রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্য সাহিত্য এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছেছে তাঁর রূপক ও সাংকেতিক নাটকগুলির মাধ্যমে। এই নাটকগুলির প্রতীকী অর্থ সীমাহীন এবং গভীর। বিশিষ্ট রবীন্দ্র সাহিত্য সমালোচক প্রমথনাথ বিশী এই ধরণের নাটকগুলিকে তত্ত্বনাট্য নামে অভিহিত করেছেন, কারণ এই নাটকগুলির মাধ্যমে কোনো না কোনো দর্শন বা তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘শারদোৎসব’ নাটককে এই পর্যায়ের প্রথম সচেতন প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা হয়। পরবর্তীতে আমরা ‘ডাকঘর’, ‘অচলায়তন’, ‘রাজা’, ‘রথের রশি’, ‘মুক্তধারা’-র মতো অনবদ্য সৃষ্টিগুলি পেয়েছি।
যদি সচেতন প্রয়াসকে বিবেচনা না করা হয়, তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাংকেতিক নাটক বলে ধরা যেতে পারে। যেমন সচেতন গদ্য কবিতার আগেই আমরা ‘মানসী’ কাব্যের ‘নিষ্ফল কামনা’ কবিতাটির উল্লেখ পাই। অথবা তারও আগে ‘কালমৃগয়া’-র বিখ্যাত গান “গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া”-র কথাও উল্লেখ করা যায়। তবে এগুলি ছিল আকস্মিক সৃষ্টি— সচেতন প্রচেষ্টা নয়। তেমনই ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকটিও সাংকেতিক হলেও, এটিকে সাংকেতিক নাটকের মর্যাদা দেয়া হয়নি। কিন্তু ‘মুক্তধারা’ নাটকটি রবীন্দ্রনাথের সচেতন সাংকেতিক নাট্যসৃষ্টির উজ্জ্বল উদাহরণ।
আমরা জানি, ‘মুক্তধারা’ রচনার আগে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিনের জন্য বিদেশে ভ্রমণ করেন। সেখানকার ক্ষমতার দম্ভ, উদগ্র লোভ ও বিধ্বংসী শক্তির প্রদর্শন দেখে মানবতাবাদী কবি ব্যথিত হয়েছিলেন। দেশে ফিরে সাম্রাজ্যবাদের এই নিপীড়ন থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার উপায় চিন্তা করে তিনি ‘মুক্তধারা’ নাটকটি রচনা করেন। নাটকটি রচিত হয় পদ্মার তীরবর্তী শিলাইদহে।
দেশের যে সমস্যা তখন প্রচণ্ডভাবে সক্রিয় ছিল, তার কোনো সরাসরি সমাধান তুলে ধরা না হলেও, তার প্রতিফলন ‘মুক্তধারা’ নাটকের মধ্যে পরোক্ষভাবে অনুভূত হয়েছে। নাটকের চরিত্র, দৃশ্যপট, ভৌগোলিক অবস্থান, লৌহযন্ত্র, ঝর্না— এ সবকিছুই প্রতীকী অর্থে একটি বৃহত্তর ধারণা প্রকাশ করে। প্রধানত, নাটকের মূল ভাবনার মধ্যে জীবনধারার অনবরত প্রবাহের সঙ্গে মুক্তির সংকেত প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, বিজ্ঞান ও লোহার যন্ত্র ব্যবহার করে ঝর্নার প্রবাহকে থামানো সম্ভব নয়, তেমনি শোষণ ও নিপীড়নের চাপে মানুষের জীবনের প্রবাহকেও চিরস্থায়ীভাবে অবরুদ্ধ করা যায় না। ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে, যে শাসক একসময় পীড়ন করত, পরে সেই শাসকের মধ্যেই বিবেকের সঞ্চার ঘটে এবং সে তার হিংস্রতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, যেমনটি আমরা অশোকের ক্ষেত্রে দেখি।
নাটকের অভিজিৎ চরিত্রটিকে রবীন্দ্রনাথ চিত্রিত করেছেন সেই অন্তর্নিহিত শুভবুদ্ধির প্রতীক হিসেবে, যিনি শাসকের ঘরেই বড় হন কিন্তু শাসকের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের জীবনের আত্মত্যাগ করেন। অভিজিৎ যে বন্ধ পথকে অতিক্রম করতে চান, তা হলো মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির পথ। তাঁর হাত ধরেই নন্দিসংকটের পথ খুলে যায় এবং যন্ত্রের তৈরি বাঁধ ধ্বংস হয়, যা মুক্তধারার মুক্তির প্রতীক।
অধ্যাপক কনক বন্দ্যোপাধ্যায় মুক্তধারার প্রতীকী তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “মুক্তধারা আসলে জীবনের প্রতীক। এর ধারাবাহিকতা এবং প্রবাহের মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নিহিত। গতির এই ধারাকে রুদ্ধ করলে জীবন বিকৃত হয়ে যায়, এবং এই বিকৃত জীবনকে পুনরুদ্ধার করতেই অভিজিৎ আত্মদান করেন। তাঁর মৃত্যুই জীবনের প্রবাহকে পুনরায় ফিরিয়ে আনে।”
এ প্রসঙ্গে সাহিত্য সমালোচক বসুমিত্র মজুমদারের একটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, “মুক্তধারা নাটকের প্রতীকী ভাবনা কেন্দ্র করে অনেক ভিন্ন অর্থে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, তবে এর কেন্দ্রীয় ভাবনার মধ্যে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী মনোভাবই প্রধান।”