Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

‘বসুন্ধরা’ কবিতাটির মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কবিচৈতন্যের এক সুনিবিড় একাত্মতার বাণী শোনা যায়

রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কবি এবং তিনি বৃহদর্থে বিশ্বপ্রকৃতির কবি। রবীন্দ্রনাথের এই প্রকৃতিচেতনা এতই সুনিবিড় যে, তিনি কেবল প্রকৃতি ও প্রাণপ্রবাহের নিরন্তর সৌন্দর্য সম্ভোগেই পরিতৃপ্ত নন, কখনো কখনো তিনি নিজেকে সেই বিশ্বপ্রকৃতির চৈতন্যের অংশ হিসাবেই পরিগণিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই যে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতাবোধের ধারণা, তা যে ক’টি কবিতায় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম কবিতা ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বসুন্ধরা’ কবিতাটি।

‘বসুন্ধরা’ কবিতাটির রচনাকাল ২৬ কার্তিক, ১৩০০ বঙ্গাব্দ। এর প্রায় তিনমাস পূর্বে শিলাইদহ থেকে ইন্দিরা দেবীকে লিখিত একটি পত্রেই এই বিশ্বাত্মবোধের পরিচয়টি ফুটে উঠেছিল। ইন্দিরা দেবীকে তিনি লিখেছিলেন—‘এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধী উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কতদূর দূরান্তর, কত দেশ দেশান্তরের জল, স্থল, পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম, তখন শরৎ-সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস, একটি জীবনীশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ড বৃহৎভাবে সঞ্চারিত হয়ে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে আমার এই যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যস্নাথা আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে, শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থরথর করে কাঁপছে।

বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে নিজ প্রাণচৈতন্যের এই নিবিড় যোগের অনুভূতিটিই শিল্পরূপ গ্রহণ করল ‘বসুন্ধরা’ কবিতায়। আলোচ্য কবিতায় এক দুর্দমনীয় আবেগে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির ও বিশ্বমানবের মধ্যে নিজ প্রাণচৈতন্যকে প্রসারিত ও মিশ্রিত করে দেবার আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। কবির এই আকুলতা এত তীব্র যে, তিনি বিশ্বের জল-স্থল-আকাশের অনিঃশেষ সৌন্দর্যরস আকণ্ঠ পান করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বিজন গৃহকোণে বদ্ধ একাকী কবি ভ্রমণ-বৃত্তান্তের মধ্য দিয়েই যেন অনুভব করেছেন বিশ্বের প্রাণস্পন্দন। অনাদি অনন্ত জীবন-চৈতন্যের সেই প্রবহমান আনন্দস্রোত কবি নিজ আত্মার মধ্যে অনুভব করেছেন।

কবি একদিকে বসুন্ধরার তৃণ-গুল্ম-শৈবালের মধ্যে যেমন নিজ চৈতন্যকে মিশ্রিত করে দিতে চান, শস্যের স্বর্ণশীর্ষে স্বীয় সত্তাকে আন্দোলিত করতে চান, প্রস্ফুটিত পুষ্পের মধ্যে অমৃত-সুধা-সৌন্দর্যে বিকশিত করতে চান; তেমনি সমুদ্র কল্লোলরূপে তিনি ধরণীর বুকে কল্লোলিত হতে চান কিংবা পর্বতশৃঙ্গে তুষারের উত্তরীয় রূপে নিজেকে ব্যাপ্ত করে দিতে চান। এই তীব্র আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে অপূর্ব কাব্যছন্দে –

‘বিদারিয়া

এ বক্ষপঞ্জর, টুটিয়া পাষাণ-বদ্ধ

সংকীর্ণ প্রাচীর, আপনার নিরানন্দ

অন্ধ কারাগার-হিল্লোলিয়া, মর্মরিয়া,

কম্পিয়া, স্খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া,

শিহরিয়া, সচকিয়া, আলোকে পুলকে,

প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে…..।”

কেবলমাত্র প্রকৃতিময় বসুন্ধরার বুকেই প্রাণসত্তাকে মিশ্রিত করার বাসনা পোষণ করেননি কবি। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচেতনাই আসলে বৃহত্তর তাৎপর্য বহন করে। সেই প্রকৃতি কেবল আকাশ, মৃত্তিকা, জল, বায়ু, তৃণ, বৃক্ষ, লতাসর্বস্ব নয়। ড: সত্রাজিৎ গোস্বামী এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘ছিন্ন পত্রাবলী ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন — “এই বঙ্গ-প্রকৃতির রূপালেখ্য মানব-সংসর্গ বিচ্ছিন্ন নয়। বরং মানুষ এবং প্রকৃতির দৈতলীলাই এখানে বৃহত্তর অর্থে অভিব্যক্ত। ‘দ্বৌ অপি অত্র অরণ্য কৌ’—কালিদাসের সেই মহতী বাণীরই যেন উত্তরসাধক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ এখানে আত্মপ্রকাশ করেছেন।”

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রকৃতির যে অনুভূতি ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও তাই প্রকৃতিচিন্তার সঙ্গে লগ্ন হয়ে গেছে মানবজীবনপ্রবাহের প্রসঙ্গও। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বিচিত্র ভাষা, ধর্ম, আচার, সংস্কৃতি নিয়ে যে মানব জীবনপ্রবাহ বহমান, কবি সেই বিচিত্র মানবস্রোতের সঙ্গেও নিজেকে অন্বিত করতে চেয়েছেন।

পৃথিবীর মরুপ্রদেশে ছায়াহীন, পথহীন, বালুকাময় সতৃষ প্রান্তরে যে মানবপ্রবাহ এক অপূর্ব জীবনপ্রণালী গড়ে তুলেছে, কবি সেই জীবনধারায় নিজেকে মিশ্রিত করতে চান—

‘উষ্টদুগ্ধ করি পান

মরুতে মানুষ হই আরব সন্তান

দুর্দম স্বাধীন ;

এরই বিপরীতে বরফাবৃত পর্বতবক্ষে প্রবল শৈত্যের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক মানবজীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তিব্বতের গিরিতটে বৌদ্ধমঠে সেখানে শাস্ত গম্ভীর এক জীবনধারা বহমান। কবি সেই জীবনকেও আত্মিক করে তুলতে চেয়েছেন—

‘তিব্বতের গিরিতটে

নির্লিপ্ত প্রস্তরপুরীমাঝে, বৌদ্ধমঠে

করি বিচরণ।

এছাড়া ‘দ্রাক্ষাপায়ী পারসিক’, ‘নির্ভীক অশ্বারুঢ় তাতার’, এমনকি অরণ্যচারী আদিম বর্বর জনগোষ্ঠীর জীবনধারাকেও প্রত্যক্ষভাবে স্বীয় জীবনে অনুভব করার এক অদম্য ইচ্ছা কবি পোষণ করেছেন—

‘ইচ্ছা করে মনে মনে,

স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোকসনে

দেশে দেশান্তরে ;

অর্থাৎ প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশভূমি থেকে, মানবের বৈচিত্র্যময় জীবনপবাহ থেকেই কবি প্রাণের চিরপ্রবাহিত সার্বিক স্বরূপটি অন্তরে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন –

ইচ্ছা করে, বার বার মিটাইতে সাধ

পান করি বিশ্বের সকল পাত্র হতে

আনন্দমদিরাধারা নব নব স্রোতে।

কবি রবীন্দ্রনাথের এই সরল আবেগোচ্ছ্বাস ক্রমে ক্রমে এক গভীর দর্শনে রূপ লাভ করেছে। কবি যেন অনুভব করেছেন, তাঁর ব্যক্তিশরীরের মধ্যে যে প্রাণচৈতন্য প্রবাহিত, তা কখনো বিচ্ছিন্ন একক কোনো সত্তা নয়। সমগ্র বিশ্বে যে প্রাণতরঙ্গ বিশ্বসৃষ্টির প্রারম্ভ মুহূর্ত থেকে যাত্রা শুরু করেছে, তার ব্যক্তিপ্রাণ আসলে সেই বিশ্বাত্মক প্রাণ প্রবাহের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন, অবিচ্ছেদ্য, পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে শৈবালরূপে, তৃণরূপে, বৃক্ষলতারূপে যে প্রাণ বিকশিত হয়েছে, কবির প্রাণসত্তাও তখন থেকেই সেই শৈবালে শাম্বলে-গুল্মে প্রবাহিত হয়েছিল। এই বসুন্ধরার সঙ্গে প্রাণপ্রবাহসূত্রে কবির বন্ধন তাই সুদীর্ঘকালের—

‘আমার পৃথিবী তুমি

বহু বরষের, তোমার মৃত্তিকা-সনে

আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে

অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ

সবিতৃমণ্ডল, অসংখ্য রজনীদিন

যুগযুগান্তর ধরি আমার মাঝারে।’

বিশ্বপ্রকৃতির এই নিবিড় সংযোগ থেকে পৃথিবীর বিচিত্র রূপ ও বিচিত্র মানবজীবনকে আত্মসাৎ করার এই যে ইচ্ছা, এরই মধ্যে নিহিত হয়ে আছে ব্যক্তিসত্তার মধ্যে নিত্য প্রবহমান বিশ্বাত্মার চেতনালাভ। মানুষ যে ব্যক্তিরূপে নিঃশেষিত নয়, সে যে মহাজীবনেরই এক পলস্বরূপ, তারই উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের এই প্রকৃতিবন্দনার গভীরে সঞ্চারিত হয়েছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.