Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

নিঃসঙ্গতার একশ বছর রিভিউ

নিঃসঙ্গতার একশ বছর রিভিউ: গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” (One Hundred Years of Solitude) লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং বিশ্ব সাহিত্যের এক অনবদ্য অবদান। এই মহাকাব্যিক উপন্যাসটি কেবল একটি পরিবারের ইতিহাস নয়, বরং পুরো একটি সমাজের, একটি সভ্যতার, একটি জাতির প্রতিচ্ছবি। নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা, মৃত্যু, পুনর্জন্ম এবং মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে যে গূঢ় প্রশ্নগুলি চিরকাল জাগরিত, সেগুলোই এই উপন্যাসের কেন্দ্রে বিদ্যমান।

উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ও কাঠামো

“নিঃসঙ্গতার একশ বছর” উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে, এবং প্রকাশের সাথে সাথেই এটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বুয়েন্দিয়া পরিবারকে কেন্দ্র করে, যারা একটি কাল্পনিক শহর মাকোন্দোতে বসবাস করে। মাকোন্দো শহরটি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কল্পনাপ্রসূত হলেও, এটি মূলত কলম্বিয়ার ছোট্ট শহর আরাকাতাকার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই উপন্যাসের কাঠামো অত্যন্ত জটিল, এবং এটি একটি সার্কুলার টাইমলাইন বা বৃত্তাকার সময়ের ধারাবাহিকতায় আবর্তিত হয়েছে, যেখানে সময়ের চক্র মানবজীবনের সাথে একটি অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এই উপন্যাসের মাধ্যমে ম্যাজিক রিয়ালিজম ধারার চর্চা করেছেন, যা বাস্তব এবং অতিবাস্তব ঘটনার মধ্যে সীমানা মুছে দেয়। এটি এমন এক পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি যেখানে দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে বিস্ময়কর, অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে, এবং সেইসব ঘটনা মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

বুয়েন্দিয়া পরিবারের কাহিনী

বুয়েন্দিয়া পরিবারে কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, যিনি মাকোন্দো শহরের প্রতিষ্ঠাতা। তার জীবন এবং তার পরিবারের জীবন গভীরভাবে নিঃসঙ্গতার সাথে সংযুক্ত। পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষরা একে অপরের সাথেও একধরনের বিচ্ছিন্নতায় বাস করে। তাদের মধ্যে যেমন প্রেম, কামনা, লোভ, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান, তেমনই তারা ক্রমাগত নিজেদের ভেতরে এবং বাইরের পৃথিবীর সাথে এক প্রকারের দূরত্ব বজায় রাখে।

প্রতিটি প্রজন্মের বুয়েন্দিয়া একপ্রকার অভিশাপের মধ্যে বাস করে, যা তাদেরকে আবারও নিঃসঙ্গতায় ফেলে দেয়। এই অভিশাপটি পরিবারের সকল সদস্যকে নীরবভাবে তাড়া করে ফেরে এবং শেষ পর্যন্ত তারা সেই অভিশাপের দ্বারা গ্রাসিত হয়। এই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা অভিশাপটি একটি পুনরাবৃত্তির ছায়ার মতো, যেখানে পরিবারটি বারবার একই ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি করে।

মাকোন্দো শহরের প্রতীকী অর্থ

মাকোন্দো শহরটি উপন্যাসের প্রধান অবস্থান, এবং এটি কেবল একটি শহর নয়, বরং এটি মানব সভ্যতার এক প্রতীকী রূপ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এটি এমন এক শহর যেখানে বুয়েন্দিয়া পরিবার এবং অন্যান্য শহরবাসীরা বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়, যেমন—রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মাকোন্দোর গল্পটি মূলত মানুষের সভ্যতার প্রায়শই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এবং পুনর্জন্মের ধারাকে প্রতিফলিত করে।

মাকোন্দো শহর প্রথমে স্বপ্নময়, আদর্শিক, একটি শান্তিপূর্ণ স্থান হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি দুনিয়ার অন্যান্য শহরের মতো দুর্নীতি, হিংসা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়। বুয়েন্দিয়া পরিবারের নিঃসঙ্গতাও মাকোন্দোর এই পরিবর্তনের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। পরিবারের সদস্যরা শহরের ভেতরের এবং বাইরের পরিবর্তনগুলোর মুখোমুখি হলেও, তাদের ভেতরে সেই চিরস্থায়ী নিঃসঙ্গতা এবং ভাঙনের রেশ থেকে যায়।

ম্যাজিক রিয়ালিজমের প্রভাব

“নিঃসঙ্গতার একশ বছর” উপন্যাসটি ম্যাজিক রিয়ালিজম ধারায় রচিত, যা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। ম্যাজিক রিয়ালিজম একটি সাহিত্যিক ধারা যেখানে বাস্তব ঘটনাগুলোর সাথে অলৌকিক, অবাস্তব বা অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোর মিশ্রণ ঘটানো হয়।

এই উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনার মধ্যে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে বাস্তবতার সাথে ম্যাজিকের মিলন ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, রেমেদিওস দ্য বিউটিফুলের আকাশে উড়ে যাওয়া, এবং মেলকিয়াদেসের ভবিষ্যদ্বাণী করা ম্যানুস্ক্রিপ্টের উল্লেখ করা যেতে পারে। এই ধরনের ঘটনা উপন্যাসের পাঠকদেরকে এমন এক দুনিয়ায় নিয়ে যায়, যেখানে কল্পনার সীমানা ধীরে ধীরে মুছে যায় এবং বাস্তবতার মধ্যে মিশে যায়।

মার্কেজের এই ম্যাজিক রিয়ালিজমের ধারা কেবল একটি অলৌকিক ঘটনা সৃষ্টি করার জন্য নয়, বরং এটি মানব অস্তিত্বের গভীরতাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। তার লেখায় প্রতিটি ম্যাজিকাল ঘটনা মানুষের জীবনের সাথে জড়িত গভীর অনুভূতিকে প্রতিফলিত করে।

নিঃসঙ্গতার দর্শন

এই উপন্যাসের মূল থিম নিঃসঙ্গতা, যা প্রতিটি চরিত্র এবং প্রতিটি প্রজন্মের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। বুয়েন্দিয়া পরিবারটি এমন এক অভিশাপের মধ্যে বাস করে, যেখানে তারা বারবার এক ধরণের নির্জনতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়।

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সৃষ্টির প্রতি আকর্ষণ এবং বিজ্ঞান ও জ্ঞান অনুসন্ধানের মধ্যেও তাকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। তার স্ত্রী উরসুলা, যিনি পরিবারের মেরুদণ্ডের মতো কাজ করেন, তিনিও তার নিজের দুঃখ এবং নিঃসঙ্গতা নিয়ে বেঁচে থাকেন। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের বুয়েন্দিয়ারাও প্রেম এবং স্নেহের সন্ধানে নিঃসঙ্গতায় হারিয়ে যায়।

উপন্যাসের একসময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নিঃসঙ্গতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতাও প্রতিফলিত করে। মাকোন্দো শহরের ধ্বংস এবং বুয়েন্দিয়া পরিবারের পতন এই নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি, যা শুধুমাত্র একটি পরিবারের নয়, বরং পুরো মানবজাতির অভিজ্ঞতা।

বংশপরম্পরা এবং পুনরাবৃত্তি

বুয়েন্দিয়া পরিবারের অভিশাপটি মূলত তাদের বংশপরম্পরা এবং সেই পুনরাবৃত্তি, যা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। প্রতিটি প্রজন্মের বুয়েন্দিয়া একে অপরের মতো কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় এবং বারবার একই ভুলগুলো করে।

আর্কাদিও, আমারান্টা, আউরেলিয়ানো, এবং হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া—এরা প্রত্যেকেই তাদের পূর্বপুরুষদের মতো একই পথে হাঁটে এবং একই ধরণের সংগ্রামের মধ্যে বাস করে। এই পুনরাবৃত্তির ধারাটি বংশপরম্পরার একটি রূপ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে, যেখানে মানুষের অভিজ্ঞতা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ থাকে।

এই পুনরাবৃত্তি এবং নিঃসঙ্গতা তাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়, এবং তারা সেই বৃত্ত থেকে কখনোই মুক্ত হতে পারে না। উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত বুয়েন্দিয়া পরিবারের অভিশাপ একটি চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে যায়, যা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের সমাপ্তি নির্দেশ করে।

পরিবর্তন এবং ধ্বংস

“নিঃসঙ্গতার একশ বছর” উপন্যাসের আরেকটি মূল থিম হলো পরিবর্তন এবং ধ্বংস। মাকোন্দো শহরের শুরু থেকেই এটি বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, এবং প্রতিটি পরিবর্তন শহরের জন্য একটি নতুন ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।

প্রথমে শহরটি শান্তিপূর্ণ, নির্জন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি স্থানে পরিণত হয়েছিল, যেখানে পরিবারগুলো সুখে জীবন যাপন করছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাণিজ্য, রাজনীতি, এবং শিল্পের প্রভাবে মাকোন্দো ধীরে ধীরে তার আদর্শিক চেহারা হারিয়ে ফেলে।

শহরটি ক্রমে যুদ্ধ, দুর্নীতি এবং সহিংসতার মুখোমুখি হয়, এবং এই পরিবর্তনের প্রভাবে বুয়েন্দিয়া পরিবারও তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে। শহরের ধ্বংস এবং বুয়েন্দিয়া পরিবারের পতন একইসাথে ঘটতে থাকে, যা মানবজীবনের পরিবর্তন এবং ধ্বংসের একটি প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

সমাপ্তি এবং নতুন সূচনা

“নিঃসঙ্গতার একশ বছর” উপন্যাসের সমাপ্তি একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের সমাপ্তি নির্দেশ করে। যখন আউরেলিয়ানো বাবিলোনিয়া মেলকিয়াদেসের ভবিষ্যদ্বাণী পড়ে, তখন সে বুঝতে পারে যে বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস এবং তাদের অভিশাপের মধ্যেই তাদের ধ্বংস লুকিয়ে ছিল।

উপন্যাসের শেষ মুহূর্তে, মাকোন্দো শহরটি একটি ঘূর্ণিঝড়ের দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়, এবং বুয়েন্দিয়া পরিবারের শেষ প্রজন্মও তাদের ইতিহাসের সাথে হারিয়ে যায়। এই ধ্বংসের সাথে সাথে নতুন সূচনারও ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কারণ পৃথিবী নতুন করে গড়ে উঠবে এবং নতুন প্রজন্মের মানুষরা সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।

উপসংহার : “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” শুধু একটি পরিবারের কাহিনী নয়, এটি মানবজীবনের গভীরতম অনুভূতিগুলির প্রতিচ্ছবি। নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা, অভিশাপ, পুনরাবৃত্তি, এবং ধ্বংসের মধ্য দিয়ে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ মানবজাতির ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন।

বুয়েন্দিয়া পরিবারের নিঃসঙ্গতার এই কাহিনী আমাদের শেখায় যে মানুষের জীবনে নিঃসঙ্গতা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে সেই নিঃসঙ্গতা থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি, নতুন সূচনার দিকে এগিয়ে যেতে পারি। মার্কেজের এই উপন্যাস আমাদের জীবনের গভীরতম সত্যগুলো নিয়ে চিন্তা করতে প্ররোচিত করে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি থেকে মুক্তির পথই মানবতার আসল মুক্তি।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.