Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

প্যারাডাইস লস্ট: এক মহাকাব্যিক কাব্যের অমর ব্যাখ্যা

Paradise Lost Summary and Analysis : “প্যারাডাইস লস্ট” (Paradise Lost) জন মিল্টনের (John Milton) রচিত একটি অমর মহাকাব্যিক কাব্য যা ইংরেজি সাহিত্যকে একটি বিশেষ উচ্চতায় স্থান দিয়েছে। ১৭ শতকের এই মহাকাব্যটি বিশ্ব সাহিত্যে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা আজও আলোচিত হয় তার গভীর চিন্তা, গভীর দার্শনিকতা, এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে। এই মহাকাব্যটি প্রধানত অ্যাডাম এবং ইভের (Adam and Eve) পতন, শয়তান (Satan)-এর বিদ্রোহ এবং স্বর্গের হারানো স্বরূপ নিয়ে রচিত। তবে কেবল একটি ধর্মীয় কাব্য হিসেবে “প্যারাডাইস লস্ট” দেখা ভুল হবে, এটি মানবজাতির গভীরতর অভিজ্ঞতা, স্বাধীন ইচ্ছা, পাপ, এবং শাস্তির বিষয়ে এক অনন্য ব্যাখ্যা দেয়।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা জন মিল্টনের “প্যারাডাইস লস্ট” মহাকাব্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা করবো, কাব্যের মূল বিষয়বস্তু, চরিত্র, শৈলী এবং কাব্যের দার্শনিক ও ধর্মীয় প্রভাবসহ সাহিত্যিক অবদানও তুলে ধরা হবে।

১. জন মিল্টন এবং তার জীবন

“প্যারাডাইস লস্ট” সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করার আগে, এর রচয়িতা জন মিল্টনের জীবনের পটভূমি সম্পর্কে কিছুটা জানানো জরুরি। মিল্টন ছিলেন একজন ইংরেজ কবি, পামফ্লেটিয়ার, এবং বুদ্ধিজীবী, যিনি ১৬০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। মিল্টনের জীবন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সময়কার, যখন ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র ও পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই তীব্রতর হয়েছিল। তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তবুও তার কাব্যিক কর্মশক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস তার সাহিত্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

মিল্টনের সাহিত্য কর্মের মধ্যে, “প্যারাডাইস লস্ট” তার প্রধান কীর্তি। এটি ১৬৬৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং এর পরবর্তী সংস্করণে তিনি আরও কিছু সংশোধন করেন। “প্যারাডাইস লস্ট” লিখতে মিল্টনের গভীর ধর্মীয় চিন্তা ও ক্লাসিক্যাল কাব্যের উপর ভিত্তি করা হলেও, এটি ছিল একটি মৌলিক এবং সাহসী রচনা, যা মানবতার জটিলতা এবং ঈশ্বরের প্রতি তার সম্পর্ককে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছিল।

২. প্যারাডাইস লস্ট: মহাকাব্যের পটভূমি

“প্যারাডাইস লস্ট”-এর মূল বিষয় হল আদম ও ইভের স্বর্গ থেকে পতন। এটি বাইবেলের প্রাথমিক কাহিনীগুলির একটি পুনর্কথন। তবে এটি কেবলমাত্র একটি গল্প নয়; মিল্টন এটি ব্যবহার করেছেন মানবজাতির জন্য গভীরতর প্রশ্নগুলি উপস্থাপন করার জন্য। এই মহাকাব্যটি মোট ১২টি বইয়ে বিভক্ত এবং এর শুরুতেই শয়তানের বিদ্রোহ ও পতনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে অ্যাডাম এবং ইভের পতনের দিকে পরিচালিত করে।

প্রথমে, শয়তান স্বর্গে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তাকে ও তার অনুসারীদের পরাজিত করে নরকে নির্বাসিত করা হয়। এরপর, শয়তান মানুষের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে, পৃথিবীতে আসে এবং আদম ও ইভকে পাপের পথে পরিচালিত করে। তাদের নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার মাধ্যমে, মানবজাতির উপর পাপের বোঝা চাপানো হয় এবং তারা স্বর্গ হারায়।

৩. শয়তান চরিত্রের গভীরতা

“প্যারাডাইস লস্ট”-এ শয়তান চরিত্রটি এক বিশেষভাবে বিশ্লেষণযোগ্য। প্রথাগতভাবে শয়তানকে মন্দের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু মিল্টনের শয়তান একটি বহুমাত্রিক এবং জটিল চরিত্র। সে কেবল মন্দের প্রতীক নয়, বরং একজন বিদ্রোহী, একজন স্বাধীনতাপ্রেমী এবং একজন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব।

মিল্টনের শয়তান চরিত্রের একটি বিখ্যাত উক্তি হল, “Better to reign in Hell than serve in Heaven” অর্থাৎ নরকে রাজত্ব করা স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে ভালো। এই উক্তি শয়তানের বিদ্রোহী মানসিকতা এবং তার স্বাধীনতা প্রেমের প্রতিফলন ঘটায়। শয়তান নিজেই জানে যে সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে না, তবুও সে তার স্বাধীন ইচ্ছার জন্য লড়াই চালিয়ে যায়। এই কারণে অনেক সমালোচক শয়তানকে “হিরো” হিসেবেও দেখেছেন, যদিও সে আধ্যাত্মিকভাবে বিপথগামী।

৪. আদম ও ইভের ট্র্যাজেডি

“প্যারাডাইস লস্ট”-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগঘন অংশ হল আদম ও ইভের পতন। মিল্টন তাদের পতনকে কেবল একটি পাপের প্রতীক হিসেবে দেখাননি, বরং এটিকে মানবজাতির পরীক্ষার একটি অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আদম এবং ইভের পাপ তাদের অবাধ্যতার ফলে ঘটেছে, যা কেবল তাদেরই নয়, সমগ্র মানবজাতিকে একটি নতুন বাস্তবতায় নিয়ে যায়—পাপ এবং শাস্তির বাস্তবতা।

ইভের কৌতূহল এবং স্বাধীন ইচ্ছা তাকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার দিকে পরিচালিত করে, আর আদম প্রেমের কারণে সেই ফল গ্রহণ করেন। এই ঘটনাটি মানবজাতির ইতিহাসে পাপের সূচনা এবং এর ফলে যে শাস্তি আসে, সেটির প্রতিফলন। মিল্টনের মতে, পাপ এবং পতন কেবল ঈশ্বরের শাস্তি নয়, বরং এটি মানব জাতির স্বাধীন ইচ্ছার ফল।

৫. মুক্তির আশা: প্যারাডাইস রেগেইনড

যদিও “প্যারাডাইস লস্ট”-এর মূল কাহিনী হল পতনের গল্প, তবে এর শেষ পর্যন্ত মুক্তির আশাও প্রতিফলিত হয়েছে। মিল্টন স্পষ্টভাবে দেখান যে ঈশ্বরের পরিকল্পনা কেবল মানবজাতির পতনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর মধ্যে মুক্তির সম্ভাবনাও রয়েছে। ঈশ্বরের আগাম জ্ঞানের ভিত্তিতে, তিনি আগে থেকেই জানতেন যে আদম এবং ইভ পাপ করবে, এবং তাদের পরিত্রাণের জন্য তিনি মসীহ (Jesus Christ)-এর আগমন নিশ্চিত করেন। মিল্টন কেবল একটি ট্র্যাজেডি কাহিনী নয়, বরং এক মহাকাব্যিক উদ্ধার পরিকল্পনাকেও তুলে ধরেন।

মিল্টনের এই কাজের মাধ্যমে তিনি তার সময়ের সমাজ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসগুলির প্রতি এক গভীর প্রশ্ন তুলেছেন। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এবং ঈশ্বরের কর্তৃত্বের মধ্যে যে সংঘাত, সেটি কীভাবে সমাধান হতে পারে, সে বিষয়ে তিনি তার পাঠকদের চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

৬. শৈলীর নান্দনিকতা এবং সাহিত্যিক অবদান

“প্যারাডাইস লস্ট” মহাকাব্যটি সাহিত্যে তার বিপুল প্রভাব ফেলেছে তার শৈলীর কারণে। মিল্টনের মহাকাব্যিক ভাষা এবং তার বর্ণনামূলক দক্ষতা তাকে অন্যান্য সমসাময়িক কবি থেকে পৃথক করেছে। এই মহাকাব্যটি লিখিত হয়েছে “ব্ল্যাঙ্ক ভার্স”-এ, যা ছিল ছন্দযুক্ত কিন্তু অসংলগ্ন কাব্যিক শৈলী। এই শৈলীতে মিল্টন একটি বৃহত্তর ভাষা ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, যা তার গভীর চিন্তা এবং ব্যাখ্যা প্রকাশে সহায়ক হয়েছে।

মিল্টনের কাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তার ধ্রুপদী এবং বাইবেলীয় অনুপ্রেরণা। তিনি ক্লাসিক্যাল কাব্যের আদলে তার মহাকাব্যটি গড়ে তুলেছিলেন এবং একই সঙ্গে বাইবেলের মূল বিষয়বস্তুগুলিকে তার কাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই অনন্য সংমিশ্রণ তার কাব্যকে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে।

৭. প্যারাডাইস লস্টের দার্শনিক ও ধর্মীয় প্রভাব

“প্যারাডাইস লস্ট” কেবল একটি সাহিত্যিক কাজ নয়, বরং এটি দার্শনিক এবং ধর্মীয় প্রশ্নগুলিকেও গভীরভাবে উপস্থাপন করে। মানবজাতির স্বাধীন ইচ্ছা, পাপ এবং শাস্তি, এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও বিচার নিয়ে মিল্টনের এই কাজ সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসকে নতুন করে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে, শয়তানের বিদ্রোহ এবং আদম ও ইভের পতন কেবল বাইবেলের কাহিনী নয়, এটি এক জটিল দার্শনিক বিতর্কের অংশ।

মিল্টন এই মহাকাব্যটির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বরের পরিকল্পনা কেবল শাস্তি দেওয়া নয়, বরং মানব জাতিকে মুক্তির পথে পরিচালিত করা। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার মধ্যে যে সংঘাত, সেটি কি সত্যিই সমাধানযোগ্য? এই প্রশ্নগুলি “প্যারাডাইস লস্ট” তার পাঠকদের সামনে রেখে গেছে।

৮. সমাপ্তি: প্যারাডাইস লস্টের উত্তরাধিকার

“প্যারাডাইস লস্ট” কেবল মিল্টনের শ্রেষ্ঠ রচনা নয়, এটি বিশ্ব সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। এর গভীর চিন্তা, জটিল চরিত্র এবং মহাকাব্যিক ভাষা এটিকে এক অনন্য সাহিত্যিক সৃষ্টি করেছে। আজও “প্যারাডাইস লস্ট” পাঠকদের মুগ্ধ করে, তাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে এবং মানবজাতির জটিলতাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখায়।

জন মিল্টন এই মহাকাব্যের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, পতনের মধ্যেও মুক্তির আশা রয়েছে, পাপের মধ্যেও ঈশ্বরের অনুগ্রহ রয়েছে, এবং মানবজাতির ইতিহাস কেবল শাস্তির কাহিনী নয়, বরং এটি এক মুক্তির যাত্রাও। “প্যারাডাইস লস্ট” মানবতার এক অনন্য প্রতিচ্ছবি, যা আজও আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে চলেছে।

উপসংহার : জন মিল্টনের “প্যারাডাইস লস্ট” সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য কীর্তি। এটি কেবল বাইবেলের কাহিনী পুনর্কথন নয়, বরং মানবজাতির গভীর দার্শনিক ও ধর্মীয় প্রশ্নগুলিকে কেন্দ্র করে একটি মহাকাব্যিক রচনা। শয়তানের বিদ্রোহ, আদম ও ইভের পতন, এবং ঈশ্বরের মুক্তির পরিকল্পনা মিল্টনের এই কাজের মূল বিষয়বস্তু, যা মানবজাতির সীমাহীন কৌতূহল এবং অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটায়।

“প্যারাডাইস লস্ট” আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে, এবং এটি চিরকালই ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবে গণ্য হবে। এই মহাকাব্যের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি চরিত্র এবং প্রতিটি দার্শনিক তত্ত্ব আমাদেরকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে মানবজীবনের গভীরতর প্রশ্নগুলি নিয়ে চিন্তা করতে শেখায়।

এটি কেবল একটি কবিতার বিশ্লেষণ নয়, এটি একটি দার্শনিক বিতর্কের সূচনা, যা কেবল সাহিত্যিকদেরই নয়, বরং ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক এবং সাধারণ পাঠকদের মনেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। “প্যারাডাইস লস্ট” কেবল ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অর্জন করেনি, বরং এটি মানবজাতির বোধ এবং অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে পরিবর্তিত করেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.