রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন, বৈষ্ণবদের গান কি কেবল দেবতার উদ্দেশ্যেই রচনা? তিনি মনে করেন, এটি সত্য নয়, তাই হয়তো তাঁর বিস্ময়। কবি বিশ্বাস করেন না যে, শ্রীরাধার পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান, বিরহ-মিলন, যমুনা নদীর তীর, চারি চক্ষুর মিলন—এসব কেবল কল্পলোকের বিষয়। ভক্ত কবিরা ধ্যানের মাধ্যমে এসব চিত্র দেখেননি। বৈষ্ণব কবিদের সৃষ্ট তথাকথিত স্বর্গীয় প্রেম কি মর্ত্যের নরনারীর আবেগময় প্রেমের তৃষ্ণা মেটাতে পারে না?
কবির প্রশ্ন, বৈষ্ণব কবিদের গীতিসুধা কি দেবতার উদ্দেশ্যে ভক্তদের উপলব্ধি থেকেই প্রবাহিত হয়েছে? বৈষ্ণব কবিদের হৃদয় থেকে উৎসারিত গীতি শুনে কি পৃথিবীর নরনারী পুলকিত হতে পারবে না? তারা কি কল্পনা করতে পারবে না যে, দেবতার সংগীত পৃথিবীর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে? দেবতা যেসব স্থানে গেছেন, তা চিরতীর্থ হয়ে গেছে।
এবার রবীন্দ্রনাথ মূল কথায় আসলেন। তিনি বললেন, বৈষ্ণব গীতি কল্পলোকের সৃষ্টি নয়, এর উৎস ভক্তির অন্তঃস্থল নয়। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন—
“সত্য ক’রে কহো মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিল এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহতাপিত?”
রবীন্দ্রনাথ বলেন, বৈষ্ণব কবিতার ভিত্তি পৃথিবীর নরনারীর প্রেমলীলা। তিনি বৈষ্ণব কবিকে প্রশ্ন করেই থেমে যাননি, বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন—
“হেরি কাহার নয়ান।
রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?
বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে
কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,
আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে?”
কবিরা তাঁদের জীবনের প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকেই দেবতার প্রেম সংগীত রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ আরও স্পষ্টভাবে বলেন, দেবতার প্রেম সংগীত মর্ত্যের মানুষের ছায়ায় রচিত—
“রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
চুরি করি লইয়াছ কার মুখ, কার
আঁখি হতে!”
রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, পৃথিবীর নরনারীর প্রেমলীলা থেকেই রাধা কৃষ্ণের প্রেমগীতি রচিত হয়েছে। প্রেমগীতিতে মানুষের অধিকার আছে, তা কেবল দেবতার হতে পারে না। যার ভিত্তি পৃথিবীর মানুষ, সেই গীতের ওপর মানুষের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায় না।
“আজ তার নাহি অধিকার
সে সংগীত! তারি নারীহৃদয়-সঞ্চিত,
তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্ছিত
চিরদিন!”
আমারই সম্পদ থেকে আমাকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই।
রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়ে দেন যে, পৃথিবীর নরনারীর প্রেমলীলা থেকে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-সংগীত রচিত হয়েছে, তাই তাতে পৃথিবীর মানুষের যেমন অধিকার আছে, তেমনি দেবতার উদ্দেশ্যে প্রেমিক সেই সংগীত থেকে ইচ্ছামত আহরণের অধিকারও রয়েছে তাঁদের—
“সমুদ্রবাহিনী সেই প্রেমধারা হতে
কলস ভরিয়া তারা লয়ে যায় তীরে
বিচার না করি কিছু আপন কুটিরে
আপনার তরে।”
তাই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, বৈষ্ণব কবিদের রচিত রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা কেবল দেবতাদের নয়—পৃথিবীর নরনারীরও তাতে সম্পূর্ণ অধিকার আছে।