লেনিন তাঁর ‘Imperialism, the Highest Stage of Capitalism’-এ সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট ধারণা দেন । মার্কস-এঙ্গেল্স সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে কোনো সুস্পষ্ট তত্ত্ব না দিলেও তাঁরা এই ধারণা ব্যক্ত করেন যে, পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক বিকাশের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হল সাম্রাজ্যবাদ। একটি পুঁজিবাদী দেশ যখন অপর কোনো অনগ্রসর দেশের ওপর আধিপত্য জারি করে—তখনই সাম্রাজ্যবাদ প্রকাশ লাভ করে। এই প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেল্স-এর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা থেকে লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের মূল বিষয় খুঁজে পান। পুঁজিবাদের নিম্নস্তরে সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ সম্ভব নয়, তা সম্ভব ও সাধিত হয় পুঁজিবাদের শীর্ষ স্তরে । কারণ শীর্ষ স্তরে পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটে বলে বড়ো বড়ো শিল্প কলকারখানাগুলি আরও বড়ো হয়, আরও সম্প্রসারিত হয়। এই কারণে ছোটো ছোটো শিল্প বা কলকারখানাগুলি প্রতিযোগিতায় অগ্রসর হতে না পেরে অপসৃত হয়ে যায় এবং বড়ো শিল্পটি একচেটিয়া হয়ে ওঠে। একচেটিয়া ও সম্প্রসারণশীল এই financial capital ই সাম্রাজ্যবাদের পথ প্রস্তুত করে।
সুতরাং, সাম্রাজ্যবাদ বলতে তাই বুর্জোয়া বা পুঁজিতন্ত্রের এরূপ শীর্ষ বিকাশকে বোঝায়। যেখানে financial capital-এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে, মাত্রাহীন পুঁজির রপ্তানি ঘটে, আন্তর্জাতিক ট্রাস্ট দ্বারা বিশ্ব-বাণিজ্য সম্ভার নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বড়ো বড়ো ধনী রাষ্ট্রগুলি সমগ্র বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয় নিজেদের স্বার্থে। সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে লেনিনের ধারণাটির তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। যথা—
১. একচেটিয়া পুঁজিবাদ,
২. পরগাছা পুঁজিবাদ এবং
৩. মুমূর্ষু পুঁজিবাদ |
১. একচেটিয়া পুঁজিবাদ: লেনিনের অভিমত অনুসারে পুঁজির কেন্দ্রীকরণ এমন একচেটিয়া কারবার সৃষ্টি করে, যারা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা প্রতিযোগী কারবারিদের হটিয়ে দিয়ে বাজার দখল করে এবং ব্যাংক-পুঁজির ক্ষেত্রেও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। একচেটিয়া কারবারের দুটি প্রধান রূপ হল— [a] কার্টেল ও [b] ট্রাস্ট। যখন কতকগুলি বৃহৎ পুঁজিবাদী সংস্থা নিজেদের মধ্যে উৎপাদনের পরিমাণ, বিক্রয়ের শর্ত, মূল্য নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে বোঝাপড়া করে নিয়ে সামগ্রিকভাবে বাজারকে নিজেদের মধ্যে ভাগ- বাঁটোয়ারা করে ফেলে তখন তাকে বলে কার্টেল।
অপরদিকে, যখন উৎপাদন সংস্থাগুলির পণ্যের উৎপাদন, বিক্রয় ও আর্থিক লেনদেন একটি সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তাকে বলে ট্রাস্ট। ট্রাস্টকে উপেক্ষা করার বা উপেক্ষা করে উৎপাদন করার কোনো স্বাধীনতা উৎপাদক সংস্থার থাকে না। এইভাবে পর্যায়ক্রমে সজ্জিত হয় বিপুল পরিমাণ পুঁজি, যা বিভিন্ন দেশে ও বাজার দখলের আশায় বিনিয়োগের জন্য রপ্তানি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজার দখলের জন্য আন্তর্জাতিক আঁতাত গড়ে ওঠে একচেটিয়া কারবারিদের মধ্যে | আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আশায় সমগ্ৰ বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করার সাম্রাজ্যবাদী নীতি প্রযুক্ত হয়। এই কারণে সাম্রাজ্যবাদকে একচেটিয়া পুঁজিবাদ বলা হয়েছে।
২. পরগাছা পুঁজিবাদ: লেনিন দেখিয়েছেন যে, একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ একদিকে যেমন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে কাজ করে, অপরদিকে তেমনই তার সম্প্রসারণ বা অগ্রগতির ক্ষেত্রে উৎকর্ষরূপ নিতে না পারায় পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারাটিও বাধা পায় এবং সামান্য একচেটিয়া পুঁজিপতি তাদের নিজেদের স্বার্থে এবং মুনাফা বাড়ানোর আশায় সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে।
একচেটিয়া পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজির বিকাশ ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদী নীতির মাধ্যমে অপর দেশের বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন করে মুনাফা অর্জনের আরও সুযোগ লাভ করে এবং প্রচুর পরিমাণে মুনাফা বাড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত মুনাফা সঞ্চয়ণের ফলে এদের চরিত্র হয়ে ওঠে অনাচার, ব্যভিচারী, শোষণকামী, অত্যাচারী প্রভৃতি। এই চরিত্রের জন্য সাম্রাজ্যবাদ ডেকে আনে যুদ্ধকে। এই কারণে সাম্রাজ্যবাদকে পরগাছা বলা হয়েছে।
৩. মুমূর্ষু পুঁজিবাদ: লেনিনের মতে, একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ উৎপাদিকা শক্তির যে অগ্রগতি সাধন করে তার মধ্যেই সমাজতন্ত্র পূর্ব শর্ত হিসেবে কাজ করে। একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ ঘটলে পুঁজিবাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ধনতান্ত্রিকতার বীজকে দুর্বল করে দেয় এবং এর ফলে বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। কারণ এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে যে অসম পুঁজির বিকাশ ঘটে, তা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির ক্ষেত্রে সংকট ডেকে আনে এবং সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই কারণে সাম্রাজ্যবাদ হল মুমূর্ষু পুঁজিবাদ।
সমালোচনা
লেনিনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্বটি কোনো কোনো সমালোচক কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে । অনেকে এ কথা ব্যক্ত করেছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত তত্ত্বটি একপেশে তত্ত্ব, কারণ তা অর্থনীতি ও যন্ত্রবাদ দোষে দুষ্ট। ওয়ালকার, এম ল্যাজারাস প্রমুখ সাম্রাজ্যবাদের জন্য অ-আর্থনীতিক কারণের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তাঁরা সাম্রাজ্যবাদের বিকাশে আদর্শগত, কৌশলগত প্রভৃতি কারণের কথাও বলেছেন। আবার কোনো কোনো সমালোচক, যেমন—ওয়ার্ড, ফিল্ডহাউস প্রমুখ মুনাফা ও পুঁজির রপ্তানিকে একাকার করাকে মেনে নিতে পারেননি | তাঁরা পুঁজি রপ্তানির লক্ষ্য হিসেবে ‘মুনাফা অর্জন’-কেও মেনে নেননি | কিন্তু মার্কসবাদীদের বক্তব্য হল যে, একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ ও ব্যাংক পুঁজির বিনিয়োগের কারণেই একচেটিয়া পুঁজিপতি দেশের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার মধ্যেই নিহিত থাকে সমগ্র বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেওয়ার নীতি। কারণ একচেটিয়া পুঁজিবাদী দেশের মধ্যে রেষারেষিই শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে পরিণত হয় ।