স্যামুয়েল বেকেটের লেখা নাটক “ওয়েটিং ফর গডো” আধুনিক সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের মানুষের অস্তিত্ববাদী সংকটকে কেন্দ্র করে লেখা। নাটকটি ১৯৪৮ সালে রচিত হলেও, আজও এটি তার প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে। “ওয়েটিং ফর গডো” মূলত অর্থহীনতা, অনিশ্চয়তা, এবং অপেক্ষার গল্প। এটি এমন একটি নাটক, যেখানে প্রধান চরিত্ররা অনবরত এক অজানা, অদেখা সত্তার জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু সেই প্রতীক্ষার কোনো শেষ নেই।
বেকেটের এই নাটকটি প্রথাগত নাটকের ধারার বাইরে গিয়ে এক বিশেষ জীবনদর্শনের প্রতিফলন ঘটিয়েছে, যেখানে মানুষের অস্তিত্বের মূল প্রশ্নগুলো উঠে আসে। আমরা কেন বেঁচে আছি? জীবনের উদ্দেশ্য কী? এই প্রশ্নগুলোর কোনো স্পষ্ট উত্তর না থাকায় মানুষ সবসময়ই এক ধরনের অস্পষ্ট আশা আর অনন্ত প্রতীক্ষার মধ্যে বন্দী থাকে।
নাটকটির গভীরতর বার্তা হলো, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই এক অপেক্ষা, যেখানে আমরা কেউই জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে। বেকেটের নাটকে সেই চিরন্তন অপেক্ষার প্রতীক হিসেবে উঠে আসে “গডো” নামের এক রহস্যময় সত্তা, যার জন্য ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন দিনের পর দিন অপেক্ষা করে, কিন্তু সে কখনোই আসে না।
এই নাটক শুধুমাত্র দুই ব্যক্তির কাহিনী নয়; এটি মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে আমরা সবাই হয়তো কোনো এক অদৃশ্য আশা বা মুক্তির প্রতীক্ষায় আছি, কিন্তু সেই মুক্তি আমাদের কাছে কখনোই ধরা দেয় না।
“ওয়েটিং ফর গডো” স্যামুয়েল বেকেট রচিত একটি বিখ্যাত নাটক, যা আধুনিক অস্তিত্ববাদের (existentialism) প্রতীক হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। নাটকটির মূল কাহিনি খুবই সরল—দুটি প্রধান চরিত্র, ভ্লাদিমির এবং এস্ট্রাগন, নির্জন এক স্থানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে গডো নামের এক ব্যক্তির জন্য। এই গডো কে বা কী, কেন তারা তার জন্য অপেক্ষা করছে, সেটি স্পষ্ট নয়। নাটকটি দুটি অঙ্কে বিভক্ত এবং কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা সমাধান এখানে নেই, বরং পুরো নাটকজুড়ে চলে অপেক্ষা এবং প্রত্যাশার গল্প।
প্রথম অঙ্ক:
প্রথম অঙ্কে, ভ্লাদিমির এবং এস্ট্রাগন একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে এবং গডো আসবে বলে অপেক্ষা করতে থাকে। তারা বারবার নানা বিষয়ে আলোচনা করে, একে অপরকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের জীবন যেন আটকে রয়েছে শুধুই সেই গডোর অপেক্ষার মধ্যে।
তারা কিছু মনে রাখার চেষ্টা করে, বিশেষ করে গডোর আগের বার্তা এবং সে কখন আসতে পারে। তাদের মধ্যেকার কথোপকথন অসম্পূর্ণ ও এলোমেলো—কখনো স্মৃতিচারণ, কখনো ঝগড়া, কখনো হতাশার প্রকাশ। এর মধ্যেই দেখা যায় পোজো এবং লাকি নামের দুটি চরিত্রকে।
পোজো হলো এক সমৃদ্ধ ব্যক্তি, আর লাকি হলো তার দাস। পোজো লাকিকে দড়িতে বেঁধে নিয়ন্ত্রণ করে। পোজো নানা ধরনের অহংকারী কথাবার্তা বলে, যা তাকে একজন অত্যাচারী মনিব হিসেবে উপস্থাপন করে। লাকি একেবারে চুপ থাকে, তবে পরে পোজোর আদেশে সে কিছু সময়ের জন্য কথা বলে। কিন্তু তার বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক ও অসংলগ্ন।
পোজো এবং লাকি চলে যাওয়ার পর, একটি ছেলে এসে জানায় যে, গডো আজ আসবে না, তবে আগামীকাল আসতে পারে। এই খবর শুনে ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন হতাশ হয়, কিন্তু তারা ঠিক করে যে তারা পরদিনও অপেক্ষা করবে।
দ্বিতীয় অঙ্ক:
দ্বিতীয় অঙ্কে, কাহিনির কোনো বিশেষ পরিবর্তন ঘটে না। ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন আবারও সেই একই জায়গায় অপেক্ষা করছে। তবে একটি বিশেষ পার্থক্য হলো—তারা আগের দিনের কথা মনে করতে পারে না। সবকিছু যেন পুনরাবৃত্তির মতো ঘটতে থাকে।
এবার পোজো এবং লাকি আবার ফিরে আসে, কিন্তু এইবার পোজো অন্ধ হয়ে গেছে এবং লাকি বোবা হয়ে গেছে। তাদের এই অবস্থাও যেন নাটকের অস্তিত্ববাদের বক্তব্যকে জোরালো করে—সময়ের পরিক্রমায় সবাই অসহায় হয়ে পড়ে।
আবারও সেই ছেলেটি আসে এবং জানায় যে গডো আজও আসবে না। ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন হতাশ হয়ে যায়, কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পরের দিনও অপেক্ষা করবে। তাদের এই প্রতিজ্ঞা এবং পুনরাবৃত্তি নাটকের মূল বার্তা প্রতিফলিত করে—অপেক্ষা যেন কখনোই শেষ হয় না।
সারসংক্ষেপ: নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা এবং অনিশ্চয়তা চলছে। ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন গডোর জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু গডো কখনোই আসে না। তারা জানে না গডো কে, কেন সে আসবে, কিংবা আদৌ সে আসবে কিনা। তাদের জীবনের উদ্দেশ্য যেন কেবল সেই গডোর জন্য অপেক্ষা করা।
নাটকটি প্রথাগত কাহিনির চেয়ে বেশি দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলে ধরে। এটি মানুষের অস্তিত্বের অর্থ, উদ্দেশ্য এবং সময়ের মূল্য নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করে।