Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

নিঃসঙ্গতার একশ বছর: জাদুবাস্তবতা ও নিঃসঙ্গজীবনের ভিন্ন সংরূপ

লাতিন আমেরিকার নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত যুগান্তকারী উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর। এই উপন্যাসটি নির্বাচনের কারন শুধু লাতিন আমেরিকায় নয় গোটা বিশ্বসাহিত্যে বিশাল জনপ্রিয় ও বহুসমাদৃত। উপন্যাসটি লেখকের জীবন বদলে দেয় আর বিশ্ববাসীকে লাতিন আমেরিকান সাহিত্য পাঠে মনোযোগী করে তোলে।

আসলে, মার্কেসের শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় কেটেছে আরাকাতাকা গ্রামে। যে গ্রামটিতে পরিপূর্ণ দারিদ্রক্লিষ্ট,নানারকম কুসংস্কার। তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সুখ দুঃখ জীবন নিয়ে বিষ্ময়ে ঘেরা জগৎ, যে জগৎ সবার সামনে আছে কিন্তু সবার চোখে ধরা দেয় না চোখের পলকে উড়ে যায়। এইসব নানান অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছিল মাকোন্দো গ্রামের বিবরণ। আর এই গ্রামকে ঘিরে রচিত হয়েছিল মার্কেসের বিখ্যাত উপন্যাস “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” (Cienaños de soledad ) গার্সিয়া মার্কেস নিজেই বলেছেন, মাকোন্দো একটা কাল্পনিক জগৎ। বাস্তবের সঙ্গে কোনো অস্তিত্ব নেই। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কীভাবে মাকোন্দো নামটা মাথায় আসে। যেখানে তিনি শৈশব ও কৈশোর জীবন অতিবাহিত করেছেন। আরাকাতাকা গ্রামের বাড়ি বিক্রির জন্য মায়ের সঙ্গে আসে একেবারে আদ্যিকালের ট্রেনে চড়ে। ট্রেনে করে আসা মা ও ছেলের কথোপকথন বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। মার্কেস লক্ষ্য করলেন, ট্রেনে করে যে সব যাত্রীরা আসছিল, তারা নিজ নিজ গন্তব্যে নেমে যায় এবং তিনি ও তাঁর মা ছাড়া গোটা ট্রেন থালি হয়ে যায়। ট্রেনে আসতে আসতে জানালা দিয়ে মার্কেস দেখে, তাঁর ছোটবেলার চেনা পরিসর সময়ের সঙ্গে কতটা বদলে গেছে। মা ও ছেলে দুজনেই এতটাই নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে যে, নিজেদের কথা অপরজনের কাছে ব্যক্ত করতে পারছে না। বর্তমান সন্দর্ভে আমি তুলনামূলক সাহিত্যের দৃষ্টিকোনের উপরেই গুরুত্ব আরোপ করছি।

“যখন অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার পরিবর্তন (অলৌকিক) থেকে উঠে আসে তখন চমৎকারনির্ভুলভাবেচমৎকার হতে শুরু করে”।—আলেহোকার্পেন্তিয়র (১৯৪৯)

উপন্যাসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ‘মাকোন্দো’ নামক কাল্পনিক স্থানের পটভূমিতে ঐশ্বর্যময় অদ্ভূত এক জগৎ নির্মান করেছেন। পাঠক মাত্রেই ভাবতে পারেন ‘মাকোন্দো’ শিল্পন্নত দেশ, তা নয়। এটি তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। কল্পনা-রূপকথা সদৃশ্য জগতে এমন সব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে কিন্তু পাঠক হিসেবে আমরা যেটুকু ভাবতে পারি তা দেশ ও সমাজে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী তথা একান্ন বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও বাংলা পত্র পত্রিকা কিংবা বাংলায় অনুবাদ প্রকাশ দেখি তা বোঝা যায়। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয় আমরা ‘মাকোন্দো’-র দেশেই বাস করছি। আজ স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর অতিক্রান্ত করেছি। আমরা ‘মাকোন্দো’-র নয়া ঔপনিবেশিক চাকচিক্য দেখি শুধুমাত্র বড় বড় শহরে, ভারতেও, বাকি দেশ গ্রামীণ ভারতে অবাধ শোষণ লুন্ঠন – ধর্ম ব্যবসা চলে। বিদেশি প্রভুর জায়গায় দেশিরা আসলেও তাদের বিলাস বহুলতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কমার কোনো ক্ষীণ সম্ভাবনা নেই। শহর তথা দেশে বৈষম্য বেড়েছে, গ্রামীণ সংস্কৃতির যা অবশিষ্ট আছে তা কুসংস্কার এবং মধ্যযুগীয় আচার-বিচারে বিপন্ন। পত্তনের সময় ‘মাকোন্দো’ ছিল যথার্থই স্বাধীন।

প্রতিষ্ঠাতা হোসে আর্কাদিও বোয়েন্দিয়া নিজে পরিশ্রমী চাষি। তাঁর নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক মাকোন্দোবাসির আন্তরিক চেষ্টায় অন্যান্য গ্রামের থেকে এগিয়ে যায় এই গ্রাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে অর্থাৎ আধুনিকতাকে ধরতে চাইছে। ‘কাদামাটি এবং ছিটেবেড়া’-র জায়গায় তৈরি হতে লাগল পাকাবাড়ি। বহিরাগতরা যখন বাড়ির নীল সাদা রং করার আদেশ দেয় তখন হোসে আর্কাদিও বোয়েন্দিয়া তীব্র প্রতিবাদ করে নিজের কাগজখানা ছিঁড়ে দেয় এবং বলে ‘এখানে কারও কোনো কর্তৃত্ব দরকার নেই’। আসলে হোসে আর্কাদিওর মাধ্যমে গ্রামটি উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়। সেখানে কারো কোনো মৃত্যু ঘটেনি। এমনকি ধর্মপ্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়নি, ধর্মবিশ্বাস বলে কিছু নেই। বোয়েন্দিয়া পরিবার বহিরাগতের দিকে আঙুল তোলে। উপন্যাসের মূল কাহিনি বোয়েন্দিয়া পরিবার – যাকে কেন্দ্র করে সাত প্রজন্মের কাহিনি নির্মাণ করেন মার্কেস। আসলে প্রথম প্রজন্মে যে স্বাধীন, সরল এবং যূথবদ্ধ জীবনধারায় প্রবাহিত হয় তা দীর্ঘায়িত হয় না। মাকোন্দোয় দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই নামে কোনো স্থানের কথা জানা ছিল না লেখকের। প্রাসঙ্গিকভাবে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কথা চলে আসে (মাকোন্দোর কাছে ঐকটি পরিত্যক্ত জাহাজ দেখা যায়)। তৎকালীন সময়ে স্পেনীয় ‘কোনকিস্তাদোর’রা প্রবল প্রতাপে ‘নতুন বিশ্ব’, ‘নতুন ভাষা’, ‘নতুন ধর্ম’ চাপিয়ে দিয়ে প্রভুত্ব কায়েম করে।

এ তো গেল প্রথম জীবনের কথা। পরবর্তী প্রজন্মে শুরু হয় লোভ, লালসা, বহুগামিতা এবং অজাচার। এর ফলে জন্ম নেয় বৈধ, অবৈধ সন্তান, অবাধ যৌনাচার, এসব সত্ত্বেও মা উরসুলা সবার প্রতি সমান যত্ন নেয় । এই সাহসী মা সংসারের রান্নাঘরের ‘ময়দা’ মেপে দেওয়া থেকে শুরু করে মাকোন্দোর সমস্ত কাজে এগিয়ে যায়। সংসারের বাঁধন অটুট রাখার জন্য পরিশ্রমের কোনো ত্রুটি নেই। এমনকি সন্তানদের অসুখে পাচন তৈরি করে খাইয়ে দেয়।

ঔপন্যাসিক যে গ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন, তা ধীরে ধীরে প্রকৃতির, মাটির, জলের বর্ণনা থেকে উঠে আসে মানুষের কথা, মানুষের আখ্যান। মানুষের সুখ দুঃখ, ভলো মন্দ, পাপ পুণ্যেরঠাসবুনোটে ফুটে ওঠে গার্সিয়া মার্কেসের অনবদ্য উপন্যাসের উন্মোচন। লেখক লেখেন মাকোন্দো গ্রামের বাসিন্দা বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাতপুরুষের নানা কাহিনি – যার সময়কাল একটি শতাব্দী। আর বুয়েন্দিয়া পরিবারের উত্থান পতনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মাকোন্দো গ্রামটির সূচনা – এই গ্রামটিকে কেন্দ্র করে সমস্ত আখ্যানের বুনট। প্রকৃতির নিয়মে মানুষের জন্ম-মৃত্যু ঘটে কিন্তু মাকোন্দো গ্রামটি থেকে যায় মহাকালের নিরপেক্ষ কষ্টিপাথর বা প্রবহমান সময়ের স্রোত।

বোদলেয়ারের দ্বারা প্রভাবিত কবি বুদ্ধদেব বসু, সেভাবেই মেক্সিকোর ব্যতিক্রমী লেখক হুয়ান রুলফোর দ্বারা গার্সিয়ামার্কেসপ্রভাবিত হয়। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে রুলফোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পেদ্রোপারামা’-র কথা। এই উপন্যাসে কোমালা নামক একটি গ্রাম উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে টানাপোড়েন এবং মানব সভ্যতার জটিল যাত্রাপথের এক নিস্পৃহ সাক্ষী। এই উপন্যাসের মূল কাহিনি স্মৃতি রোমন্থন আর কোমালা সেখানে অনেক মানুষের অজস্র স্মৃতির এক ক্যালাইডোস্কোপ। স্মৃতির তাড়নায় ব্যঞ্জনা পাল্টে যায়। মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনকে ধ্বংস করে মানুষের আধিপত্য ও আকাঙ্খা। ঠিক সেভাবেই কোমালার চমৎকার অতীত ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয় নিষ্ঠুর বর্তমানের অভিঘাতের স্বারা। উপন্যাসের শেষে দেখা যায় কোমালা আসলে এক মৃত জনপদ, মৃতদের গ্রাম।

উপন্যাসে মাকোন্দোর নির্মাণ অনেকটাই সেরমই। কাল্পনিক অদ্ভুদ নামক গ্রামটির (মালোন্দো) সঙ্গে মিশে রয়েছে স্বপ্নে ও বাস্তবে মোড়া গার্সিয়া মার্কেসের শৈশবের অকপট ঘটনা এবং লাতিন আমেরিকার মানুষের দুঃখ-বেদনা-হতাশ-নকশার সূক্ষ্ম বুনন। মানুষের অস্তিত্ব সংকটের কাহিনি এবং সেই সংকটকাটিয়ে ওঠার প্রয়াস এবং ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতার মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ধরা পড়েছে আধুনিক সভ্যতার আসল সংকট, নিঃসঙ্গতা।

মার্কেস আরাকাতায় গ্রাম্য পরিবেশে যৌথ পরিবারের মধ্যে ছেলেবেলা অতিবাহিতকরেছে। তাঁর ঠাকুমা মূর্খ, তাঁর কাছ থেকে কথাশিল্পী হওয়ার প্রথম পাঠ নেন। যে গ্রামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাস্তব অবাস্তবের সংমিশ্রণ। যে পরিবেশ, পরিস্থিতির মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন সেই পরিবেশের ছায়া ফেলেছে শুধু ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ নয়। মার্কেসের লেখা প্রায় সব উপন্যাস এবং ছোটগল্পে যা পরবর্তী দিনে সংজ্ঞায়িত হয়েছে জাদুবাস্তবতা বলে।

‘জাদু’ এবং ‘বাস্তবতা’ শব্দ দুটি আলাদা। জাদুর সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। এই দুটি বিষয় এক হয়ে সাহিত্যে নতুন আবেদন সৃষ্টি করেছে। ইংরেজিতে এটি ম্যাজিকরিয়ালিজম নামে পরিচিত। সাহিত্যে এটি এমন এক সুপরিচিত নাম একটাকে ছাড়া অন্যটা চলে না। এই সম্পর্কে বিশিষ্ট মেক্সিকান সাহিত্য সমালোচক লুই লীল বলেছেন, আপনি যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন এটি কি, তাহলে তা জাদুবাস্তবতাই নয়। অর্থাৎ জাদু বাস্তবতা এমন এক বিষয় যা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা এক উজ্জ্বল সত্য। অত্যধিক জনপ্রিয় এবং প্রচুর আলোচিত উপাদান। ব্যপারটি সম্বন্ধে আমার মনে হয়েছে, লেখায় উপস্থাপিত ঘটনাটি ঘটবে জাদুর মতো, মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু সচেতন পাঠক মাত্রই অনুভব করবেন, তাতে এমন কিছু পাবেন, যা জাদুবাস্তবতা উৎপত্তির সূত্রপাত কোথায়?

এটি খেয়াল করলে দেখা যাবে, মধ্যযুগে রচিত মঙ্গলকাব্যের দিকে। চন্ডীমঙ্গলে উল্লেখিত ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ এর সন্ধান পাওয়া যায়। কেননা দেবী চন্ডী একেক সময় একেক রূপ ধারণ করেছেন। হতে পারে জাদুবাস্তবতারই রূপান্তর। এছাড়াও আরব্য রজনীর কাহিনি তে জাদুবাস্তবতার সন্ধান মেলে- ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন একজন জার্মান শিল্প সমালোচক ফ্রাअরোহ ১৯২৫ সালে । তিনি ম্যাজিক রিয়ালিজমের আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছেন, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের বিখ্যাত ম্যাজিকরিয়ালিজমের লেখক আলেহোকার্পেন্তিয়র। মার্কেসের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারন বলা যেতে পারে ম্যাজিকরিয়ালিজম বা জাদু বাস্তবতা। দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্যে বেশ সাধারন একটি বিষয় ম্যাজিকরিয়ালিজম। মার্কেসের লেখার মধ্যে সারা পৃথিবীতে এটি আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে।

উপন্যাসটির তেবোয়েন্দিয়া পরিবার এবং মাকোন্দোর গল্প তো আছে এছাড়াও কাহিনি রয়েছে প্রকৃতি এবং মানুষের নিবিড় মিশে থাকার। প্রকৃতি থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে নেমে আসে নিঃসঙ্গতা এবং ধ্বংসের কাহিনি। মাকোন্দোর মাটিতে বোয়েন্দিয়া পরিবার বসবাস শুরুর সময় থেকে আপাত সারল্যের মধ্যে নিহিত ছিল অবক্ষয় আর ধ্বংসের বীজ। ধ্বংস আর অবক্ষয়ের বীজ বপন শুরু হয় হোসে আর্কাদিও বোয়েন্দিয়া এবং উরসুলার বিয়ের মাধ্যমে আসলে এদের সম্পর্ক হচ্ছে থুড়তুতো ভাইবোন, অবৈধ সম্পর্কের পরিণতি। তাদের কাহিনি অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় মাকোন্দোতে বসবাস শুরুর আগে ওদের বাস ছিল অনাম, অখ্যাত গ্রামে। কৈশোর থেকে তারা একে অপরের প্রতি অনুরক্ত ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে তারা বিয়ে করে,সহবাস করে কারন অজাচারজনিত পাপের ভয়ে। গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস ছিল যে, ভাইবোনের সম্পর্কে বিয়ে হলে সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান জন্ম হয় না। এইসব ভাবনাচিন্তা জ্ঞাত থাকার পরেও শেষে তারা বিয়ে করে। সুস্থ ও স্বাভাবিক তো নয়ই বরং পেছনে শুয়োরের লেজ যুক্ত সদ্যোজাত সন্তানের জন্ম দেয়। (হাবিব, পৃঃ৩৪৯)

এইভাবেই শুরু হয় বোয়েন্দিয়া পরিবারে পাপের বীজ বপন। অপর দিকে গ্রুদেন্সিওর আত্মা বিবেকযন্ত্রণা হয়ে ঘুরে বড়ায়, ওই পরিবার থেকে মুক্তি পাবার জন্য। তারা মুক্তির সন্ধানে নতুন বাসভূমির খোঁজে পাড়ি দেয়।

প্রাচীন শহর রিও আচার সন্ধানে বেরোয় তারা। ভাগ্যান্বেষী মানুষেরা প্রকৃতির সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই করে যখন তারা ক্লান্ত তখন মাকোন্দোতে এসে পৌঁছায়। আর সেখানেই গড়ে ওঠে তাদের নয়া বাসভূমি।

মাকোন্দো গ্রাম যখন তৈরি হয়, তখন তা ছিল প্রকৃতির আয়না। উপন্যাসে লক্ষ্যণীয়, “অনেক বছর পর যখন কর্নেল আউরোলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন হঠাৎ তাঁর মনকে বিদ্ধ করে স্মৃতির ব্যাখা। সেই অনেকদিন আগের এক বিকেলের স্মৃতি, যেদিন তার বাবা হাত ধরে বরফ দেখাতে নিয়ে গেয়েছিল। মাকোন্দো তখন নেহাতই এক গন্ডগ্রাম, যেখানে কাদামাটি আর নলখাগড়া দিয়ে বানানো গোটা কুড়ি বাড়ি। তাদের পাশ দিয়ে শান্ত ধারায় কলকল করে বয়ে চলেছে এক স্বচ্ছজলের নদী। জলের নিচে প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল পাথর। এতো মসৃন যেন পালিশ করা। পৃথিবীটা তখন একেবারে সদ্যোজাত। তার বেশিরভাগ জিনিসের তখনও নাম দেওয়া হয়নি। আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দিতে হয়”। ( হাবিব, পৃঃ২৮৫)।

বুয়েন্দিয়া পরিবারে কাম ও ক্রোধের মত্য দিয়ে যে পাপের সূত্রপাত, সেই পাপের চাকা এগিয়ে যায় নানা কুবৃত্তিকে আশ্রয় করে। তার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে প্রবেশ করে লোভ। এরইমধ্যে কোথা থেকে হাজির হয় যাযাবর জিপসিমেলকিয়াদেস, যার আসাধারণ জাদু ক্ষমতার দ্বারা বশ করে ফেলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে। জাদুর প্রভাবে গৃহপালিত পশুর বিনিময়ে কিনে ফেলে একটা চুম্বক এবং ধনী হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মাকোন্দোর মাটিতে সোনা খুঁজতে শুরু করে হোসেআর্কাদিও। এরই লোভে আর্কাদিও বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। শুরু হয় শতবর্ষব্যাপী একাকিত্বের উপাখ্যান, নিঃসঙ্গজীবন। আশ্চর্যের একটি বিষয় তা হল, প্রাজ্ঞ মেলকিয়াদেস হোসে আকার্দিওকে একবারের জন্য হলেও ঠকাবার চেষ্টা করেনি। মেলকিয়াদেস জাদুর প্রভাবে এমনভাবে বশ করেনিয়েছিল যে, আর্কাদিও নেশায় মত্ত থেকে একের পর এক ‘উদ্ভট খেলনা’ জিনিস কিনতে থাকে। আর দাম মেটাতে থাকে উরসুলার সযত্ন সঞ্চয় থেকে, তা গৃহপালিত পশুই হোক বা বহুমূল্য স্বর্ণমুদ্রাই হোক। সে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েও হার মানে না। তাকে তাড়া করে বেড়ায় ধনী হওয়ার স্বপ্ন। সে এতটাই ধনী হওয়ার স্বপ্নের উন্মাদনায় মেতেছে যে, এমনকি পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যে গ্রামের মাটিতে পেশির জোরে সোনা ফলাতে পারতো, সে মাটিতে পাগলের মতো সোনা খোঁজার চেষ্টা করে। অথচ তারই উদ্যোগে এবং ভাবনা চিন্তায় মাকোন্দো বহির্বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও পরিণত হয়েছিল সবচেয়ে সুসংগঠিত, সুখী ও কর্মব্যস্ত গ্রামে। যে গ্রামে প্রতিটি বাসিন্দার বয়স তিরিশের কম এবং যে গ্রাম কখনো মৃত্যু দেখেনি। বুযেন্দিয়া পরিবারকেই ওই গ্রামের আদর্শ পরিবার বলে গণ্য করা হতো । মাকোন্দোতে বুয়েন্দিয়া বাড়ির স্টাইলে ছিল আরো অন্যান্য সব বাড়ি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় অঞ্চলটির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। তুলনামূলক সাহিত্যের ইতিহাসবিদ্যার (Historiography) পদ্ধতি অবলম্বনে দেখা যায় যে, গোটা প্রক্রিয়াটাই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তৈরি। মা উরসুলার আবিস্কার করা জলাভূমি পেরোনোর পথ দিয়ে যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটে বাইরের জগতের সামনে। কৃষিজীবী থেকে শুরু করে নানানধরণের ব্যবসায়ী আসে গ্রামটিতে। গ্রাম সমৃদ্ধ হতে থাকে। আসে সরকার, আসে পাদ্রিরা, আসে পুলিশ। গ্রামটির আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে অর্থাৎ আধুনিকতাকে ধরতে চাইছে। এর ফলে মাকোন্দো আর আগের মতো নেই। কাদামাটি আর ছিটেবেড়ার, পরিবর্তে আসে ‘ইঁটের ঘর, ইঁটের দেয়াল, কাঠের জানালা, সিমেন্টেরমেঝে……. সেই সঙ্গে আসে অনাচার, অজাচার, প্রেমহীন শরীরী উন্মাদনায় ঝাঁপ দেয় বুয়েন্দিয়া পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সব সম্পর্কের উত্তাপ ছাপিয়ে গিয়ে শুধু পড়ে থাকে নিঃসঙ্গতা।

মার্কেস তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, আরাকাতাকে ঘিরে অতীতের যে শৈশবের স্মৃতি ছিল ট্রেনে মায়ের সঙ্গে যেতে যেতে লক্ষ্য করলেন শহরটি নিঃসঙ্গ নিঝুম ধরা রূপ। লেখকের মনে হয়েছিল ওই শহরের পথে চেনা মানুষকেও আর চেনা যায় না। গোটা শহরটা একটা অজানা ঘোরের মধ্যে আবর্তিত। সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে বিষন্নতা এবং নিঃসঙ্গতা। আর এসব কারনেই মাকোন্দোতে আষ্টেপৃষ্টেরয়েছে স্বপ্ন ও বাস্তবে ঘেরা ব্যক্তিগত স্মৃতি বিস্মৃতি এবং লাতিন আমেরিকার মানুষের দুঃখ বেদনা-হতাশা- মোড়া অস্তিত্বের সংকট। লাতিন আমেরিকা পরিচয়টাই তো সাম্রাজ্যবাদের দেগে দেওয়া, সেখানে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তার অস্তিত্বের বিশুদ্ধতা, তার ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং প্রাক-স্প্যানিশ যুগের সমস্ত অভিজ্ঞান। তার পূর্বপুরুষের রক্তে মিশে গেছে বিদেশি শাসকদের রক্ত। বিজেতাদের ভাষা ছাড়া তার কথা বলার উপায় নেই। তীব্র যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে অতীতকে খুঁজে বেড়ায়, স্বপ্নকে ভাড়া করে ফেরে উদ্ভট সব কল্পকাহিনি – গ্রাম থেকে জনপদ, জনপদ থেকে নগর এবং নগর থেকে ধ্বংসস্তূপের অনিবার্য যাত্রাপথ। জিপসিদের হাত ধরেই মাকোন্দোতে অলৌকিকের প্রবেশ। জিপসি মেলকিয়াদেস জাদুবিদ্যায় এতটাই পারদর্শী যে, তার চুম্বকের টানে রান্নাঘর থেকে হুড় মুড় করে বেরিয়ে আসে লোহার তৈরি বাসনপত্র। মেলকিয়াদেসের হাত ধরেই জাদুবিদ্যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে গোটা মাকোন্দো জুড়ে।

মাকোন্দোতে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় রূপকথা বা মিথ। মিথের আগমন বিভিন্ন সূত্র ধরে। যেমন ‘মাকোন্দো’ কথাটির উৎস সম্ভবত উত্তর কঙ্গোর ভাষায় কলার বহুবচন ‘মানকোন্দা’। বিভিন্ন ধরণের ব্যবসায়ীরা মাকোন্দোতে এসে কলা চাষ, আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে আসা কৃষি শ্রমিকদের বংশধর, কলার গন্ধ এবং কলা চাষ বন্ধ হয়ে গেলে মার্কিন কোম্পানির ফেলে যাওয়া কলার বর্জ্য মিলেমিশে এক ধরনের মিথ হয়ে ওঠে। এক সময় যেটা বাস্তব ঘটনা ছিল, তারই গায়ে জলহাওয়া লেগে তা পরাবাস্তব হয়ে ওঠে। যেমন, কুড়ি বছরের যুদ্ধকে ঘিরে নানা অতিরঞ্জিত ঘটনা তৈরি হয়। এমনকি এটাও শোনা যায় যে, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে নরখাদকরা খেয়ে ফেলেছে। যেমন শুয়োরের লেজ নিয়ে বাচ্চর জন্ম এবং অচিরেই সেই শিশুর পিঁপড়েরখাদ্যতে পরিনত হওয়া, আগুন ছাড়া জল ফোটা, গর্ভস্থ শিশুর কান্না পাওয়া-এইসব নানান রকমের রূপক ও মিথকে ঘিরেই তৈরি হয় মাকোন্দোর যাত্রাপথ।

শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা আসলে মাকোন্দোরই। তার বাসিন্দারা এক একটি রক্ত মাংসের গড়া মানুষ। মৃত্যু হয়ে ও তারা আজীবন নিঃসঙ্গতার অবসান ঘটায়। সচেতন পাঠক মাত্রেই ভাবেন, যুগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও মাকোন্দো নিঃসঙ্গতার সাক্ষী বহন করে। যে নিঃসঙ্গতা থেকে তৈরি হয় মাকোন্দোর একাকী যন্ত্রণার বিম্বিত, মানুষের ভালোমন্দতে গড়া এক মহাকাব্যিক আলেখ্য। নিঃসঙ্গতা মার্কেসের অন্যান্য গ্রন্থে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ‘নিঃসঙ্গতা’ (Solitude) শব্দটি লাতিন আমেরিকা মানুষেরা শুনলে আজও বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।

Reference : 

Litinfinite Journal ISSN: 2582-0400 [Online] CODEN: LITIBR

Vol-1, Issue-1 (2nd July, 2019 )

Page No: 70-77

DOI: 10.47365/litinfinite.1.1.2019.70-77 Section : Article

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More

রাজিয়া খান এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

রাজিয়া খান (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬ – ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১) প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক, যিনি শুধু লেখালেখির জগতে নয়, মঞ্চ নাটকেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তার পুরো নাম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.