রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে যত ভাববৃত্ত গড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে ‘জীবন দেবতাবাদ’ অন্যতম প্রধান। ‘বঙ্গবাসী’ কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গভাষার লেখক’ (১৩১২) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে এ বিষয়ে অনেক কথাই বলেছেন। রবীন্দ্র সমালোচকবৃন্দও যথেষ্ট আলোকপাতের চেষ্টা করেছেন। কবি জীবনদেবতা সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সামান্য উদ্ধৃতি এখানে উৎকলিত করি।
(ক) “যিনি আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ নিয়ে আমার জীবনকে রচনা করে চলেছেন, তাঁকেই আমি আমার কাব্যে ‘জীবন দেবতা’ নাম দিয়েছি। তিনি যে কেবল আমার এই ইহজীবনের সমস্ত খণ্ডকে ঐক্যদান করে বিশ্বের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য স্থাপন করছেন, আমি তা মনে করি না—আমি জানি, অনাদিকাল থেকে বিচিত্র বিস্মৃত অবস্থার মধ্যে তিনি আমাকে আমার এই বর্তমান প্রকাশের মধ্যে উপনীত করেছেন; সেই বিশ্বের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অস্তিত্বধারার বৃহৎ স্মৃতি তাঁকে অবলম্বন করে আমার অগোচরে আমার মধ্যে রহিয়াছে, সেইজন্য এই জগতের তরুলতা পশুপক্ষীর সঙ্গে এমন একটা পুরাতন ঐক্য অনুভব করতে পারি—সেইজন্য এত বড় রহস্যময় প্রকাণ্ড জগৎকে অনাত্মীয় ও ভীষণ বলে মনে হয় না।”
(খ) “যে শক্তি আমার জীবনের সমস্ত সুখদুঃখকে সমস্ত ঘটনাকে ঐক্যদান করে, তাৎপর্য জ্ঞান করছে, আমার রূপান্তর—জন্মজন্মান্তরকে এক সূত্রে গাঁথছে, যার মধ্য দিয়ে বিশ্বচরাচরের মধ্যে ঐক্য অনুভব করছি, তাহাকেই জীবন দেবতা নাম দিয়েছিলাম।
…নিজের জীবনের মধ্যে এই আবির্ভাবকে অনুভব করা গেছে যে আবির্ভাব অতীতের মধ্যে থেকে অনাগতের মধ্যে প্রাণের পালকে প্রেমের হাওয়া লাগিয়ে আমাকে মহাকাল নদীর নতুন নতুন ঘাটে বহন করে নিয়ে চলেছেন, সেই জীবন দেবতার কথা আমি বললাম।”
রবীন্দ্রনাথের এই জীবন দেবতা বিষয়ক তত্ত্ব ও তর্ক কণ্টকিত আলোচনার মধ্যে আমরা যেতে চাই না। রবীন্দ্র প্রদর্শিত দিগ্দর্শনের পথ অনুসারে আমরাও বলতে চাই, যে শক্তি জন্মজন্মান্তর ধরে কবিজীবনকে পরিচালিত করে এসেছে, তিনি জীবন দেবতা। খণ্ড থেকে অখণ্ডের মধ্যে, সীমা থেকে অসীমের মধ্যে, ব্যক্তিচেতনা থেকে বিশ্বচেতনার মধ্যে কবিকে এই জীবন দেবতা পরিচালিত করে চলেছেন, নানা কাব্যসৃষ্টির প্রেরণা দিয়ে চলেছেন এই জীবন দেবতা।
‘সোনার তরী’র কালে পদ্মা অঞ্চলে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সাহচর্য পেয়েছিলেন নিবিড়ভাবে, সেই প্রকৃতি নিয়ে গেল বিচিত্র সৌন্দর্যের রাজ্যে—বিশ্বপ্রকৃতির অনন্ত সৌন্দর্য ভাণ্ডারে। শৈবালে-শাদ্বলে তৃণে শাখায় বল্কলে পত্রে’, ‘স্বর্ণশীর্ষে আনমিত শস্যক্ষেত্রে, ‘সুধাগন্ধে মধুবিন্দুভারে’ পূর্ণ পুষ্পদলে, তরঙ্গিত মহাসিন্ধুনীরে, সুদূর্গম মরুদেশে, হিমানী সমাদৃত শৈলমালায়, গগন অরণ্যভূমিতে, সাধারণ ধীরব পল্লিতে, আরব-তিব্বত-পারস্য জাপান ও চিনের মানুষের মাঝে রবীন্দ্রনাথ লাভ করলেন বিশ্বসৌন্দর্যবোধ, বিশ্বের সঙ্গে ঐক্যানুভূতি,— উপলব্ধি করলেন জীবন দেবতার লীলা। এককথায়, ‘সোনার তরী’ পর্বেই প্রকৃতি জীবন ও মানব জীবনের গভীর গহনে প্রবেশ ঘটেছে কবির।
‘সোনার তরী’ কবিতায় যে মাঝিকে গান গাইতে গাইতে এসে কবির সোনার ফসল তুলে নিয়ে যেতে দেখি, ‘মহাকাল নদীর নতুন ঘাটে ঘাটে’ দেখি কবিকে ফেলে যেতে একক কর্মক্ষেত্রে বিষাদের মধ্যে তিনি কবির জীবন নিয়ামক। ‘মানস-সুন্দরী’তে সমুদ্রের মাঝখানে ‘কর্ণধার’ হয়ে যিনি সুন্দর তরণীখানি ভাসিয়েছেন—তিনি কবির ‘জীবনের অধিষ্ঠাত্রীদেবী’। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় যে সুন্দরী মোহিনী নাবিকা কবির জীবন প্রভাতেই কবিকে নিয়ে অকূল-সমুদ্রে যাত্রা শুরু করেছিলেন তাঁর তরুণীতে নির্বাক মধুরহাস্যে—তিনি কবির জীবন পরিচালিকা।
‘সোনার তরী’র মাঝি, ‘মানস সুন্দরী’র ‘কর্ণধার’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র নাবিকা রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা; তিনি কখনও পুরুষ, কখনও রমণী।
এই রবীন্দ্র-জীবনী-নিয়ামক শক্তি চিত্রা কাব্যগ্রন্থে ‘অন্তর্যামী’, ‘জীবনদেবতা’। ‘অন্তর্যামী’ কবিতায় প্রকাশ—রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা রচনা করেন তখন তাঁর মনে হয় তিনিই তাঁর কবিতায় রচয়িতা, তাঁর মনে হয় তিনিই কবিতায় ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তা-অনুভূতি সমূহ প্রকাশ করলেন, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কবি পরে লক্ষ্য করে দেখেন তাঁর কবিতার মধ্যে, রচনার মধ্যে আছে তাঁর কাঙ্ক্ষিত ও আত্মগত বিষয় বস্তুকে অতিক্রমকারী কথা–সম্পূর্ণ নতুন কথা যা হয়েছে বিশ্বজনীন ও চিরন্তন। অন্তর্যামীকে তিনি কবিতামুখে প্রশ্ন করেন—
অন্তর মাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
বলিতেছিলাম বসি একধারে
আপনার কথা আপনজনারে,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
ঘরের কাহিনি যত ;
তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে
ডুবায়ে ভাষায় নয়নের জলে,
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
গড়িলে মনের মতো।
‘জীবনদেবতা’ কবিতায় কবি তাঁর জীবন নিয়ামককে পুরুষ ও প্রেমিক রূপে সম্বোধন করে জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখ নিবেদন করেছেন—
ওহে অন্তরতম,
মিটেছে কি তব সকল তিয়াস আসি অন্তরে মম!
দুঃখসুখের লক্ষ্য ধারায়
পাত্র ভরিয় দিয়েছি তোমায়
নিঠুর পীড়নে নিঙাড়ি বক্ষ দলিত দ্রাক্ষাসম।
‘চিত্রা কাব্যগ্রন্থ’ রবীন্দ্র লেখনীতে জীবনদেবতা ধারায় রচিত আরও দুটি কবিতা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে—একটি ‘সাধনা’, অন্যটি ‘সিন্ধুপারে’। ‘সাধনা’তে দেখি রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রেরণাদাত্রী সৌন্দর্যলক্ষ্মী জীবনদেবতার চরণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ব্যর্থ সাধনা, অকৃতকার্য, অকথিত বাণী, অগীতগান ও বিফল বাসনারাশিকে’ সকল সার্থকতায় মণ্ডিত করার জন্য উৎসর্গ করেছেন। ‘সিন্ধুপারে’র অবগুণ্ঠনবর্তী অশ্বারোহিণী রমণী কবির জীবনদেবতা, যার সঙ্গে জন্মজন্মান্তর ধরে সুখ-দুঃখ ভাঙা-গড়ার কত না খেলা জড়িত হয়ে আছে। কবি লিখলেন—
“এখানেও তুমি জীবনদেবতা”, কহিনু নয়নজলে।
সেই মধুমুখ, সেই মৃদু হাসি, সেই সুধাভরা আঁখি,
চিরদিন মোরে হাসালে কাঁদালে, চিরদিন দিল ফাঁকি।
খেলা করিয়াছ নিশিদিন মোর সব সুখে সব দুঃখে,
এ অজানাপুরে দেখা দিল পুনঃ সেই পরিচিত মুখে।
‘জীবনদেবতা’ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রবীন্দ্র সমালোচক উপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যবান অভিমত আমরা এখানে উল্লেখ করি— “নিখিল বিশ্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচ্ছুরিত যে সৌন্দর্য, তাহার মূলগত ঐক্য একটি পরিপূর্ণ মূর্তি ধরে তাঁহার কবিকর্মকে পরিচালিত করিয়াছে, এই স্বতন্ত্র সত্তার অনুভূতি—এই বিশ্বজীবনের অখণ্ড সৌন্দর্যের অনুভূতি—তাঁহাকে নিরন্তন নব নব রূপ ও রসসৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা জোগাইয়েছে। স্ব স্ব সৌন্দর্যের অনুভূতির এক অভিনব রূপায়ণ কবির জীবন দেবতা। এই অনুভূতিই তাঁহার সমস্ত কাব্যসৃষ্টির মূল উৎস—তাঁহার রসলক্ষ্মী—তাঁহার অন্তরবিহারী কবিপুরুষ— তাঁহার শিল্পীসত্তার জন্মদাতা, পোষণকর্তা ও একপ্রকার রূপান্তর মাত্র। এই জীবন দেবতার অনুভূতিতে কবির সৌন্দর্য-সাধনা ও রস-সাধনা চরম স্তরে পৌঁছিয়াছে, এই অনুভূতিই তাঁহার রসজীবনে—শিল্পজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তিতে পরিণত হইয়াছে।”