Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বীরাঙ্গনা কাব্যের কেকয়ী স্বার্থের নয় সত্যের পূজারী- আলোচনা কর

‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ পত্রিকার কেকয়ী মধুসূদনের কবি কল্পনার অভিনব সৃষ্টি– আলোচনা করুন। মধুসূদনের কেকয়ীর কাছে স্বার্থ চিন্তার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে ন্যায় বিচার। দশরথের প্রতি কেকয়ী চরিত্র সাপেক্ষে তা আলোচনা করুন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রাচীন সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করে নতুন যুগের উপযোগী কাহিনী নির্মাণ করে বাংলা সাহিত্য জগতে নবত্ব দান করেছেন। তাঁর প্রদত্ত নবত্ব পরবর্তীকালে অপরাপর কবি সাহিত্যকের হাত ধরে আজও প্রবাহিত হচ্ছে। ছন্দ ভাষায় যেমন কবি মধুসূদন নতুনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তেমনি রচনা রীতির ক্ষেত্রেও বাংলায় নতুন ভাবধারার প্রবর্তন করেছেন। তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্য এমন একটি অদ্ভুত সৃষ্টি, যার মধ্যে তাঁর নতুন ভাবনা চিন্তা, নতুন ধারা প্রচলন এবং আত্মসৃষ্টির সংস্কার ও সংশোধন মানসিকতার প্রতিবিম্বন ঘটেছে। বীরাঙ্গনা কাব্য পত্র-কাব্য এবং সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে একমাত্র পত্রকাব্য। বাংলায় পত্রোপন্যাস হাল আমলের সাহিত্যেও নজরে পড়ে, কিন্তু পত্রকাব্য আর দৃষ্টিগোচর হয় না। খুব সম্ভব এই একটি মাত্র পত্র কাব্যই বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল।

বিভিন্ন এগারোজন পৌরাণিক নায়িকার তাঁর প্রেমাস্পদ অথবা স্বামীর উদ্দেশ্যে লিখিত পত্রের সমবায়ে সৃষ্ট বীরাঙ্গনা কাব্য রোমক কবি ওভিদের ‘দি হিরোইডেস’-এর আদর্শে প্রাণিত। তবে কবি হবহু ওভিদ-অনুকরণ করেননি। প্রয়োজনে রচনা আদর্শ গ্রহণ, বর্জন এবং সংস্কার সাধন করেছেন কবি। ফলে বিদেশী আদর্শ সঞ্জাত হলেও প্রাচ্য ভাবধারার মুখ্যতা এখানে লক্ষ্য করা যায়। আবার মহাকাব্য থেকে উপাদান সংগৃহীত হলেও তার ঘটনাকে হুবহু অনুসরণ না করে প্রয়োজনে কিছু গ্রহণ, বর্জন ও সংস্কার করেছেন কবি। ফলে পুরাণ, মহাকাব্য ও প্রাচীন সাহিত্য থেকে বীরাঙ্গনা কাব্যের চরিত্র ও কাহিনীর উপাদান চয়ন করলেও বীরাঙ্গনা কাব্য হয়ে উঠেছে কবির মৌলিক সৃষ্টি।

বীরাঙ্গনা কাব্যের অনুযোগ পত্রের লেখিকা কেকয়ীও মধুসূদনের নতুন সৃষ্টি। রামায়ণের কেকয়ীর সঙ্গে মধুসূদনের কেকয়ীর মিল ও অমিল দুই-ই বর্তমান। বীরাঙ্গনার কেকয়ী স্বার্থবাদী। তাঁর স্বার্থ তার পুত্র ভরতের যৌবরাজ্য লাভ। যৌবনে কোন একদিন রাজা দশরথ কেকয়ীর সেবায় পরিতুষ্ট হয়ে ভরতকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করবেন বলেছিলেন। কিন্তু কার্যকালে তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র রামকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করলে, কেকয়ী ক্ষুব্ধ হন এবং অনুযোগসহ দশরথকে পত্র প্রেরণ করেন, যেখানে তাঁর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

কেকয়ী পতি পরায়ণ, তিনি জানেন তার স্বামী অনূত্র ভাষণ করেন না। তাই দাসী মন্থরার মুখে যখন তিনি রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার কথা শুনলেন, তখন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। অবাক বিস্ময়ে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, “একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে?” কৌতূহলের সঙ্গে তিনি সমস্ত রাজ্য জুড়ে আনন্দ উৎসবের কারণ জানতে চেয়েছিলেন এবং ক্রমে তাঁর সংক্ষুব্ধ হৃদয়ের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে ব্যঙ্গ বিদ্রূপাকারে পত্রের ছত্রে ছত্রে। এই ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তাঁর অন্তরের প্রদাহকে উৎসারিত করে দিয়েছে।

বস্তুত রামায়ণের কেকয়ীর তুলনায় বিচার করলে মধুসূদনের কেকয়ী অনেক বেশি জীবন্ত মনে হয়। রামায়ণের কেকয়ী ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু রাজা দশরথের ওপর সে ক্রোধ বর্ষণের রূপ থেকে তাঁর চরিত্র চিত্র অঙ্কন করা যায়নি, কারণ সে ক্রোধ ক্রোধাগারেই আবদ্ধ ছিল। কিন্তু মধুসূদনের কেকয়ী কেকয়ীকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। যা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কেকয়ী অভিমানী নায়িকা নয়, তিনি প্রকৃতই বীরাঙ্গনা।

কেকয়ীর আচরণে বিশেষভাবে নজর দিলে তাঁকে নিতান্ত স্বার্থবাদী বলে মনে হয় না। তিনি পুত্র ভরতের সিংহাসনপ্রাপ্তির জন্যে লড়াই করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর পত্রে রাজা দশরথের সত্যরক্ষার দাবী বড় হয়ে উঠেছে। ধর্মের দাবী। রঘুকুলপতির সত্য রক্ষা ও ধর্মপালনে অবহেলা তিনি প্রিয়তমা মহিষী হয়ে সহ্য করবেন কিরূপে? তাই সত্যরক্ষা ও ধর্মপালনের জন্যে রাজাকে তিনি নানাভাবে প্ররচিত করেছেন এবং প্রয়োজনে কটাক্ষবাণে বিদ্ধ করেছেন।

সপত্নীর প্রতি ঈর্ষাবশত কেকয়ী তাঁর প্রৌঢ়ত্বে দেহের যৌবন ভার ভেঙে পড়ার ইঙ্গিত করে দশরথকে কামুক বলে অভিহিত করেছেন, বিদ্রূপের খোঁচায় তাঁকে ধর্মাচরণে ও সত্যপালনে ব্রতী করতে চেয়েছেন। আঘাত করে অচেতনতা বা বিস্মরণকে স্মরণ করাতে চেয়েছেন। কেননা কেকয়ী ন্যায় বিচার চান এবং তিনি বলেছেন, রাজার কাজই ন্যায় বিচারের। সেই রাজাই যদি অন্যায় করতে থাকেন, তবে তাঁর উপযুক্ত সহধর্মিণী, প্রিয়তমা মহিষীর একমাত্র কর্তব্য হল রাজা বা স্বামীকে ন্যায়ের পথে চালিত করা। সেই কাজ করতেই কেকয়ী কঠিন বিচারকের ভূমিকা নিয়েছেন।

ভরতের পরিবর্তে জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম রাজা হলে কেকয়ী ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বীরাঙ্গনার কেকয়ী তার চেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছে রাজা দশরথের অধর্মাচরণে। তিনি স্বামীর কাছে স্বজ্ঞানে সে অপ্রিয় সত্য নিবেদন করতে গিয়ে বলেছেন, স্বামী গুরুজন না হলে তিনি মুক্ত কণ্ঠে বলতেন –

“অসত্য-বাদী রঘু-কুল-পতি।

নির্লজ্জ। প্রতিজ্ঞা তিনি ভাঙ্গেন সহজে!

ধর্ম-শব্দ মুখে, গতি অধর্মের পথে।”

স্বার্থ-বিঘ্ন চিন্তার বশবর্তী হয়ে কেকয়ী ক্রুদ্ধ হয়েছেন এমন নয়। তিনি প্রথমে যত্ন সহকারে রাজাকে পূর্ব কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। এখানে স্বার্থের চেয়েও রাজার সত্যের অপলাপ ঘটনে কেকয়ী ক্ষুব্ধ, দুঃখিত। কেননা স্বামীর অধর্মাচরণ তাঁর মতো ক্ষত্রিয় নারীর পক্ষে পীড়াদায়ক। তাই পূর্ব কথা স্মরণ করিয়ে যখন মনে হয়েছে, এতে হয়তো কাজ হবে না। তখন তিনি রাজাকে ভয় দেখিয়েছেন যে, দেশে দেশে তিনি রটিয়ে বেড়াবেন, ‘পরম অধর্মাচারী রঘু-কুল-পতি’, এ কথা তিনি নানা ভাবে রটাবেন। শুক-সারী পাখি পুষে তাদের একথা শিখিয়ে বনে উড়িয়ে দেবেন। তারা গাছের ডালে ডালে বসে ঐ বুলি বলবে। গ্রামের বালকদের শেখাবেন, খেলার ছলে গান গেয়ে তারা ঐ কথা বলবে এবং তাঁর মাতা কৌশল্যার বিরুদ্ধে কুকথা উচ্চারণ করেছেন। অন্তত অত্যন্ত বিরক্ত হয়েও যাতে রাজা ধর্মসাক্ষী করে যে সত্য কেকয়ীর কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন, সে সত্য পালন করেন এবং অবশেষে মরিয়া হয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে রাজাকে সতর্ক করেছেন –

“থাকে যদি ধর্ম, তুমি অবশ্য ভুঞ্জিবে

এ কর্মের প্রতিফল! দিয়া আশা মোরে

নিরাশ করিলে আজি; দেখিব নয়নে

তব আশা-বৃক্ষে ফলে কি ফল নৃমণি?”

এরপর সাধারণ স্ত্রীর মতোই তিনি পতিগৃহ ত্যাগ করে পিত্রালয়ে যাবেন এবং পুত্র ভরতকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন একথা জানিয়ে দশরথের বুকে শেল বিধিয়ে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করেছেন।

মধুসূদনের কেকয়ী সব মিলিয়ে এক অভিনব অনবদ্য চরিত্র। তাঁর একদিকে যেমন আছে স্বার্থগন্ধী মনোভাব, অন্যদিকে তেমনি পাওয়া যায় সত্য ভাষণে দৃপ্ত তেজস্বীতা এবং স্বামীর সত্য রক্ষার প্রতি আপ্রাণ প্রচেষ্টা। স্বামীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আছে ঠিকই, কিন্তু স্বামীর অধর্মাচরণকে তিনি কোনভাবে মেনে নিতে পারেন না। তাই মোহগ্রস্তের মোহভঙ্গের জন্যে তিনি আঘাত ও বিদ্রূপের সঙ্গে সত্যস্বরূপ দৃপ্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন।

কেকয়ীর ন্যায় বিচার ও স্বার্থ চিন্তার বিশ্লেষণ

মধুসূদনের কেকয়ী চরিত্রে প্রকৃতই যে দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থান, তা আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়। তাঁর স্বার্থ চিন্তা ও ন্যায় বিচার উভয়ই অত্যন্ত তীব্র। যদিও তাঁর মুল লক্ষ্য ছিল পুত্র ভরতের রাজ্য লাভ, কিন্তু তাঁর চরিত্রের মধ্যে ন্যায়বিচার ও সত্য অনুসরণের প্রতিজ্ঞাও লক্ষ্যণীয়।

কেকয়ীর চরিত্র পর্যালোচনায় জানা যায়, তিনি স্রেফ একটি ধর্মবিরোধী আক্রোশে কেবল নিজের স্বার্থে এগিয়ে আসেননি। বরং, তাঁর কর্মাবলী ও প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে, তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজা দশরথকে ধর্মের পথে ফিরে আনা।

বীরাঙ্গনার কেকয়ী তার স্বামীর অধর্মের পরিণতি সম্পর্কে বিক্ষুব্ধ এবং স্বামীকে সতর্ক করে সত্যনির্ভর অঙ্গীকারের প্রতি পুনরায় তাঁর দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়েছেন।

সার্বিকভাবে, মধুসূদনের কেকয়ী চরিত্রের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী থেকে অনেক নতুনত্ব এবং গভীরতা যুক্ত হয়েছে। তার আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ ও তীব্র মনোভাব চরিত্রের বাস্তবিকতা ও গরিমাকে আরও উজ্জ্বল করেছে।

এখানে কেকয়ীর বিচার ও স্বার্থ চিন্তার দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থান বাস্তবিকভাবে তাঁর সত্তার একটি বহুমুখী রূপ প্রকাশ করে, যা তাঁর চরিত্রকে আরও জটিল ও দৃষ্টিগোচর করে তুলেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.