Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না: একটি গভীর উপলব্ধির গল্প

“কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না” গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখা একটি ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর গল্প, যা মানবজীবনের নিঃসঙ্গতা, আশা, এবং হতাশার গল্প তুলে ধরে। গল্পের মূল চরিত্র হলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, যিনি প্রতিদিন পোস্টম্যানের অপেক্ষায় থাকেন, একটা চিঠির আশায়। সেই চিঠি তার জীবনের প্রতি মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রিত করে, এবং তা না আসায় তার জীবনের গভীর হতাশা ক্রমাগত বেড়ে চলে।

গল্পটি পড়ে একজন পাঠক খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন যে, এই চিঠিটি কেবলমাত্র একটি কাগজের টুকরো নয়, এটি কর্নেলের জন্য জীবনের একটি প্রতীক। এটি তার সমস্ত সংগ্রামের, স্বপ্নের, এবং অপেক্ষার প্রতীক। কর্নেল একজন যুদ্ধবীর, কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী জীবনে তাকে রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তার অবসর ভাতার চিঠি আসবে, এই বিশ্বাসই তাকে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু, কর্নেলের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই চিঠির অনুপস্থিতি একটি নিঃসঙ্গ, শূন্য ও হতাশাময় পরিস্থিতির চিত্র এঁকে যায়।

নিঃসঙ্গতার প্রতীক হিসেবে কর্নেল

গল্পের শুরু থেকেই আমরা কর্নেলের একাকীত্ব ও তার জীবনের সংকটময় অবস্থা দেখতে পাই। তার স্ত্রীও একইভাবে হতাশায় ভুগছেন। কর্নেলের সমস্ত আশা একটি চিঠির মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যা আসলে কেবল অর্থ নয়, বরং তাকে সমাজের অংশ হিসেবে আবার স্বীকৃতি দেবে। এই চিঠিটি তার জন্য সামাজিক পরিচয়, মর্যাদা এবং সামগ্রিকভাবে জীবনের প্রতি একটা বিশ্বাসের প্রতীক।

কর্নেল প্রতিদিন চিঠির জন্য অপেক্ষা করেন, কিন্তু সেই চিঠি কখনো আসে না। এই প্রতীক্ষা তাকে ক্রমশ ভেতর থেকে শূন্য করে দেয়। এটি কেবল একাকীত্ব নয়, বরং জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মানুষের যে প্রত্যাশা ও বঞ্চনা থাকে, তার প্রতিফলন।

গার্সিয়া মার্কেস তার লেখায় যেভাবে কর্নেলের এই নিঃসঙ্গতা ও অপেক্ষার চিত্র এঁকেছেন, তা আমাদের নিজেদের জীবনের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। আমরা অনেক সময়ই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অন্যদের কাছে প্রত্যাশা রাখি, সমাজের কাছ থেকে কিছু স্বীকৃতি চাই। কিন্তু অনেক সময়ই তা না পেয়ে আমরা একাকীত্বে ভুগি। কর্নেলের চরিত্রটি এমন একটি প্রতীক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানুষ কিভাবে নিজের আশাকে ধরে রেখে জীবনের অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে।

আশার আলোকরেখা ও হতাশার চক্র

গল্পে কর্নেলের জন্য সবচেয়ে বড় আশার প্রতীক হল সেই চিঠি, যেটির মাধ্যমে তিনি তার অবসর ভাতা পাবেন। কিন্তু এই চিঠি তার কাছে কখনো আসে না। কর্নেলের পুরো জীবন এই চিঠির প্রতীক্ষার মধ্যে আটকে থাকে। এটি আমাদের জীবনের সেইসব মুহূর্তগুলোর প্রতীক, যখন আমরা একটি বিশেষ ঘটনার আশায় বসে থাকি, যা আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করবে বলে মনে করি। কিন্তু সেই ঘটনার বা সমাধানের প্রত্যাশা কেবলই সময়ের সাথে সাথে ম্লান হয়ে যায়।

এই গল্পে কর্নেল যে চিঠির অপেক্ষা করছেন, তা আসলে তার জীবনের সবকিছু। তিনি মনে করেন, সেই চিঠি এলেই তার জীবন পুনরায় নতুনভাবে শুরু হবে। কিন্তু দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর, সেই চিঠি আসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। এর মাধ্যমে লেখক আমাদের জীবনের সেই চক্রের দিকে ইঙ্গিত করছেন, যেখানে আমরা একপ্রকার আশা নিয়ে বেঁচে থাকি, কিন্তু সেই আশা কখনো পূরণ হয় না।

এটি কেবল কর্নেলের অপেক্ষার গল্প নয়, এটি আমাদের সবার গল্প। আমাদের জীবনের প্রতিটি কোণে এমন কিছু আশা বা প্রত্যাশা থাকে, যা হয়তো কখনোই পূর্ণ হবে না। কিন্তু আমরা সেই আশার আলোতে জীবন কাটাতে থাকি, প্রতিদিন নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করি। কর্নেলও তার প্রতিদিনের জীবনের প্রয়োজনে এই চিঠির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। তিনি জানেন না কখন আসবে, কিন্তু তার আশা কখনো মরে না।

রাষ্ট্রের প্রতি কর্নেলের বিশ্বাস ও বঞ্চনা

গল্পের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল কর্নেলের রাষ্ট্রের ওপর থাকা বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসের প্রতি অব্যাহত বঞ্চনা। কর্নেল একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, যিনি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় রাষ্ট্রের সেবায় কাটিয়েছেন। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র তার অবদানের মূল্যায়ন করবে এবং তাকে তার প্রাপ্য দেবে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কেবলই তার জন্য একপ্রকার বিভ্রমে পরিণত হয়েছে।

এই পরিস্থিতি আমাদের অনেককেই ভাবতে বাধ্য করে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে। আমরা প্রায়ই দেখি যে, যারা রাষ্ট্রের সেবা করে, তারা পরবর্তীতে বঞ্চনার শিকার হন। রাষ্ট্র তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কখনোই পূর্ণ হয় না। কর্নেলের গল্পটি কেবলমাত্র একটি ব্যক্তির নয়, বরং সমাজের সেইসব অংশের মানুষদের প্রতীক, যারা রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস রাখে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়ে।

গার্সিয়া মার্কেস এখানে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিষয়ে আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব কি শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি দেওয়া, নাকি সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের দায়িত্বও রয়েছে? কর্নেলের বঞ্চনার মাধ্যমে লেখক আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলে মানুষের জীবনে কতটা গভীর প্রভাব পড়তে পারে।

কর্নেলের জীবনসংগ্রাম: একটি প্রতীকী ধারা

কর্নেলের জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোও একটি বৃহত্তর প্রতীকী ধারা তুলে ধরে। তার জীবন এমন একটি সংগ্রাম, যা কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং মানসিক, সামাজিক এবং নৈতিক দিক থেকেও গভীরভাবে সংকটময়। তার স্ত্রী, যিনি তার সাথে একই ধরনের হতাশায় ভুগছেন, তাদের জীবনের দৈনন্দিন কষ্টগুলি দেখতে পাওয়া যায়।

তাদের দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ক্ষুধা। তারা অর্থের অভাবে খাবার পায় না, এবং তাদের কাছে এমনকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার ক্ষমতাও নেই। এই ক্ষুধা কেবল শারীরিক নয়, এটি মানসিক ও সামাজিক ক্ষুধারও প্রতীক। কর্নেল এবং তার স্ত্রী সমাজের নানান অঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, এবং তারা কেবল একটি চিঠির আশায় দিন কাটাচ্ছেন, যা তাদের জীবনের সবকিছু পরিবর্তন করবে।

গল্পের শেষ দিকে এসে আমরা দেখি কর্নেল একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু তারপরও তার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত আশা কাজ করছে। এই আশা এমনই একধরনের শক্তি, যা তাকে এবং তার স্ত্রীকে প্রতিদিন বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এটি আমাদের জীবনের একটি কঠিন সত্যকে প্রতিফলিত করে—যতই হতাশা আসুক, মানুষ শেষ পর্যন্ত আশার দড়িতে ঝুলে থাকে।

মানব জীবনের পরিপূর্ণতার সন্ধান

“কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না” একটি শক্তিশালী সাহিত্যকর্ম যা মানব জীবনের প্রতীকী দিকগুলোর দিকে গভীরভাবে আলোকপাত করে। কর্নেলের চিঠির জন্য অপেক্ষা আসলে আমাদের সবার জীবনের প্রতীক। আমরা সবাই কোনো না কোনো কিছুর আশায় দিন কাটাই—কখনো তা হতে পারে আর্থিক স্থিতিশীলতা, কখনো সামাজিক সম্মান, আবার কখনো হতে পারে পরিবারের স্বীকৃতি।

মার্কেসের এই গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবজীবন অনেক সময়ই প্রত্যাশার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, এবং সেই প্রত্যাশা যদি পূর্ণ না হয়, তবে আমাদের জীবন কতটা হতাশাময় হতে পারে। কর্নেলের মতো আমাদেরও প্রতিদিনের জীবনে ছোট ছোট আশা থাকে, যা আমাদেরকে টিকিয়ে রাখে, এবং সেই আশাগুলো পূর্ণ না হলে আমরা শূন্যতার মধ্যে ডুবে যাই।

এটি একটি অসাধারণ গল্প, যা নিঃসঙ্গতা, অপেক্ষা, বঞ্চনা এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের অমর আশাকে প্রতিফলিত করে। কর্নেল তার সমস্ত জীবনকে একটি চিঠির অপেক্ষায় কাটিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সেই চিঠি কখনো আসেনি। তার জীবনের এই অপেক্ষা আমাদের সবার জীবনের সেইসব মুহূর্তের প্রতীক, যখন আমরা জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনার আশায় বসে থাকি, এবং সেই আশা কখনোই পূর্ণ হয় না।

সমাপ্তি : “কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না” শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় বা প্রসঙ্গে আটকে থাকা গল্প নয়, এটি এক ধ্রুব সত্যের প্রতীক। এটি আমাদের জীবনের আশা-নিরাশার দোলাচলের প্রতিচ্ছবি। কর্নেলের গল্পের মধ্যে আমরা নিজেদের জীবনের ছায়া দেখতে পাই। এই গল্পের মাধ্যমে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস মানব প্রকৃতির এক গভীর এবং বেদনাদায়ক সত্য তুলে ধরেছেন—মানুষ যতই প্রতিকূলতা ও হতাশার মধ্যে দিয়ে যাক না কেন, আশার আলোতে বেঁচে থাকতে চায়।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More

রাজিয়া খান এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

রাজিয়া খান (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬ – ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১) প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক, যিনি শুধু লেখালেখির জগতে নয়, মঞ্চ নাটকেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তার পুরো নাম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.