ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি, যখন সঠিকভাবে ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়, তখন কীভাবে সে অন্যের হাতে ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক “মুক্তধারা”র রাজা রণজিৎ। নিজের বিচক্ষণতার অভাবে, রাজশক্তি হাতে থাকা সত্ত্বেও তিনি দুর্বল এবং পরিণামে নিজের কর্মচারী যন্ত্ররাজ বিভূতির হাতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। এই নাটকে রাজা রণজিতের চরিত্রটি অত্যন্ত জটিল ও অদ্ভুত। নাটকে দেখা যায়, তিনি উত্তরকূট নামক রাজ্যের শাসক, যার সন্নিহিত এলাকা শিবতরাই তার শাসনাধীন। এই অঞ্চলের জনগণের উপর অত্যাচার চালিয়ে রাজকোষ পূর্ণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। পুরুষানুক্রমিকভাবে চলে আসা এই শোষণ পদ্ধতি তাদের রাজ্যের স্থায়ী শাসন ব্যবস্থার একটি অঙ্গ, যেখানে প্রজাদের দুর্দশার মধ্যে রেখে তাদের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
শিবতরাই অঞ্চলের জনগণকে শোষণের উদ্দেশ্যে, তার পূর্বপুরুষেরা নন্দিসংকটের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, আর রণজিতও সেই পথে আরও এগিয়ে যান। যন্ত্ররাজ বিভূতির সাহায্যে তিনি মুক্তধারা ঝর্ণার জল প্রবাহ বন্ধ করে দিতে শুরু করেছিলেন, যাতে শিবতরাইয়ের জনগণ পানির অভাবে কষ্ট পায় এবং তাদের উপর শাসন আরও কঠোর হয়। পঁচিশ বছর ধরে চেষ্টার পর তিনি যখন বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে, “অতটা বেশি উঁচু করে তোলা ভালো হয়নি।” কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তিনি নিজের ভুলের জালে আবদ্ধ হয়ে যন্ত্ররাজ বিভূতির হাতে পুরোপুরি ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। রণজিতের রাজ্য শাসন প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে স্বৈরাচারে পরিণত হয় এবং তিনি মানুষের হৃদয় থেকে সিংহাসন হারিয়ে ফেলেন।
এ নাটকের বিশেষত্ব হলো, যদিও রণজিতের নামের অর্থ ‘যুদ্ধে জয়ী’, তিনি বাস্তবে কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করেননি। নাটকে তাকে পরাজিত ও ক্ষমতাহীন রাজা হিসেবেই দেখা যায়। তিনি তার রাজশক্তি ও শাসনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হন এবং ধীরে ধীরে যন্ত্ররাজ বিভূতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তার শাসনক্ষমতা অর্থে পুষ্ট যন্ত্ররাজ বিভূতির হাতে চলে যায়। অন্যদিকে, যুবরাজ অভিজিৎ এবং বৈরাগী ধনঞ্জয়ের মতো চরিত্রগুলোর কাছে তিনি ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকেন। তার শেষ পরিণতি হয় এমন এক রাজা হিসেবে, যার হাতে রাজদণ্ড নেই, যদিও তিনি রাজার আসনে বসে আছেন।
রাজা রণজিতের এমন দুর্দশার জন্য মূলত তিনিই দায়ী। তার রাজস্বলোলুপতা ও প্রজাশোষণের প্রবণতা তার বিচক্ষণতাকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে দেয়। শাসনকার্য পরিচালনায় প্রথমদিকে তিনি বিচক্ষণ মন্ত্রীর পরামর্শ নিলেও, শিবতরাই থেকে রাজস্ব না আসার পর তিনি মন্ত্রীর পরামর্শের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে যন্ত্ররাজ বিভূতির শরণাপন্ন হন। যান্ত্রিক উপায়ে প্রজাদের উপর শোষণ ও অত্যাচার চালিয়ে তিনি প্রজাদের বিদ্রোহ দমন করতে চেয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন ব্যবস্থা চালু করেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে রাজানুগত্য বৃদ্ধি করবে এবং শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করার মনোভাবকে বিনষ্ট করবে।
ধীরে ধীরে রণজিতের চারপাশে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে এবং যন্ত্ররাজ বিভূতির আগ্রাসী পরিকল্পনার অধীনে তিনি পুরোপুরি তার অধীনস্থ হয়ে পড়েন। যন্ত্ররাজের নিষ্ঠুর শাসন নীতির ফলে, শিবতরাইয়ের জনগণ ধনঞ্জয়ের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে, রণজিতের রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও যুবরাজ অভিজিৎকে সমর্থন করতে শুরু করে, ফলে রাজা পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এমনকি তিনি যে বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন, সেটিও যুবরাজ অভিজিৎ ভেঙে দেন।
যদিও রণজিৎ নাটকের অধিকাংশ অংশে পরাজিত রাজা হিসেবে চিত্রিত হন, নাটকের শেষদিকে তার নামের যথার্থতা প্রমাণিত হয়। তার নাম “রণজিত”, অর্থাৎ যুদ্ধে জয়ী, প্রমাণিত হয় একটি অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে— হৃদয়ের শুষ্ক মরুভূমিতে মনুষ্যত্বের পুনর্জাগরণের যুদ্ধে। যখন মুক্তধারার প্রবল স্রোতে যুবরাজ অভিজিৎ ভেসে যান এবং রাজা রণজিতের বুকফাটা আর্তনাদ শোনা যায়, তখনই তার অবদমিত মনুষ্যত্বের পুনর্জাগরণ ঘটে। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে যন্ত্ররাজ বিভূতির সহায়তায় প্রজাশোষণের মাধ্যমে মনুষ্যত্বকে দমন করার চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং রাজা রণজিৎ একসময় মনুষ্যত্বের পুনর্জাগরণের পথে সফল হন। এখানেই তার নামের সার্থকতা প্রতিফলিত হয়।
যুবরাজ অভিজিৎ, যাকে রাজা রণজিত নিজের সন্তানস্বরূপ গ্রহণ করেছিলেন, শিবতরাইয়ের জনগণের মুক্তির জন্য নন্দিসংকটের পথ খুলে দেন এবং পরবর্তীতে রণজিতের বহু প্রতীক্ষিত মুক্তধারা ঝর্ণার বাঁধও ভেঙে দেন। তবুও, রণজিতের মনে অভিজিৎয়ের প্রতি মমত্ববোধ ছিল অপরিসীম। তিনি অভিজিৎকে বিপথগামী হতে দেখেও নিজের দুর্বল মনোভাবের কারণে তার সাথে কোনো সরাসরি যোগাযোগ করেননি। শেষ দৃশ্যে, যখন তিনি জানতে পারেন যে অভিজিৎ বাঁধ ভাঙতে গিয়েছেন, তখন তিনি দেবতার কাছে তার রক্ষার প্রার্থনা করেন।
এই পরিবর্তন রাজা রণজিতের চরিত্রকে গভীর ও বাস্তবসম্মত করে তোলে। এ কারণেই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে “রণজিত” নামকরণ করেছেন।