাজনীতির ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিমলা ও এলার জীবন বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রমত্ততার ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ, যা পাঠককে আবেগপ্রবণ করে তোলে।

রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক উপন্যাস

রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ উপন্যাসেই রোমান্টিকতা কিছুটা হলেও বিদ্যমান। তবে, ‘চতুরঙ্গ’ এবং ‘শেষের কবিতা’ এ ব্যাপারে অনন্য। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে চারটি চরিত্রের (জ্যাঠামশায়, শচীশ, দামিনী, শ্রীবিলাস) মনোবিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে, যা একটি নতুন আঙ্গিকে জীবন সত্যের অনুসন্ধান করে।

‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়ক অমিত এক উচ্ছল, প্রাণবন্ত এবং বুদ্ধিবাদের উজ্জ্বল প্রতীক। এই উপন্যাসটি তার কাব্যময় ভাষা, প্রেম-সম্পর্কিত ধারণা, এবং নতুন আঙ্গিকের কারণে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যোপম উপন্যাস

‘দুই বোন’ এবং ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসগুলোতে রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক ভাষার ব্যবহার ও প্রেমের গভীরতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই উপন্যাসগুলোতে চরিত্রগুলির মানসিক জটিলতা এবং জীবনসংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে, যা পাঠকের মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ভাষাশৈলী

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ভাষাশৈলী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। প্রথম দিকের ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ এবং ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে সাধু গদ্যের ব্যবহার দেখা যায়, তবে পরে তাঁর গদ্যের শৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন শুরু হয় ‘ঘরে বাইরে’ থেকে, যেখানে দুটি ভাষারীতি এবং ভঙ্গিমার মধ্যে তাঁর রচনাশৈলীর পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা উপন্যাসের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর উপন্যাসগুলিতে সমাজ, ইতিহাস, স্বদেশপ্রেম, এবং মানবিক সম্পর্কের গভীরতা তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর রচনায় কাব্যিক সৌন্দর্য এবং গভীর দার্শনিকতা বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অসামান্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং আজও তা পাঠকদের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.