বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে প্রকৃতি প্রেমিক কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একমাত্র। বাল্যকালে প্রকৃতিকে তিনি দেখেছিলেন আড়াল থেকে। প্রকৃতি তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেও, তিনি বন্ধ ঘরের জানালা দিয়ে আকাশের নীলিমা ও বাতাসের স্নিগ্ধতা উপলব্ধি করলেও তাদের স্পর্শে আসতে পারেননি। তাই ‘জীবন স্মৃতি’তে বলেছেন— “বাড়ির বাহিরে আমাদের যাওয়া একান্ত বারণ ছিল, এমনকি বাড়ির ভিতরেও….সে ছিল মুক্ত আমি ছিলাম বন্ধ—মিলনের উপায় ছিল না, সেই জন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল।” জমিদারি কাজ দেখাশোনার জন্য পদ্মার বিস্তৃতি অঞ্চলের মধ্যে ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের প্রকৃতি বিষয়ক আলোচনা করবো।
‘মানস সুন্দরী’ কবিতায় পদ্মাতীরের সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা পরবর্তী অন্ধকারের কথা আছে। সাঁঝতারা পশ্চিম দিগন্তে নদী-পারের বনশিরে যখন ওঠে, রাত্রির আঁধার তখন সারা বিশ্বভুবনকে গ্রাস করে ফেলে। পদ্মাকে মনে হয়েছে কোনো রূপবতী, দীর্ঘবসন অঞ্চল পেতে শুয়ে আছে—
“হেরি অদূরে পদ্মা, উচ্চতট তলে
শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
………..
চোখের পাতার মতো।”
রাত্রির অন্ধকারে পদ্মা প্রকৃতির আরেক রূপ। পদ্মার জলে ঘট ভরে নিজের ঘরে ফিরে গেছে এক বালিকা বধূ কৃষ্মা একাদশীর গহন অন্ধকারে। বৃদ্ধ কোনো নদীতটস্থ জীর্ণ কুটীরে সন্ধ্যার প্রদীপ কখন নিভে গেছে তার ঠিক নেই—
“রজনি গভীর হল, দীপ নিভে আসে;
পদ্মার সুদূর পারে পশ্চিম আকাশে
………..
দীর্ঘপথ, শূন্য ক্ষেত্র, হয়েছে অতিথি
………..
মাঠ পারে কৃষি পল্লি হতে।”
শ্রাবণের ঘন মেঘের ছবি পাওয়া যায় এই কবিতাটির মধ্যে—
“শ্রাবণের দিগন্ত পারে
যে গভীর স্নিগ্ধ দৃষ্টি ঘন মেঘভরে
………..
নারী চক্ষে।”
‘ঝুলন’ কবিতায় বর্ষার কথা বলা হয়েছে। আকাশ আঁধার করা বর্ষার ধারাপাত ‘চারিধার’ একাকার—
‘সঘন বরষশ গগন আঁধার
হেরো বারি ধারে কাঁদে চারিধার
………..
যেন এক লক্ষ লক্ষ শিশুর অট্টরোল।”
‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় হেমন্ত ও শরৎকালের কথা আছে। এই কবিতাটি আরম্ভ হয়েছে হেমন্তের দুপুর দিয়ে। দুপুরের বাতাসে পল্লি পথের ধূলি ওঠে, অশ্বত্থের স্নিগ্ধ ছায়ায় জীর্ণ বনাঞ্চলে শুয়ে থাকে বৃদ্ধা ক্লান্ত শরীরের এক ভিখারিণী, রোদ ঝাঁঝাঁ করে, চারিদিকে নীরব শূন্যতা—
“বেলা দ্বি-প্রহরে;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর
………..
ঝঁঝাঁ ঝাঁ করে চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম।”
ষষ্ঠ স্তবকে দীপ রৌদ্র, উদাসীন তরু বীথি, খর, বেগবতী গঙ্গা, জলশূন্য শুভ্র খণ্ড মেঘের দলের কথা আছে—
“চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্য ভারে
রৌদ্র পোহাইছে .………………
বহে খরবেগে শরতের ভরা গঙ্গা……..”
‘পরশপাথর’ কবিতায় অস্তগামী সূর্যের কথা, আকাশে সোনালি আভা, সমুদ্র তরলিত স্বর্ণের স্পর্শ, পশ্চিম দিগন্তের প্রোষিতভর্তৃকার চোখে চোখে প্রিয়মিলনের সম্ভাবনা—
“তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন
……….
পশ্চিম দিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন।”
‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় বলেছেন—
“আকুল সিন্ধু উঠিছে আকুলি
………..
গগন কোণে।”
মহাকবি কালিদাসের কাব্য পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে হিমালয়ের প্রতি অনুরাগ জেগেছিল। ‘বসুন্ধরা’য় আকাশ স্পর্শী গিরিচূড়ার কথা আছে—
“চারিদিকে শৈলবালা
………..
নীল গিরি শ্রেণি পরে দূরে যায় দেখা
………..
যোগ মগ্ন ধুর্জটির তপোবন—দ্বারে।”
পরিশেষে বলা যায়, বাল্যকালে যে প্রকৃতিকে তিনি আড়াল থেকে দেখেছিলেন তা ‘সোনার তরী’ পর্বে পদ্মার বুকে এসে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। প্রকৃতির সঙ্গে এই একাত্মতা ‘সোনার তরী’ কবিতা মালায় এবং ‘ছিন্নপত্রে’র বিভিন্ন চিঠিতে ফুটে উঠেছে। ‘ছিন্নপত্রে’র এই উক্তির মাধ্যমে তাকে প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন— “নতনেত্র প্রকৃতির কী একটা বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভব করি।” তাঁর এই বক্তব্যই ‘সোনার তরী’র বিভিন্ন কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে।