Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

দ্য গড অফ স্মল থিংস: ইতিহাস, রাজনীতি এবং মনুষ্যত্বের জটিল বয়ান

অরুন্ধতী রায়ের রচিত “দ্য গড অফ স্মল থিংস” (The God of Small Things) উপন্যাসটি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় এবং খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়। প্রথম উপন্যাস হিসেবে রায়ের হাতে এনে দেয় বুকার পুরস্কার। উপন্যাসটি শুধুমাত্র সাহিত্যিক গভীরতায় নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এটি মূলত কেরালার আয়মেনেম নামক একটি ছোট শহরের পটভূমিতে রচিত, যেখানে বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ, এবং রাজনীতির জটিলতা ঘুরে ফিরে আসে। “দ্য গড অফ স্মল থিংস” নামটি নিজেই একটি রহস্যময় আবেদন বহন করে, যা উপন্যাসের বিষয়বস্তু এবং চরিত্রগুলির জীবনের ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর প্রভাব ফেলা ঘটনাগুলোর প্রতিফলন ঘটায়।

উপন্যাসের পটভূমি: কেরালা এবং আয়মেনেম

“দ্য গড অফ স্মল থিংস” এর গল্পের মূলে রয়েছে কেরালার আয়মেনেম শহরের একটি উচ্চবর্ণের খ্রিস্টান পরিবারের ইতিহাস। ভারতীয় সমাজের নির্দিষ্ট বর্ণব্যবস্থা এবং সামাজিক দমননীতির সমালোচনা উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় অংশে। রায় কেরালার ইতিহাস, রাজনীতি এবং সামাজিক সম্পর্কগুলির মধ্য দিয়ে একটি জটিল চিত্র আঁকেন, যেখানে স্থানীয় সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত প্রভাবশালী।

কেরালার কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং সামাজিক সাম্যবাদ নিয়ে গল্পটি প্রচুর আলোচনা করে। কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান এবং এটি কিভাবে স্থানীয় জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে তা দেখানো হয়েছে। কিন্তু, সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরকার দুর্বলতাগুলিও সামনে এসেছে। রায় বিশেষভাবে দেখিয়েছেন কিভাবে একদিকে সাম্যবাদের আদর্শ প্রচারিত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভেতর শোষণ এবং বর্ণবৈষম্য অব্যাহত রয়েছে।

বর্ণ, শ্রেণি এবং লিঙ্গের জটিলতা

উপন্যাসে বর্ণ এবং শ্রেণির সম্পর্ক নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা শুধু কেরালা বা ভারত নয়, বিশ্বজুড়ে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। “দ্য গড অফ স্মল থিংস”-এ মূল চরিত্রগুলি এই বর্ণ ও শ্রেণির দোলাচলে আটকে আছে। এস্তা এবং রাহেল, দুই জমজ ভাইবোন, তাদের জীবনকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন নিয়ম এবং শৃঙ্খলার বাধ্যবাধকতা। তারা একটি উচ্চবর্ণের পরিবার থেকে এলেও, তাদের জীবন শাসিত হয় সমাজের কঠোর নিয়ম এবং বৈষম্যের দ্বারা।

একইভাবে, বর্ণব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে “অস্পৃশ্যতা”র ধারণাটি উপন্যাসে গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। ভেলুথা নামের একজন নিম্নবর্ণের “অস্পৃশ্য” চরিত্রের মাধ্যমে রায় বর্ণভিত্তিক শোষণ এবং দমনকে বাস্তবসম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভেলুথার সঙ্গে অমু, জমজদের মা, সম্পর্কের কারণে সমাজের কাছে একরকম অপরাধী হয়ে ওঠেন। বর্ণের বেড়াজাল ভাঙার এই চেষ্টা কিভাবে সামাজিক কাঠামোর দ্বারা শাস্তিযোগ্য হয়ে যায়, সেটিই উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় দিক।

রায় লিঙ্গের প্রশ্নেও একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। অমু, একজন একক মা, যার জীবন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপে কঠিন হয়ে ওঠে। পুরুষের প্রভুত্ব এবং নারীর অধিকারহীনতার বাস্তব চিত্র উপন্যাসের বিভিন্ন স্থানে উঠে এসেছে। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে এক গভীর সমালোচনা।

প্রেম, নিষিদ্ধ সম্পর্ক এবং শাস্তি

উপন্যাসের অন্যতম প্রধান থিম হলো নিষিদ্ধ প্রেম এবং এর পরিণতি। সমাজের বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে প্রেম কিভাবে একটি বিপ্লবী কাজ হতে পারে, এবং এই প্রেম কিভাবে সমাজের বিভিন্ন বিধি-নিষেধ ভাঙতে পারে, সেটি এই গল্পে অত্যন্ত প্রভাবশালীভাবে ফুটে উঠেছে। অমু এবং ভেলুথার মধ্যে সম্পর্ক শুধু একটি প্রেমের গল্প নয়, বরং সমাজের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদের প্রতীক। বর্ণব্যবস্থা এবং সামাজিক নিয়মাবলীর কারণে তাদের সম্পর্ক নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়। এই সম্পর্কের কারণে তাদের জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি, যা ভারতীয় সমাজের কঠোর এবং রক্ষণশীল মানসিকতার বাস্তব প্রতিফলন।

রায় প্রেমের এই নিষিদ্ধতা এবং এর বিপরীতে সমাজের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, সমাজ কিভাবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে শোষণ করে এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করে। এখানে প্রেম একটি সামাজিক বিপ্লবের প্রতীক হয়ে ওঠে, যা ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।

সময়ের সঙ্গে গল্পের খেলা

“দ্য গড অফ স্মল থিংস” এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এর সময়ের সঙ্গে খেলা করা। রায় একটি অচলায়তনিক বর্ণনাভঙ্গি ব্যবহার করেছেন, যেখানে সময় এবং স্মৃতি মিলে মিশে গেছে। গল্পের বর্তমান এবং অতীত সমান্তরালভাবে চলে, এবং পাঠককে ক্রমাগত সময়ের ভ্রমণের মধ্যে থাকতে হয়। জমজ ভাইবোনদের শৈশব এবং বর্তমান সময়কে মিলিয়ে মিশিয়ে দেখানো হয়েছে, যা তাদের জীবনের ঘটনাগুলোকে আরও গভীরতা দেয়। এই সময়ের জটিল ব্যবহারের ফলে পাঠককে প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় যে, কি ঘটেছে এবং কিভাবে তা তাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে।

উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখি, জমজ এস্তা এবং রাহেল তাদের শৈশবে ফিরে যাচ্ছে, যেখানে একটি বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে তাদের জীবন চিরতরে বদলে যায়। রায় দেখিয়েছেন, স্মৃতি এবং অতীত কিভাবে আমাদের বর্তমানকে শাসন করে এবং আমাদের জীবনকে আকার দেয়। উপন্যাসের বিভিন্ন স্থানে সময় এবং স্মৃতির এই জটিলতা গল্পের জটিলতাকে আরও গভীর করে তোলে।

শৈশবের নষ্টালজিয়া এবং ট্রমা

উপন্যাসটি মূলত জমজ ভাইবোনের শৈশব এবং তাদের অভিজ্ঞতার কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শৈশবের নিষ্পাপতা এবং এক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির পরিণতি তাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে ছাপ ফেলে। শৈশবের নষ্টালজিয়া এবং স্মৃতির মধ্য দিয়ে গল্পের কেন্দ্রীয় ভাবনা ফুটে ওঠে। শৈশবের নিস্পাপ দৃষ্টিতে সমাজের জটিলতা এবং নিষ্ঠুরতা ধরা পড়ে, যা রায়ের গল্প বলার কৌশলকে অনন্য করে তুলেছে।

তবে, শৈশবের এই নষ্টালজিয়া শুধু সুখকর নয়, বরং এটি একটি ট্রমার গল্পও। জমজদের শৈশবকালীন এক মর্মান্তিক ঘটনা তাদের জীবনে স্থায়ীভাবে গভীর প্রভাব ফেলে। রায় অত্যন্ত সতর্কভাবে শৈশবের নিষ্পাপতার সাথে সেই ঘটনাগুলোর তীব্রতা এবং দুঃখকে মিশিয়ে দিয়েছেন, যা উপন্যাসটিকে গভীর বেদনাবোধে পূর্ণ করে তুলেছে। শৈশবের আনন্দের মধ্যেও গল্পের প্রতিটি কোণে একটি অব্যক্ত দুঃখ এবং ট্রমার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।

রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত জীবনের সংঘর্ষ

উপন্যাসটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এটি কিভাবে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে রাজনৈতিক বাস্তবতার সংঘর্ষকে তুলে ধরে। রায় দেখিয়েছেন, কিভাবে রাজনীতি শুধুমাত্র বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোতেই নয়, বরং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন এবং সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পে, রাজনীতির সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের আন্তঃসম্পর্কটি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ভেলুথার জীবন, কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব, এবং সমাজের নিপীড়নমূলক কাঠামোর মধ্যে তার সংগ্রাম, সবকিছুই এই রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ। ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং প্রেমও এখানে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, যেখানে মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নটি বারবার উঠে আসে।

ভাষার কাব্যময়তা এবং গল্প বলার শিল্প

“দ্য গড অফ স্মল থিংস” এর ভাষা অত্যন্ত কাব্যময় এবং শৈল্পিক। রায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে শব্দের সঙ্গে খেলা করেছেন, যেখানে প্রতিটি বাক্যই যেন একটি চিত্রকল্প তৈরি করে। তার বর্ণনাভঙ্গিতে মিশে রয়েছে গভীরতা, সংবেদনশীলতা এবং একটি অদ্ভুত ছন্দ। ভাষার এই শৈল্পিকতা উপন্যাসটির সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং পাঠককে আবেগপূর্ণ একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়।

রায়ের গল্প বলার শৈলী অত্যন্ত অনন্য, যেখানে প্রতিটি চরিত্র এবং ঘটনা একটি বৃহত্তর বাস্তবতার অংশ হয়ে ওঠে। তার বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে শুধু গল্পের ভেতর প্রবেশ করায় না, বরং তাদেরকে নতুন দৃষ্টিতে সমাজ, রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিককে ভাবতে শেখায়। শব্দের মধ্যে একটি গভীর সৌন্দর্য এবং কাব্যময়তা আছে, যা গল্পের আবেগ এবং অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে।

উপন্যাসের সমাপ্তি: একটি অমীমাংসিত অধ্যায়

“দ্য গড অফ স্মল থিংস” এর সমাপ্তি পাঠকের মনে একটি গভীর ছাপ ফেলে। গল্পের মূল চরিত্রগুলোর জীবন একটি ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়, যা সমাজের কঠোর নিয়ম এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতিফলন। জমজ এস্তা এবং রাহেলের জীবন কখনোই স্বাভাবিক হয় না, এবং তারা চিরকাল শৈশবের সেই ট্রমা বহন করে চলে। উপন্যাসের সমাপ্তি মূলত একটি অমীমাংসিত অধ্যায় হিসেবে রয়ে যায়, যা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে এবং নতুন প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে।

উপসংহার: ছোট জিনিসগুলির ঈশ্বর এবং বৃহত্তর বাস্তবতা

“দ্য গড অফ স্মল থিংস” শুধুমাত্র একটি উপন্যাস নয়, বরং এটি সমাজ, রাজনীতি, এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে জটিল আন্তঃসম্পর্কের একটি মহাকাব্য। অরুন্ধতী রায়ের লেখা ছোট ছোট জিনিসের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জীবনের জটিলতাকে তুলে ধরে। প্রতিটি ছোট ঘটনা এবং সম্পর্ক একটি বৃহত্তর সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন, যা সমাজের মূল কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

উপন্যাসটির নামই বলে দেয়, এটি ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান করে—সেই ছোট ঘটনা, ছোট আবেগ এবং ছোট সম্পর্ক, যা মানুষের জীবনকে বদলে দেয়। সমাজের বড় বড় কাঠামোর বিপরীতে ছোট মানুষের গল্প এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। “দ্য গড অফ স্মল থিংস” সেইসব ছোট ছোট মুহূর্তের কথাই বলে, যা আমাদের জীবনকে অর্থ দেয়, যা আমাদের ভালোবাসা, কষ্ট, এবং বিদ্রোহের গল্প হয়ে থাকে।

অরুন্ধতী রায়ের এই উপন্যাস শুধুমাত্র ভারতীয় সাহিত্যের জন্যই নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেও এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়। “দ্য গড অফ স্মল থিংস” এর মধ্য দিয়ে রায় দেখিয়েছেন কিভাবে ছোট ছোট জিনিসগুলি একটি বৃহত্তর জীবনের গল্প বলে, যেখানে প্রেম, বেদনা, এবং বিদ্রোহ মিলে মিশে এক অভূতপূর্ব মহাকাব্য রচনা করে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.