‘মুক্তধারা’ বলতে মূলত মানবজীবনের অবিরাম, সচ্ছন্দ, ও ক্রমাগত অগ্রগতির প্রতীককে বোঝানো হয়েছে। মানব জীবনের এই ধারা অবিরাম প্রবাহিত হয়, যেখানে মানুষ জন্ম-জন্মান্তরে নানা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। এই অগ্রগতি বা গতি হচ্ছে জীবনের প্রকৃত স্বরূপ, আর এই গতির অবসানই হলো মৃত্যু। তাই বলা হয়, গতির মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নিহিত, আর গতি বন্ধ হলেই মানুষের অন্তরাত্মা পীড়িত হয়। যখনই জীবনের গতিধারা নানান জটিলতা ও মলিনতায় আটকে যায়, তখন প্রাণের লীলা ব্যাহত হয়। মানুষ তার স্বাভাবিক মুক্তস্বভাবের উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়। এই বিষয়েই সমালোচক কনক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— “মুক্তধারা আসলে জীবনের প্রতীক। নাটকে মুক্তধারা ও জীবন অভিন্ন বলিয়া ধরা হইয়াছে। মুক্তধারার ধর্ম চলা। জীবনের ধর্মও তাই।” অর্থাৎ মুক্তধারার গতিতেই জীবনের আসল পরিচয়, এই গতির মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নিহিত।
‘মুক্তধারা’ নাটকে সমস্ত দৃশ্যই পথের ওপর রূপায়িত হয়েছে, যা জীবনের নিরন্তর অগ্রসর হওয়ার প্রতীক। এই পথের মধ্যেই জীবনের বিচিত্র ঘটনা ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়, আর তার সাথেই মানুষ এগিয়ে চলে। পথ ধরেই মানুষ এক জীবন থেকে আরেক জীবনে যায়, অনস্তপথের পথে চলতে থাকে। পথ সীমাহীনতার ইঙ্গিত বহন করে, যা জীবনের অস্তিত্ব ও অসীমত্বের প্রতীক।
‘মুক্তধারা’র বাঁধ প্রতীক হিসেবে যান্ত্রিকতার চরম রূপকে নির্দেশ করে। যন্ত্রশক্তির প্রবল ক্ষমতা এখানে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এই বাঁধ না ভাঙলে জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ স্থবির হয়ে যায়, এবং পৃথিবীতে মানবতার প্রকৃত উপলব্ধি অসম্ভব হয়ে পড়ে। অভিজিৎ তার জীবন দিয়ে এই বাঁধ ভাঙার জন্য প্রস্তুত।
‘মুক্তধারা’কে এক বিশাল লৌহযন্ত্র দ্বারা আবদ্ধ করা হয়েছে, যা প্রজাদের দমনের জন্য রাজা নির্মাণ করেছেন। যন্ত্রশক্তির সহায়তায় তিনি মানুষের গতিশীল জীবনধারায় বাধা সৃষ্টি করেছেন। এটি সংকীর্ণ জাতীয়তার প্রতীক, যেখানে যন্ত্রশক্তির বলে একজন শাসক বিজিত জাতিকে দমন করে, শাসন করে এবং উপনিবেশ স্থাপন করে। এই যন্ত্রশক্তিই পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ ও শাসননীতির প্রতীক হিসেবে কাজ করছে, যা ন্যায় ও সত্য থেকে বিচ্যুত। ‘মুক্তধারা’র যন্ত্রশক্তি এই শাসনের প্রতীক।
মুক্তধারার ঝর্ণাতলাকে অভিজিতের জন্মস্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন কবি, যার মধ্যে একটি গূঢ় অর্থ রয়েছে। ঝর্ণাতলার এই জন্মরহস্যের মাধ্যমে কবি বলতে চেয়েছেন— অন্তরাত্মার অবিরাম গতিশীলতা ও তার বন্ধনের অনুভূতি অভিজিতের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত প্রবল যে, সে রাজসিংহাসন ও ঐশ্বর্য ত্যাগ করে তার মুক্তসত্তার জন্য উদগ্র হয়। কবি মানবাত্মার মুক্তির স্বরূপে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, যেখানে কোনো বন্ধন মানবাত্মাকে আবদ্ধ করতে পারে না। এইভাবে অভিজিতের জন্মস্থানে ঝর্ণাতলা নির্দেশ করে তার মুক্ত আত্মার অভিপ্রায়।
নন্দীর সংকটের পথ, যা অভিজিৎ খুলে দিয়েছে, সেটি একটি অবরুদ্ধ জীবনের প্রতীক। যেখানে মানুষের ন্যায্য অধিকার শাসনযন্ত্রের চাপের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জীবনের স্বাভাবিক প্রকাশ সেখানে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তাই অভিজিৎ এই পথ খুলে দিয়ে শিবতরাই-এর মানুষদের পরান্নজীবী হয়ে থাকার দুঃখ থেকে মুক্তি দিয়েছে। এটাই তার একমাত্র কাজ নয়, ভবিষ্যতে মানুষ যত বাঁধনে আটকে যাবে, সেইসব বন্ধন ছিন্ন করার ব্রত নিয়েই সে পথচলা শুরু করেছে। এইভাবে সে অসীমের পথে এগিয়ে চলেছে।
এ নাটকে ‘উত্তরকূট’, ‘শিবতরাই’, ‘চণ্ডপত্তন’, ‘মোহনগড়’— এই স্থানগুলির নামও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ‘উত্তরকূট’ বলতে বোঝানো হয়েছে উত্তর দিকে অবস্থিত সর্বোচ্চ স্থান, যা জীবনগতির শীর্ষ চূড়ার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ‘উত্তরকূট’ পার্বত্য প্রদেশকে ‘শিবতরাই’-এর সঙ্গে তুলনায় রাষ্ট্রীয় তাৎপর্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। ‘শিবতরাই’ শব্দের অর্থ হলো শিব বা কল্যাণময়। তাদের প্রধান সমস্যা ছিল জলসংকট। মুক্তধারার জলধারা তাদের জন্য কল্যাণকর সম্পদ। তাছাড়া, ‘চণ্ডপত্তন’ নামটি ও তত্ত্বধর্মী। ‘চণ্ড’ শব্দটি ভয়াবহ ক্রোধের প্রতীক, যার মধ্য দিয়ে যে উপনিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, সেটির নামই চণ্ডপত্তন। ‘মোহনগড়’ শব্দের অর্থ সুন্দরভাবে প্রতিভাত গড়, যা রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মোহনগড়ের রাজা তার মানবমুখীনতার জন্য প্রজাদের কাছে প্রিয় ছিলেন।
নাটকে অমাবস্যা, সূর্যাস্ত, আলো, অন্ধকার ইত্যাদিও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অমাবস্যা এমন এক সময়, যা কেন্দ্র করে এক অজানা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অমাবস্যা যেন দেশকালের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে মানবতার এক অনিমোচ্য সংকটের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। সূর্যাস্ত এখানে মানবজাতির ও সভ্যতার অন্ধকার ভবিষ্যতের প্রতীক, যেখানে সূর্য মানবজাতির আদর্শ। আলো ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে মানবসভ্যতা যেন অন্ধকারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে অন্ধকারই মানব ইতিহাসের চূড়ান্ত সত্য নয়, বরং অন্ধকারের মধ্যেই সূর্যোদয়ের সাধনা করে মানুষ রক্তিম প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করে।
সুতরাং, যেমন রাত্রির তপস্যা দিন আনে, তেমনি মানবসভ্যতাকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য আলোকের সন্ধান ও তপস্যার প্রয়োজন। অভিজিৎ ও তার দল এই আলোর জন্য সাধনা করে, যদিও সাধারণ মানুষ অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু মুক্তিতীর্থের পথিকরা সংকটের অবসানকে শাশ্বত বলে মনে করে এবং বাঁধভাঙা মুক্তধারার জলস্রোতের মধ্যে শুনতে পায় মানবমুক্তির সম্ভাবনাময় উল্লাসধ্বনি। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ নাটকটিতে প্রতীকের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক সার্থক প্রতীক নাটক রচনা করেছেন।