কবির কল্পনায়, অনেক সময় একটি তত্ত্ব বা ভাবগত সত্যকে জীবন্ত করে তোলার জন্য কবিকে প্রকৃতি বিষয়ক ঘটনার মাধ্যমে রূপকের আশ্রয় নিতে হয়। তাঁর চিন্তাকে বহুমনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সোনার তরী’ কবিতায় নাম ভূমিকাতেই রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। তরী কখনও সোনার হয় না—রূপকের ছলে ‘সোনার তরী’ নাম রেখে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর কাব্য সম্পদ বিশ্বজনের কাছে বহন করার জন্যই এই ‘সোনার তরী’ আবশ্যক। তরীটি স্বর্ণের দ্বারা নির্মিত কারণ কবির বিশ্বাস, তাঁর কাব্যসম্ভার সার্থকতার দিক থেকে অত্যন্ত মূল্যবান, যা নিয়ে কবির মনে কোনো সংশয় নেই। তাই তিনি তাঁর কাব্য সম্ভার বহনকারীকে ‘সোনার তরী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। রূপকের মাধ্যমে তিনি তাঁর কাব্য সম্ভারকে সোনার ধানে রূপান্তরিত করেছেন।
এরপর কবিতার প্রতিটি স্তবকে রয়েছে রূপকের ছড়াছড়ি। সমগ্র কবিতায় রবীন্দ্রনাথ একটি কৃষক ও মাঝির রূপকের মাধ্যমে চিত্র এঁকেছেন। কঠোর পরিশ্রমে কৃষকটি তার খেতে সোনার ধান ফলিয়েছে। সেই ধান কেটে চাষি অপেক্ষা করছে একটি নৌকার আশায়। তার ইচ্ছা সোনার ধানগুলো ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের মরাই-এর মধ্যে সঞ্চয় করবে—এটাই তার আনন্দ। মাঝি এসে চাষির আহ্বানে তীরে নৌকা ভিড়ায়, আর চাষি আনন্দের সঙ্গে ধানগুলো নৌকায় তোলে। কিন্তু মাঝি তাকে শূন্য নদীর চরে একা রেখে চলে যায়। চাষির আর্তনাদ শূন্য নদীর তীরে তার একাকীত্বকে কেন্দ্র করেই মূর্ছিত হয়।
এখানে কবি হচ্ছেন সেই চাষি, যিনি সমস্ত জীবন ধরে তাঁর কাব্যখেতে ফসল ফলিয়েছেন, আর মাঝি হচ্ছে মহাকাল। মানুষ ভাবে সে তার সুকর্মের মাধ্যমে বিশ্বে একটি নাম রেখে যাবে, কিন্তু মহাকালের রূপে মাঝি কবিকে প্রত্যাখ্যান করে, আর চাষির আর্তনাদ কবির আর্তনাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
‘সোনার তরী’ কবিতায় কবি এই রূপকের মাধ্যমে এ কথাই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। আরও কয়েকটি রূপক যেমন, ‘শূন্য নদীর চর’, ‘একখানি ছোটো খেত’, ‘চিনি উহারে’ প্রভৃতিও এই কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে। সবশেষে, ‘সোনার তরী’ কবিতার মূল রূপক ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়: কৃষক হল মানুষের প্রতীক, আর কৃষকের খেত হল আয়ুর দ্বারা সীমাবদ্ধ মানবজীবন। পদ্মার স্রোতকে বলা যায় কালস্রোত, সোনার ধান হচ্ছে মানুষের শ্রমের ফল, আর নাবিক হচ্ছে মহাকাল।
এই কবিতাকে অনেকে সৌন্দর্যতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যা করেছেন। সোনার তরী হচ্ছে বিশ্বের অখণ্ড আদর্শ সৌন্দর্য, নদী হচ্ছে কাল প্রবাহ, মাঝি সেই সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, ধান খণ্ড সৌন্দর্যের সঞ্চয়, আর খেত জীবনের ভোগবহুল কর্মক্ষেত্র। সৃষ্টির প্রবাহমান নদীতে সৌন্দর্যের এই তরণী ভেসে চলেছে।