মার্কসবাদ এর বিকাশে লেনিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তার বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৬ সালে তার “Imperialism; the Highest Stage of Capitalism”গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি সাম্রাজ্যবাদ কে ” ধনতন্ত্রের একচেটিয়া স্তর (Monopoly stage of capitalism) এবং “পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর” (Highest stage of capitalism)বলে বর্ণনা করেন। লেনিনের মতে সাম্রাজ্যবাদ হল ধণতন্ত্র বিকাশের সেই স্তর যে স্তরে একচেটিয়া পুঞ্জি ও ফিনান্স পুঞ্জির কর্তৃত্ব সু প্রতিষ্ঠিত, যে স্তরে পুঁজির রপ্তানি সুস্পষ্ট গুরুত্ব অর্জন করেছে, যে স্তরে আন্তর্জাতিক ট্রাস্ট গুলির মধ্যে পৃথিবীর ভাগ বাটোয়ারা শুরু হয়ে গেছে এবং যে স্তরে বৃহৎ ধনতান্ত্রিক শক্তিবর্গের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চল ভাগাভাগি হয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য যে লেনিনের আগে সাম্রাজ্যবাদের উপর বিস্তৃত আলোচনা করেন হবস তাঁর “Imperialism” গ্রন্থে।
লেনিন উল্লেখিত সাম্রাজ্যবাদের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য
১) লেনিনের বক্তব্য অনুসারে পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশের ফলে সাম্রাজ্যবাদী যুগে একটি দেশের উৎপাদন ও পুঁজি কেন্দ্রীভূত হয় এবং একচেটিয়া কর্তৃত্বের উদ্ভব ঘটে। এই একচেটিয়া কর্তৃত্ব পুরো অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এইভাবে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে দুটি বা তিনটি কার্টেল বা ট্রাস্ট দেশের শিল্প ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে এইভাবে উৎপাদন ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে।
২) ফিনান্স পুঁজির আধিপত্য পুঁজিবাদের প্রথম যুগে শিল্পের মালিক ও ব্যাংকের মালিক ছিল পৃথক। শিল্পের উন্নতি এবং শেয়ার কোম্পানিগুলির ব্যাপক সম্প্রসারনের ফলে ব্যাংকের মালিকরা বিভিন্ন শিল্প কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করতে শুরু করে। অন্যদিকে বৃহৎ শিল্পপতিরা ক্রয় করে ব্যাংকের শেয়ার। এভাবে ব্যাংক পুঁজি শিল্পপুঁজির মিলনের ফলে এক নতুন আর্থিক শক্তি দেখা দিল যার নাম ফিনান্স পুঁজি। ফিন্যান্স পুঁজির ফলে শিল্প ব্যাংকের মালিকানা দেশের শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক হয় মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিল্পপতি।
৩) পুজির রপ্তানি সাম্রাজ্যবাদের যুগে পণ্যরপ্তানি হ্রাস পায়। পুঁজি রপ্তানি অত্যাধিক লাভজনক হওয়ায় পুঁজির রপ্তানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। পুঁজিবাদী দেশগুলি পুঁজিকে নিজের দেশে বিনিয়োগ না করে বেশি মুনাফা পাওয়ার জন্য অনুন্নত দেশগুলিতে বিনিয়োগ করে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা | যায় ১৮৬২ সালে ব্রিটেন বিদেশে ১২৬ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করে। ১৯০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১৭০ কোটি পাউন্ড। ১৯১৪ সালে হয় ৩৫০০ পাউন্ড।
৪) আন্তর্জাতিক একচেটিয়া গোষ্ঠীর আবির্ভাব সাম্রাজ্যবাদের যুগে একচেটিয়া পুঁজিপতি জোটের আবির্ভাব হয়। কার্টেল, সিন্ডিকেট,জোট প্রভৃতি পুঁজিপতিদের দ্বারা বিশ্বের বাজার এবং উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়। পুঁজিপতি শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলবার জন্য আঁতাত সৃষ্টি করে। অন্তর্দেশীয় বাজারের সাথে আন্তর্জাতিক বাজার অনিবার্যভাবে এক সূত্রে গ্রথিত হয়। লেনিনের ভাষায়, … the home market inevitability fund up with foreign market “.
5) বিশ্বের ভূখণ্ডগত ভাগ বাটোয়ার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীকে চূড়ান্তভাবে ভাগাভাগি করে নেয় (final partition of the globe) I লেনিন দেখিয়েছেন যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ফ্রান্স এবং | জার্মানির মতো পুঁজিবাদী দেশগুলি বিশ্বের ভূখণ্ডকে বন্টন করে নিয়েছে।
ক্ষয়িষ্ণু ও পারগাছা পুঁজিতন্ত্র (parasitic and decaying capitalism)
লেনিনের মতে, সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদ খয়িষজ্ঞ ও পরগাছা পুঞ্চিতন্ত্র-এ রূপান্তরিত হয় এখানে ব্যাংক পুঁজি ও মহাজনি পুজির মালিকের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায় সুদখোর পুঁজিপতির রাষ্ট্র(renter State) । লেনিনের মতে, পুঁজিবাদের চরম বিকাশের ফলে সাম্রাজ্যবাদের সংকট ঘনিয়ে আসে এবং এর পতন অনিবার্য। এই স্তরের পুঁজিবাদ হল মুমূর্ষ পুঁজিবাদ ( Moribund capitalism) I কেননা সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে সমাজ বিকাশের প্রাক্কাল।
লেনিনের মতে তিনটি কারণে মূলত গণতন্ত্রের পতন এবং সর্বহারা বিপ্লব আসন্ন হয়ে পড়ে।
(১) এখানে এমন অবস্থায় সৃষ্টি হয় যে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন না ঘটলে উৎপাদন শক্তির বিকাশ সম্ভম নয়। পরগাছা সুদখোর পুঁজিপতি শ্রেণী উৎপাদন শক্তির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে শ্রেণী সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে।
(২) উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত পুঁজিবাদকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়।
(৩) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পুঁজির অসম বিকাশের ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলির মধ্যেও উৎপাদন বৃদ্ধির হার একই রকম হয় না। হলে সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব গুলি আরো তীব্র হয়ে ওঠে।
সমালোচনা
১) লেলিন সাম্রাজ্যবাদকে একটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে না দেখে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন তাহলে তত্ত্বটি একপেশে অর্থনীতিবাদী তত্ত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২) লেনিনের তত্ত্বে পুজির রপ্তানির সাথে সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে এক করে দেখা হয়েছে। উপনিবেশ গুলির অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পুজির রপ্তানি করা হয়েছে।
৩) সমগ্র বিশ্বকে ভাগ বাটোয়ারা করার পিছনে লেনিন যে অর্থনৈতিক শোষণের স্বার্থটিকে তুলে ধরেছেন তা ঠিক নয়। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ ভাগ বাটোয়ারার অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক রেষারেষি।
৪) লেনিন যে সাম্রাজ্যবাদকে মুমূর্ষ পুঁজিবাদ বলেছেন তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি মুমূর্ষু তো হয়নি বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে।
উপসংহার : লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যে তত্ত্ব উপস্থাপিত | করেছেন বিশেষ করে ফিনান্স পুঞ্জীর বিপদ | সম্পর্কে যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে গিয়েছেন তা যে একটুও ভুল নয় তা আবার প্রমাণিত হলো যখন ২০০৮ সালের শেষের দিকে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা মহিরুহ | রূপ ধারণ করল। পুঁজিবাদী দেশগুলির অর্থনৈতিক ভীত এক ঝটকায় ধসে গেল। কয়েকদিনের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়ল। মানুষ আবার | সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা রাখতে চাইছে তার প্রমাণ সারা বিশ্বে বিশেষ করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনের লেখা বইয়ের চাহিদা।