রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ পর্ব নানা কারণে বৈশিষ্ট্যযুক্ত। রবীন্দ্র কাব্যে রূপক ব্যবহার এই সময় হতে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সমালোচক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য রূপক ও রবীন্দ্রনাথের রূপক রচনা সম্পর্কে যে মূল্যবান অভিমত দিয়েছেন, তা হল— “রূপকের সাহায্যে ভাব অনেকটা তত্ত্বের রূপ প্রাপ্ত হয়; অনুভূতির স্পর্শ না থাকায় প্রকৃত কাব্যরসের সঞ্চার হয় না। কাঠামো বা বহিরঙ্গে হয়তো স্বতন্ত্র রসসঞ্চার হতে পারে, কিন্তু বহিরাবরণ ও প্রাণবস্তুর স্বাভাবিক সম্মেলন না হওয়ায় সমগ্র প্রাণ সঞ্চার হয় না এবং এতে প্রকৃত কাব্যরসের আস্বাদ পাওয়া যায় না।”
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রূপক রচনা, অনেক ক্ষেত্রেই, মনোজগৎ ও বহির্জগতের ভাব ও রূপের একটা সামঞ্জস্য হওয়ায়, রসময় কাব্যকলায় পর্যবসিত হয়েছে। রূপক ও সংকেত রচনা রবীন্দ্র মানসের একটা নিজস্ব প্রবণতা। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর ভাব সত্যকে রূপদান করে সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘সোনার তরী’, ‘দুই পাখি’, ‘পরশপাথর’, ‘ঝুলন’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ মানস সুন্দরী প্রকৃতি রূপক শ্রেণির রচনার অন্তর্গত।
সোনার তরী কাব্যের প্রথম ও নাম ভূমিকার কবিতা ‘সোনার তরী’তে রূপক আছে। কালপ্রবাহ তার তীব্র কুটিল বেগে এ জগতের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, দেয় ডুবিয়ে। রক্ষা করে মাত্র গৌরবমণ্ডিত কর্মকে। আপন আপন কর্ম-ভূমিতে নানা বাধা বিপত্তির মধ্যে মানুষ যে কর্মাবলি সমাপন করে, জীবন নিয়ামক শ্রেষ্ঠ কর্মকেই কাল প্রবাহের মধ্যে রক্ষা করেন, গ্রহণ করেন; রক্ষা করেন না, গ্রহণ করেন না তার কর্মীকে। এই ভাব সত্য বা তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ কৃষক, খরবাহিনী ভরা নদীর তীরবর্তী ছোট খেত, গর্জন মুখের ঘন বর্ষা, সোনা ধান, গান গেয়ে আসা মাঝি, সোনার তরীতে সোনাধান নিয়ে চাষিকে শূন্য নদীতটে শ্রবণ বর্ষার মধ্যে ফেলে দিয়ে যাওয়ার রূপে প্রকাশ করেছেন।
‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘দুই পাখি’ রচনাটি রূপক শ্রেণির।–মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা দেখা যায়। এক সত্তা সংসারের সংস্কারে প্রথা অভ্যাসে বশবর্তী বাস্তব পৃথিবীর সীমাবদ্ধ গন্ডিতে আবদ্ধ, অন্য সত্তা সংসারের সংস্কার থেকে বহির্ভূত, প্রথাবদ্ধ অভ্যাস থেকে মুক্ত, বাস্তব পৃথিবীর সীমাবদ্ধতার বাইরে, অসীমে বিচরণশীল। এই দুই সত্তার মানুষের মিলনেই সার্থকতা। এটি এক ভাব সত্য। সীমা ও অসীম, বিষয়াসক্ত বন্ধ এবং অনাসক্ত মুক্ত, পুরুষ ও প্রকৃতি, শ্রেয় ও প্রেয় প্রভৃতি তত্ত্বকথাও এতে আছে। এই ভাব সত্য বা তত্ত্বকথাকে রবীন্দ্রনাথ খাঁচার পাখি, বনের পাখি এবং উভয়ের কাছাকাছি আসার ইচ্ছা, অক্ষমতা ইত্যাদির রূপে প্রকাশিত করেছেন। কবির ব্যক্তিগত জীবনে প্রকৃতির নিবিড় স্পর্শলাভের আকুলতা ও না আসতে পাবার ব্যথাও ‘দুই পাখি’র রূপে প্রকাশিত হয়েছে।
‘সোনার তরী’ কাব্যের একটি রূপকাঙ্গিক কবিতা হল ‘পরশ পাথর’।– জগৎ ও জীবনকে তুচ্ছ করে দিয়ে, বাস্তব সংসারের হাসি-আশু, সুখ-দুঃখ প্রভৃতিকে গণ্য না করে অলৌকিক সৌন্দর্য, অবাস্তব আদর্শ, অনির্দেশ্য সম্পদের জন্য শরীর ও সময় ধ্বংসকারী ব্যর্থ প্রয়াস কবিতার ভাববস্তু। এই ভাবসত্যকে সমুদ্রের অসীম বিস্তৃত বালুকাবেলায়— কোনো এক ক্ষ্যাপার স্পর্শমাণিক খোঁজার ব্যর্থতার রূপে প্রকাশিত হয়েছে।
‘সোনার তরী’ কাব্যনিবদ্ধ একটি বিশেষ রূপক রচনা ‘ঝুলন’। বৃন্দারণ্যে রাধাকৃষ্ণের অলৌকিক লীলাসমুচ্চয়ের অন্যতম ঝুলন-উৎসবের নামে কবিতাটির শিরোনাম হলেও এর ভাবসত্য হল—রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শদিতে সুবলিত বিলাসাতিশয্যময় নানা সুখভোগের আবেশে, কোমল-কান্ত কল্পনা-ঋদ্ধ ভাবসমূহে কবিপ্রাণ হয়েছে বিবশ, বিকল। কবিসত্তা সংঘাত-প্রতিঘাতে কঠোর সমস্যাসমূহ থেকে সরে গেছে বহু দূরে, হারিয়ে ফেলেছে দৃঢ়তা, কর্তব্যনিষ্ঠা। কবি তাঁর ব্যক্তিত্বকে, সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে চান। এই ভাবসত্যকে প্রলয় ঝঞ্ঝা-পরিবেশে কবি ও তাঁর প্রাণবধূর ঝুলন খেলার রূপে প্রকাশ করা হয়েছে।
‘সোনার তরী’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘সোনার তরী’র মতো শেষ কবিতা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ও রূপকাঙ্গিকে রচিত। কবিতাটির ভাবসত্য হল—কবি তাঁর জীবনের প্রথম থেকেই তাঁর জীবননিয়ন্ত্রী জীবনদেবতার প্রেরণা লাভ করেছেন এবং পরিচালিত হওয়ার জন্য আহ্বানও পেয়েছেন। কবি সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, জানতে চেয়েছেন তাঁর জীবনের লক্ষ্য। জীবনদেবতা সে সকলের উত্তর না দিয়ে পথ চলার, কর্ম করে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন কবিকে।
মানুষকে পথ চলতে হয়—খোঁজ করতে নেই পথপ্রাস্তের। কাজ করতে হয়, আশা করতে নেই ফলাফলের। এটি এক তত্ত্বকথা।
এইসব ভাবসত্য ও তত্ত্বকথাকে সুন্দরী, অপরিচিতা, মধুরহাসিনী বিদেশিনী নাবিকার পরিচালিত তরণীতে অকূলসমুদ্রে নিরুদ্দেশ যাত্রার পথে লক্ষহীন, উদ্দেশ্যহীনভাবে কবির পাড়ি দেওয়ার কথায় কবি রূপ দিয়েছেন। কবি হলেন আরোহী, নাবিকা তাঁর জীবনদেবতা, ঊর্মিমালাচঞ্চল ঘননীলনীর অসীম পাথার বিবিধ বাধাবিঘ্নসংকুল কর্মক্ষেত্র।
‘সোনার তরী’ কবিতার মাঝি ও ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতার নাবিকা যেমন কবির জীবনদেবতা, আমরা মনে করি ‘মানস সুন্দরী’ কবিতার মানসী তেমনি কবির কাব্যপ্রেরণাদাত্রী, শক্তিনিয়ন্ত্রী। ‘মানসসুন্দরী’তে কবি তাঁর মানসীকে প্রিয়া, আজন্মসাধন সুন্দরী, কবিতা, কল্পনালতা, প্রথম প্রেয়সী, ভাগ্যগণের সৌন্দর্যের শশী, অস্তরলক্ষ্মী, সীমন্তিনী, আলোকবসনা, বাসনাবাসিনী, অনিন্দ্যসুন্দরী, হৃদয়েশ্বরী, খেলার সঙ্গিনী, মর্মের গোহিনী প্রভৃতি এবং সর্বময়ী সম্বোধনে অভিহিত করলেও তিনি হলেন কবিভাষায় ‘জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী’। সেই ‘জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী’ ‘মানসসুন্দরী’ কবিতায় সুন্দর তরণীর কর্ণধার। অতএব মাঝি, নাবিকা ও কর্ণধার কবিজীবনের পরিচালিকা, শক্তি, জীবন দেবতা; ‘সোনার তরী’তে তিনি পুরুষ, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ ও ‘মানসসুন্দরী’তে তিনি রমণী।
কঠিন তত্ত্বকথা ও বিষয়বস্তুকে হৃদয়রসায়ন ও রমণীয়রূপে উপস্থাপিত করবার প্রয়াসে কবিবাচস্পতি রবীন্দ্রনাথ রূপকাঙ্গিক কবিতাবলি রচনা করেছেন। জীবনদেবতাবাস, সৌন্দর্যতত্ত্ব, খণ্ড-অখণ্ড বা বদ্ধমুক্ত ভাবসত্য প্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘মানসসুন্দরী’, ‘দুই পাখি’, ‘পরশ পাথর’ ইত্যাদি রূপকাত্মক কবিতাচয়ে প্রবেশ করে কাব্যকলাচাতুর্যের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তা অনন্যসাধারণ।
এখানে উল্লেখ থাকে, খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে চান্দেল্লবংশীয় রাজা কীর্তিবর্মার সময় কবি কৃষ্ণমিশ্ৰযতি অদ্বৈত বৈক্ষ্ণব মতো প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মানব চিত্তের বৃত্তিগুলি নিয়ে, সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে দৃশ্যকাব্য শাখায় প্রথম রূপক নাটক রচনা করেন প্রবোধ চন্দ্রোদয়।