বীরপুত্রের মৃত্যুতে শোক এবং অকর্মণ্য স্বামীর প্রতি অভিমান—এই দুই বিষয়ই জনা পত্রিকার মূল বিষয়বস্তু।
করুণ, বীর এবং রৌদ্র রসের সমাহার নিয়ে তৈরি জনার পত্রিকা বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকাগুলির মধ্যে একটি। কবি জনা চরিত্রটি করুণ ও বীর রসের সাথে রৌদ্র রসের সার্থক মিশ্রণে এমন দীপ্যমান করে তুলেছেন যে, তাকে দ্বিতীয় প্রমীলা হিসেবে মনে হয়। প্রমীলা ও জনা উভয়েই সার্থক বীর নারী হলেও দুজনের মূল পার্থক্য হল প্রমীলা প্রেমিকা কুলবধূ; তবে জনার প্রকৃত পরিচয় হল জননী রূপে। অন্যায় সমরে অর্জুন তাঁর পুত্র প্রবীরকে হত্যা করেছেন, তাই জনা ক্ষত্রীয় রমণী হিসেবে ক্ষত্রীয় ধর্মকে মান্য ও শ্রদ্ধা করে অর্জুনকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছুক। কিন্তু হায়! বিধির পরিহাস—নীলধ্বজ ক্ষত্রীয় ধর্মকে পরিহার করে শত্রুকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্রবীরের রাজ রক্তিম হাতকে পরম প্রীতিতে গ্রহণ করেছেন নীলধ্বজ। নীলধ্বজের পুত্রহস্তা শত্রু অর্জুন এখন তাঁর মিত্র। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর রণসাজে শত্রুর সম্মুখীন হওয়া যেখানে কর্তব্য, সেখানে মধুর ভাষায় অর্জুনের স্তুতি করেছেন জনা। অর্জুনকে নর-নারায়ণ জ্ঞানে পূজা করে তিনি ক্ষত্রীয় ধর্মের অবমাননা করেছেন। শেষে ব্রাহ্মণের ললাটে চণ্ডালের পদধূলি পড়বে কি? আজ কোথায় অস্তমিত হল নীলধ্বজের বীরদর্প? কোথায় গেল তাঁর আত্মসম্মানবোধ? ক্ষত্রীয় কন্যা জনা যখন স্বামীর কাপুরুষতাকে ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন—
‘তব সিংহাসনে
বসিছে পুত্রহস্তা রিপু মিত্রতম এবে
সেবিছ যতনে তুমি অতিথি রতনে!’
অথবা—
‘কেমনে তুমি, হায়, মিত্রভাবে
পরশ সে কর যাহা প্রবীরের লৌহ
লোহিত? ক্ষত্রীয় ধর্ম এই কি নৃমণি।’
তখন মনে হয়, পুত্রশোকাতুর নারীর হৃদয়ের তেজ প্রতিটি পঙ্ক্তিতে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরিত হয়েছে।
জনা মধুসূদনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিক চরিত্র। তিনি নিজে অন্তরে বাহিরে সার্থক ক্ষত্রীয় রমণী। তিনি স্বহস্তে তাঁর পুত্রকে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন, অথচ অর্জুনের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু ঘটেছে তাঁর প্রিয় পুত্রের। পুত্রশোকের সেই নিদারুণ শোকাঘাত তো ছিলই, তাতে ইন্ধন যোগাল তাঁর স্বামীর কাপুরুষোচিত আচরণ। চরিত্রটির ট্র্যাজেডি এখানেই নিহিত। যে মুহূর্তে জনাকে স্বামীর বিরুদ্ধে অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠতে হবে, তখনই অন্তর থেকে আসছে তাঁর নারীধর্মের অনুশাসন—‘পড়িব বিষম পালে গঞ্জিনে তোমাতে’। কারণ তাঁর স্বামী ‘গুরুজন’। এই দ্বন্দ্বের ওপরই জনার ট্র্যাজেডি গড়ে উঠেছে। আরও গভীরভাবে বললে, জনার অন্তরের আসল কথাটি হল আত্মমর্যাদাবোধ। এই বোধকে আশ্রয় করেই তাঁর অন্যান্য চারিত্রিক গুণগুলি বিকশিত হয়েছে। একমাত্র পুত্র ক্ষত্রীয়ের মর্যাদার স্বার্থে অসমযুদ্ধে রণক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছে বলেই জনার কাছে তা এতই আদরণীয়, গভীর শোকের সাথে আত্মসম্মানের মহৎ আদর্শ মিলিত হয়ে জনা চরিত্রে এই ট্র্যাজিক মহত্ব আরোপ করেছে।
পুত্রশোকে যে হৃদয় বিহ্বল হয়নি, স্বামীর আচরণ তথা উপেক্ষা তা একেবারে ভেঙে পড়েছে। পুত্রহীন জনার একমাত্র অবলম্বন ছিলেন নীলধ্বজ। তিনিও যখন তাকে প্রত্যাখান করলেন, তখন ঐহিক জীবনে জনার আর কোনো আসক্তি রইল না। তখন জনা উচ্চারণ করেছিলেন—‘ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে?’ পরিণত বয়সের নারীর বেঁচে থাকার যে দুটি প্রধান অবলম্বন, জননী ও পত্নীরূপে, তা ছিন্ন হয়ে গেছে। পুত্র অন্যায়ভাবে নিহত, স্বামী জীবিত থেকেও পর পদলেহনকারী—এই গভীর দুঃখ এই পত্রে করুণ্যের গভীর বেদনা বিস্তৃত করেছে।