Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

‘বসুন্ধরা’ কবিতায় কবির বিশ্বপ্রীতির আবেগ শেষপর্যন্ত এক বিশ্বাত্মবোধের দর্শনে সংহতৎরূপ লাভ করেছে আলোচনা করো

রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কবি এবং তিনি বৃহদর্থে বিশ্বপ্রকৃতির কবি। রবীন্দ্রনাথের এই প্রকৃতিচেতনা এতই সুনিবিড় যে, তিনি কেবল প্রকৃতি ও প্রাণপ্রবাহের নিরন্তর সৌন্দর্য সম্ভোগেই পরিতৃপ্ত নন, কখনো কখনো তিনি নিজেকে সেই বিশ্বপ্রকৃতির চৈতন্যের অংশ হিসাবেই পরিগণিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই যে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতাবোধের ধারণা, তা যে ক’টি কবিতায় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম কবিতা ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বসুন্ধরা’ কবিতাটি।

‘বসুন্ধরা’ কবিতাটির রচনাকাল ২৬ কার্তিক, ১৩০০ বঙ্গাব্দ। এর প্রায় তিনমাস পূর্বে শিলাইদহ থেকে ইন্দিরা দেবীকে লিখিত একটি পত্রেই এই বিশ্বাত্মবোধের পরিচয়টি ফুটে উঠেছিল। ইন্দিরা দেবীকে তিনি লিখেছিলেন—‘এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধী উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কতদূর দূরান্তর, কত দেশ দেশান্তরের জল, স্থল, পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম, তখন শরৎ-সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস, একটি জীবনীশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ড বৃহৎভাবে সঞ্চারিত হয়ে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে আমার এই যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যস্নাথা আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে, শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থরথর করে কাঁপছে।

বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে নিজ প্রাণচৈতন্যের এই নিবিড় যোগের অনুভূতিটিই শিল্পরূপ গ্রহণ করল ‘বসুন্ধরা’ কবিতায়। আলোচ্য কবিতায় এক দুর্দমনীয় আবেগে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির ও বিশ্বমানবের মধ্যে নিজ প্রাণচৈতন্যকে প্রসারিত ও মিশ্রিত করে দেবার আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। কবির এই আকুলতা এত তীব্র যে, তিনি বিশ্বের জল-স্থল-আকাশের অনিঃশেষ সৌন্দর্যরস আকণ্ঠ পান করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বিজন গৃহকোণে বদ্ধ একাকী কবি ভ্রমণ-বৃত্তান্তের মধ্য দিয়েই যেন অনুভব করেছেন বিশ্বের প্রাণস্পন্দন। অনাদি অনন্ত জীবন-চৈতন্যের সেই প্রবহমান আনন্দস্রোত কবি নিজ আত্মার মধ্যে অনুভব করেছেন।

কবি একদিকে বসুন্ধরার তৃণ-গুল্ম-শৈবালের মধ্যে যেমন নিজ চৈতন্যকে মিশ্রিত করে দিতে চান, শস্যের স্বর্ণশীর্ষে স্বীয় সত্তাকে আন্দোলিত করতে চান, প্রস্ফুটিত পুষ্পের মধ্যে অমৃত-সুধা-সৌন্দর্যে বিকশিত করতে চান; তেমনি সমুদ্র কল্লোলরূপে তিনি ধরণীর বুকে কল্লোলিত হতে চান কিংবা পর্বতশৃঙ্গে তুষারের উত্তরীয় রূপে নিজেকে ব্যাপ্ত করে দিতে চান। এই তীব্র আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে অপূর্ব কাব্যছন্দে –

‘বিদারিয়া

এ বক্ষপঞ্জর, টুটিয়া পাষাণ-বদ্ধ

সংকীর্ণ প্রাচীর, আপনার নিরানন্দ

অন্ধ কারাগার-হিল্লোলিয়া, মর্মরিয়া,

কম্পিয়া, স্খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া,

শিহরিয়া, সচকিয়া, আলোকে পুলকে,

প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে…..।”

কেবলমাত্র প্রকৃতিময় বসুন্ধরার বুকেই প্রাণসত্তাকে মিশ্রিত করার বাসনা পোষণ করেননি কবি। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচেতনাই আসলে বৃহত্তর তাৎপর্য বহন করে। সেই প্রকৃতি কেবল আকাশ, মৃত্তিকা, জল, বায়ু, তৃণ, বৃক্ষ, লতাসর্বস্ব নয়। ড: সত্রাজিৎ গোস্বামী এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘ছিন্ন পত্রাবলী ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন — “এই বঙ্গ-প্রকৃতির রূপালেখ্য মানব-সংসর্গ বিচ্ছিন্ন নয়। বরং মানুষ এবং প্রকৃতির দৈতলীলাই এখানে বৃহত্তর অর্থে অভিব্যক্ত। ‘দ্বৌ অপি অত্র অরণ্য কৌ’—কালিদাসের সেই মহতী বাণীরই যেন উত্তরসাধক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ এখানে আত্মপ্রকাশ করেছেন।”

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রকৃতির যে অনুভূতি ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও তাই প্রকৃতিচিন্তার সঙ্গে লগ্ন হয়ে গেছে মানবজীবনপ্রবাহের প্রসঙ্গও। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বিচিত্র ভাষা, ধর্ম, আচার, সংস্কৃতি নিয়ে যে মানব জীবনপ্রবাহ বহমান, কবি সেই বিচিত্র মানবস্রোতের সঙ্গেও নিজেকে অন্বিত করতে চেয়েছেন।

পৃথিবীর মরুপ্রদেশে ছায়াহীন, পথহীন, বালুকাময় সতৃষ প্রান্তরে যে মানবপ্রবাহ এক অপূর্ব জীবনপ্রণালী গড়ে তুলেছে, কবি সেই জীবনধারায় নিজেকে মিশ্রিত করতে চান—

‘উষ্টদুগ্ধ করি পান

মরুতে মানুষ হই আরব সন্তান

দুর্দম স্বাধীন ;

এরই বিপরীতে বরফাবৃত পর্বতবক্ষে প্রবল শৈত্যের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক মানবজীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তিব্বতের গিরিতটে বৌদ্ধমঠে সেখানে শাস্ত গম্ভীর এক জীবনধারা বহমান। কবি সেই জীবনকেও আত্মিক করে তুলতে চেয়েছেন—

‘তিব্বতের গিরিতটে

নির্লিপ্ত প্রস্তরপুরীমাঝে, বৌদ্ধমঠে

করি বিচরণ।

এছাড়া ‘দ্রাক্ষাপায়ী পারসিক’, ‘নির্ভীক অশ্বারুঢ় তাতার’, এমনকি অরণ্যচারী আদিম বর্বর জনগোষ্ঠীর জীবনধারাকেও প্রত্যক্ষভাবে স্বীয় জীবনে অনুভব করার এক অদম্য ইচ্ছা কবি পোষণ করেছেন—

‘ইচ্ছা করে মনে মনে,

স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোকসনে

দেশে দেশান্তরে ;

অর্থাৎ প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশভূমি থেকে, মানবের বৈচিত্র্যময় জীবনপবাহ থেকেই কবি প্রাণের চিরপ্রবাহিত সার্বিক স্বরূপটি অন্তরে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন –

ইচ্ছা করে, বার বার মিটাইতে সাধ

পান করি বিশ্বের সকল পাত্র হতে

আনন্দমদিরাধারা নব নব স্রোতে।

কবি রবীন্দ্রনাথের এই সরল আবেগোচ্ছ্বাস ক্রমে ক্রমে এক গভীর দর্শনে রূপ লাভ করেছে। কবি যেন অনুভব করেছেন, তাঁর ব্যক্তিশরীরের মধ্যে যে প্রাণচৈতন্য প্রবাহিত, তা কখনো বিচ্ছিন্ন একক কোনো সত্তা নয়। সমগ্র বিশ্বে যে প্রাণতরঙ্গ বিশ্বসৃষ্টির প্রারম্ভ মুহূর্ত থেকে যাত্রা শুরু করেছে, তার ব্যক্তিপ্রাণ আসলে সেই বিশ্বাত্মক প্রাণ প্রবাহের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন, অবিচ্ছেদ্য, পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে শৈবালরূপে, তৃণরূপে, বৃক্ষলতারূপে যে প্রাণ বিকশিত হয়েছে, কবির প্রাণসত্তাও তখন থেকেই সেই শৈবালে শাম্বলে-গুল্মে প্রবাহিত হয়েছিল। এই বসুন্ধরার সঙ্গে প্রাণপ্রবাহসূত্রে কবির বন্ধন তাই সুদীর্ঘকালের—

‘আমার পৃথিবী তুমি

বহু বর্ষের, তোমার মৃত্তিকা-সনে

আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে

অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ

সবিতৃমণ্ডল, অসংখ্য রজনীদিন

যুগযুগান্তর ধরি আমার মাঝারে

উঠিয়াছে তৃণ তব, পুষ্প ভারে ভারে

ফুটিয়াছে, বর্ষণ করেছে তরুরাজি

পত্রফুলফল গন্ধরেণু।

—ছিন্নপত্রের কয়েকটি পত্রে কবির বিশ্বাত্মবোধের এই দর্শনই অপূর্ব গদ্যভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।

তবে ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় এই দর্শন ‘ছিন্নপত্রাবলী’র মতো কেবল অতীতমুখী নয়। অনাগত ভবিষ্যতেও বিশ্বের এই অনন্ত প্রাণপ্রবাহে কবির চৈতন্য সমভাবেই প্রবাহিত হতে থাকবে, এই প্রত্যয়ও উচ্চারিত হয়েছে ‘বসুন্ধরা’ কবিতায়। কবির ব্যক্তি-পরিচয়টি এই দর্শনে একেবারেই গৌণ। ব্যক্তিনাম-নিরপেক্ষ যে প্রাণসত্তা, সেটি দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে চলমান। তাই কবির অন্তরে যে চৈতন্যের প্রকাশ, তা-ও সেই ভবিষ্যৎ প্রাণপ্রবাহের মহাসমুদ্রে বারিবিন্দুর মতো মিশ্রিত হয়ে যাবে বলেই কবি বিশ্বাস করেন।

বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রীরাধিকার মতো রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বচৈতন্যের সঙ্গে মিলনবাসনা অনিঃশেষ। তাঁর রূপতৃয়া যেমন সীমাহীন, তাঁর মিলনসম্ভোগ পিপাসাও তেমনি তৃপ্তিহীনরূপেই প্রকাশ পেয়েছে ‘বসুন্ধরা’ কবিতায়—

‘এখনো মিটে নি আশা,

এখনো তোমার স্তন-অমৃত-পিপাসা

মুখেতে রয়েছে লাগি, তোমার আনন

এখনো জাগায় চোখে সুন্দর স্বপন,

এখনো কিছুই তব করি নাই শেষ।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.