চর্যাপদের সাহিত্য মূল্য আলোচনা কর: চর্যার সাহিত্যমূল্য বিচার করতে গেলে প্রথমেই আমাদের কতগুলি তাত্ত্বিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রথম প্রশ্ন হল যদি মেনে নেওয়া হয় গূঢ়ার্থব্যঞ্জক ভাষায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের আচরণীয় ও অনাচরণীয় কৃত্যের নির্দেশ প্রদানই এই গীতিগুলির উদ্দেশ্য ছিল এবং সীমিত সমমনস্ক সাধকগােষ্ঠীর মধ্যেই এগুলি প্রচলিত ছিল তাহলে ব্যাপক অর্থে এর সাহিত্য মূল্য বিচার করা সংগত কি না? এর উত্তরে বলা চলে চর্যাগুলি সমকালে কেমন করে আস্বাদন করা হত তার কোনা পাথুরে প্রমাণ নেই। তবে চর্যাগীতির আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বৌদ্ধধর্মের কূটতাত্ত্বিকতার বাইরে সাহিত্য হিসেবেই যে এগুলি আস্বাদন করতে চেয়েছিলেন তার চমৎকার পরােক্ষ প্রমাণ বেনের মেয়ে উপন্যাস থেকে দেওয়া সম্ভব।
‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসে শাস্ত্রীমশাই রাজপৃষ্ঠপােষণায় অনুষ্ঠিত এক কবি সভার বিবরণ দাখিল করেছেন। সেই কবি-সভায় সংস্কৃত ও প্রাকৃত কবিতার পর চাটিলপাদ, বীণাপাদ ও সরহপাদ কবিতা পড়েছেন। উপন্যাসের কথক জানিয়েছেন, “সেকালে একটা কথা উঠিয়াছিল যে, ছয়টা ভাষায় কবিতা লিখিতে না পারিলে, সে মহাকবি হইতেই পারে না। তাই যাহারা শুধু বাংলাতেই কবিতা লিখিত, তাহাদের কবি না বলিয়া পদকর্তা বলা হইত। কথক এই তথ্য উল্লেখ করেছেন মাত্র। তারপরে তার বচনে যে কবি সভার বিবরণ রয়েছে তাতে বাংলা ভাষায় কবিতা পাঠের ফলে ‘জয় জয’ শব্দে সভাস্থল ভরিয়া গেল। কথকের উদ্দেশ্য এখানে স্পষ্ট। বাংলা ভাষা সাহিত্যের আত্মপ্রকাশক হিসেবে চর্যাগীতিগুলিকে তিনি তুলে ধরতে চান। গৃঢ় আধ্যাত্মিক মূল্য যাই হােক না কেন এগুলির সাহিত্যমূল্য সম্বন্ধে শাস্ত্রীমশাই নির্দ্বিধ। এখানে উপন্যাসে শাস্ত্রীমশাই তাঁর কল্পনায় চর্যাকারদের রঞ্জিত করছেন। ধর্মসাধনার গুঢ়তত্ত্বের পরিবর্তে কাব্যরসাস্বাদনের আনন্দই যেন শাস্ত্রী মশাইয়ের কাছে মুখ্য।
শাস্ত্রীমশাইয়ের এই অভিপ্রায়কে আমরা তত্ত্বের অন্য কাঠামাে দিয়েও সমর্থন তে পারি। রােলান্ড বার্থ (Roland Barthes) তাঁর “The Death of the Author’ প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন প্রতি মুহূর্তে রচনাটি (text) কেমন করে রচয়িতার (author) কর্তৃত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রেও বলা চলে চর্যাকাররা যে উদ্দেশ্যেই গীতিগুলি রচনা ও আস্বাদন করুন না কেন ক্রমশই পদগুলি তাঁদের সেই আভিপ্রায়িকতা অতিক্রম করে স্বাধীন আস্বাদনের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই পদগুলির মধ্যে এমন উপাদান ছিল যার সাপেক্ষে আস্বাদনের ভিন্নতর এক জগৎ নির্মাণ সম্ভব। এই গীতিগুলির সাহিত্যমূল্য বিচারের সময় এই কথাগুলি স্মরণ রাখা প্রয়ােজন। চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য বিচারের জন্য আমরা কতগুলি সূত্রের উল্লেখ করব মাত্র। যথা:
ক. চর্যাগীতিগুলি পাঠ করলে দেখা যাবে চর্যারচয়িতারা তাদের পদগুলিতে সাধারণ জীবনের নানা তথ্য প্রয়ােগ করেছেন। এই তথ্য বিবৃতিমাত্র নয়, জীবন সম্বন্ধে গভীর সমবেদনাই এর মধ্যে ধরা পড়েছে। ফলে সাধারণ পাঠক আভিপ্রায়িক অর্থ বাদ দিয়ে গীতিগুলি পাঠ করলে অন্য সাহিত্যধারার মতােই জীবনযাত্রার নানা মনােগ্রাহী চিত্র লাভ করেন। উদাহরণ:
খ. তপনমােহন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা লিরিকে গােড়ার কথা’ পুস্তকে চর্যাপদের মধ্যে লিরিকের (lyric) বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। চর্যাগীতিগুলিকে আধুনিক অর্থে পুরােপুরি লিরিক হয়তাে বলা যাবে না। অবশ্য যদি মনের আবেগের (emotion) প্রকাশ গীতিকবিতার (lyric) অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয় তাহলে কোনাে কোনাে চর্যাকে গীতিকবিতা বলা যেতেই পারে। কাহ্নপাদের লেখা ১০ নং চর্যায় আছে
নিঘিন কাহ্ন কাপালি জোই লাগ”
মনীন্দ্রমােহন বসু এর ভাবানুবাদ করেছেন: ‘ডােম্বি, তাের সহ আমি করিবই সঙ্গ। কানু যে কাপালী যােগী নিধৃণ উলঙ্গ। পংক্তিটি সরলার্থেই তীব্র আবেগপূর্ণ প্রেমের বাচন হিসেবে গৃহীত হতে পারে—আধুনিক অর্থে একে লিরিক বলতেও আপত্তি নেই।
ঘ. কোনাে কোনাে চর্যা প্রায় ছােটো গল্পের আদলে রচিত। নাটকীয়তার চমৎকার নিদর্শন সেখানে পাওয়া যাবে। হরিণ বিষয়ক চর্যাটি নাটকীয়। ভুসুকু পাদের রচিত ২১ নং চর্যায় আছে এক ছটফটে ইদুরের কথা। সরলার্থে পড়লে মনে হবে ইদুরটি ধরা না দিয়ে কেমন করে ভুসুকুকে নাকাল করছে তারই রূদার গল্প যেন পরিবেশিত হল।
ঙ. চর্যায় সমাজজীবনের নানা ছবি আছে। কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক সমাজের এই ছবি জীবনবােধ জারিত। প্রকাশের ভাষাটিও প্রত্যক্ষ অথচ তার মধ্যে নিছক বিবৃতিমাত্র নেই। ঢেণপাদের চর্যায় আছে প্রতিবেশীবিহীন টিলাবাসীর কথা। একাকীত্বের বেদনা পাঠকচিত্তকেও জারিত করে। ভাষা এখানে চিত্ররূপময়।
গ. হরিণ বিষয়ক চর্যায় হরিণের ওপরে সরলার্থে মানবত্ব আরােপ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে ‘অপণা মাংসে হরিণা বৈরী’ এই পঙক্তিটি গুঢ়ার্থে নয় সরলার্থেই প্রবচন হয়ে উঠেছে।
চর্যা দেহতত্ত্বের গান হিসেবে রচিত ও প্রচারিত হলেও আমরা, পাঠকেরা সেই মর্মে এই পদগুলিকে নাও পড়তে পারি । গীতিগুলির মধ্যে এমন উপাদান আছে যা আধ্যাত্মিক গূঢ়ার্থকে অতিক্রম করে নিছক কাব্য হিসেবে পাঠ করার জন্য পাঠককে আকর্ষণ করে। তাই বলা যায়, সাহিত্য হিসেবে চর্যাপদের গুরুত্ব অপরিসীম।