‘সোনার তরী’ কবিতাটি নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কবিতাটি লিখিত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পরে এর অর্থ নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয়, এবং প্রায় ১৭ বছর পরে কবি নিজেও কবিতাটির একটি ব্যাখ্যা দেন। অনেকের মতে, কবি নিজের ব্যাখ্যায় কবিতাটিকে আরও জটিল করে তুলেছেন।
রবীন্দ্রজীবনীকার শ্রদ্ধেয় প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “’সোনার তরী’ কবিতাটিকে যদি আমরা কেবল একটি চিত্র হিসেবে দেখতাম, তবে কোনো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু লোকে শুধু রসে তৃপ্ত হয় না, তারা অর্থ চায়, ভোজনের পর দক্ষিণার মতো। তরী কখনো সোনার হয় না এবং সোনার নৌকায় কোনো চাষি ধান কাটতে যায় না। সুতরাং কবিতায় চিত্র ও নামকরণ, উভয়ই অবাস্তব পরিকল্পনার মতো।” শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে ব্যাখ্যাকারদের প্রতি ব্যঙ্গের ভাবটি স্পষ্ট বোঝা যায়।
শ্রাবণের মেঘলা দিনে যে চিত্রটি কবির চোখে ধরা দিয়েছিল, তা প্রকাশ পায় ফাল্গুনে। কবির ব্যাখ্যা এরূপ—“মানুষ পুরো জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের ক্ষেতটুকু দ্বীপের মতো—চারপাশে অব্যক্ত দ্বারা বেষ্টিত, সেই একটু জায়গাতেই তার সব ব্যস্ততা।” প্রতিটি মানুষই ফসল ফলাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথও ব্যতিক্রম নন। যখন ফসলের স্তূপ জমা হয়—
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
এই ফসল কবির চিত্তের সৃষ্টি—এ দান অনন্যসাধারণ। তাই একে সোনার ধান বলা চলে। সোনা যেমন বহুমূল্য এবং উজ্জ্বল, কবির সৃষ্ট ফসলও তেমনি উজ্জ্বল এবং মূল্যবান। তাই একে বলা হয়েছে সোনার ধান। রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা যখন শেষ হয়, তখন সেই অপূর্ব সম্পদকে গোলায় ভরতে হয়। এ সম্পদ চিরস্থায়ী করার মতো জিনিস। তখন নেয়ে আসে সেই সোনার ধান নিয়ে যাওয়ার জন্য—
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
এই নেয়ে কে? তাঁর সঙ্গে কবির স্পষ্ট পরিচয় হয়নি—চেনা বলে মনে হয়। ইনি কবির জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। সুতরাং তাঁর তরী তো সোনারই হবে—সুন্দর, প্রদীপ্ত এবং অমূল্য। কবি তাঁকে আহ্বান করেন তাঁর কাটা ‘রাশি রাশি ভারা ভারা’ সোনার ধান নিয়ে যাবার জন্য—
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কুলেতে এসে।
কবি তাঁর নিজের সৃষ্ট সব কিছু তুলে দিবেন তরীতে—এতদিন এই সম্পদ নিয়েই তিনি ছিলেন বসে। কবি ভাবলেন, এবার পাবেন ঠাঁই। তাঁর সোনার ধানে পূর্ণ সোনার তরীতে তাঁর স্থান হবে। কিন্তু কবির ঠাঁই হল না সোনার তরীতে। তাঁকে এখনও সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে—‘যাহা ছিল নিয়ে গেছে সোনার তরী।’
অপূর্ব সম্পদ বলেই তা সোনা, এবং তা বয়ে নিয়ে যাবার জন্য জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আসেন। স্বভাবতই তাঁর তরীটিও অপূর্ব, তাকেই বলা হয় সোনার তরী। সাধারণ অর্থে সোনা নয়—এ সোনা রূপক অর্থ বহন করে।
তাই রূপক অর্থে ‘সোনার তরী’ নামকরণ সার্থক হয়েছে।