Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ শুধু মধুসূদনের নয়, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রহসন

বাংলা সাহিত্যে প্রথম সফল প্রহসন রচয়িতা ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যার দুটি বিখ্যাত প্রহসন—‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ এবং ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’—প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। এর আগেও ১৮৫৪ সালে রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’ নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিল, তবে এতে একটি বিস্তৃত সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপস্থিতি এবং সমাজচেতনাকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে এটি সূক্ষ্ম হাস্যরস সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। এই নাটক ইংরেজি Comedy of Humours-এর মতো সামাজিক দুর্নীতি, কুসংস্কার ও কুপ্রথা নিয়ে তির্যক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রহসনের পরিবর্তে গম্ভীর ও বাস্তবমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা প্রহসনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিত হয়নি। তাই, ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’কে যথাযথ প্রহসন হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি Farce-এর সরাসরি রূপান্তর বাংলায় আনেন। তাঁর সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র, মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শিমুয়েল পীরবক্স ও পরে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং অমৃতলাল বসুর মতো নাট্যকারগণও বাংলা প্রহসনের একটি ধারা গড়ে তুলতে কাজ করেছেন। তাদের বিভিন্ন নাটক এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’-এর হাস্যরসাত্মক অংশগুলোতেও Farce-এর প্রভাব দেখা যায়, তবে তারা মাইকেলের মতো শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারেননি। প্রহসনের সংজ্ঞায় উল্লেখিত কিছু প্রধান উপাদান যেমন—ঘটনাসৃষ্টির চাতুর্য, চরিত্র ও সংলাপের গুরুত্ব, নাট্য-সিচুয়েশান সৃষ্টির বৈচিত্র্য, হাস্যরস উদ্রেক, সংক্ষিপ্ত কাঠামো, উদ্ভট চরিত্রের ব্যবহার, এবং কৌতুকপূর্ণ পরিবেশ ইত্যাদির ওপর তাঁদের নাটকগুলো ততটা সফলভাবে ভিত্তি করতে পারেনি।

একজন পাশ্চাত্য সমালোচকের মতে, Farce হল “বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ; এটি সভ্যতার যেকোনো গুরুগম্ভীর নিয়মের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয় এবং মানুষের সম্মানবোধ, কর্তব্যবোধ, ও দোষবোধকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে।” একই ধরনের মত প্রকাশ করেছেন সংস্কৃত পণ্ডিত ও আলঙ্কারিকগণও। তাঁদের মতে, প্রহসন সমাজের কুরীতি শোধনের জন্য রচিত হাস্যরস প্রধান একাঙ্কিকা নাটক, যা প্রকৃত অর্থে সমাজের শুদ্ধতা ও সৃজনশীলতা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে কাজ করে।

প্রহসনের কাজ হল সামাজিক সংকট, অনাচার এবং অবক্ষয় দূর করে সুস্থতা ও সামাজিক সৌজন্য ফিরিয়ে আনা। এটি অনেকটা “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার” মতো। প্রচলিত সংজ্ঞায় দেখা যায়, ট্র্যাজেডি নাটকের শেষ চরম বিশৃঙ্খলায় পৌঁছায়, কিন্তু প্রহসনের শেষ তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট পরিবেশ তৈরি করে না। উদাহরণস্বরূপ, মাইকেলের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের পরিণতি হয়তো বাস্তব জীবনে কোনো স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে না, তবে এর হাস্যরস ও সামাজিক বিদ্রূপ দর্শক উপভোগ করেন। এখানে দুষ্টের দমন অপেক্ষা দুষ্টামির দমন বেশি গুরুত্ব পায়।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সাহিত্যে প্রহসনের আবির্ভাবের আগে নাট্যধারার সুস্পষ্ট কোনো ভিত্তি ছিল না। ১৮৫২ সালে জি. সি. গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম মৌলিক নাটক হিসেবে প্রকাশিত হয়। যদিও ট্র্যাজেডি ও কমেডির সমসাময়িক প্রহসনের আবির্ভাব ঘটে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজেও স্বীকার করেছেন যে প্রহসন প্রথমে আসা উচিত ছিল না। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের পরিকল্পনা করার সময় তিনি নাটকটির নাম ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ রাখার কথা চিন্তা করেছিলেন, এবং এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে, “আমরা এখনো একটি জাতীয় থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করিনি, একটি সঠিক, শাস্ত্রীয় নাটক গড়ে তোলার চেষ্টা না করে Farce রচনা করা উচিত নয়।”

নাটকের আদি অবস্থায় নাট্যাভিনয় প্রধানত ধর্মীয় ঘটনা ছিল। তাই দেবতার মন্দির বা মন্দির প্রাঙ্গণ নাট্যমঞ্চ হিসাবে যথেষ্ট ছিল। মাইকেলের আমলে যে সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তার প্রভাবে একদিকে যেমন ইয়ং বেঙ্গলের শিক্ষাপ্রাপ্ত বাবুরা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে গিয়ে নিজেরাই নানারূপ অসামাজিক কার্যকলাপে আসক্ত হয়ে পড়লেন, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষিত সমাজ কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার প্রভাব থেকে সমাজকে বের করে আনতে এবং নব্য-অনাচার, যথা জুয়াখেলা ও মদ্যপানের কুফলের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট হয়েছিল। এ অবস্থাটি বাস্তবিকই প্রহসনের জন্য বিশেষ উপযোগী ছিল। মাইকেলের কাল, তাঁর চেতনা, চরিত্র ও ধ্যানধারণার সাথে প্রহসনদুটির বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়। মাইকেলের দুটি প্রহসনই বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

মাইকেলের প্রহসন দু’টির গুণগত বিশ্লেষণ করলে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’র উৎকর্ষ প্রমাণিত হবে। কাহিনী, ঘটনা সৃষ্টি, হাস্যরস উদ্ভাবন, সংঘাত ও দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য প্রেক্ষিত থেকে প্রহসনটি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’-র চাইতে উচ্চাঙ্গের বিবেচিত হবে। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ নির্ণয় কিন্তু খুব সহজ নয়। কারণ, দুটি নাটকেই সমাজে প্রচলিত কিছু আচার-ব্যবহার, অবস্থান ও প্রতিষ্ঠানকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে। উভয় ক্ষেত্রেই ভাষা তীর্যক, শ্লেষাত্মক এবং প্রবলভাবে কার্যকরী। চরিত্রায়ণও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করা হয়েছে, যদিও ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় কিছুটা অযথার্থতা পরিলক্ষিত হয়। আসল তফাৎটি মাইকেলের গ্রহণের কৌশলের মধ্যে নিহিত। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় যে শহুরে মেকী সভ্যতা ও অপসংস্কৃতির উপর আঘাত হেনেছেন তিনি, তার সমাজের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে মাইকেলের পরিক্রমণের পরিধি ততটা বিস্তৃত নয় যতটা ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’-এ। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’-এর প্রেক্ষাপট গ্রামীণ এবং বক ধার্মিকতার সাথে সাম্প্রদায়িক সহঅবস্থানের একটি অত্যন্ত বাস্তব এবং জটিল চিত্র তিনি উপস্থিত করেছেন। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’-এর কাহিনী স্বয়ং কলকাতাসহ বাংলার যে কোনো অংশের জন্য প্রযোজ্য। এই নাটকে চরিত্র বেশী। ধনী-দরিদ্র, বকধার্মিক ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ভূস্বামী-প্রজা, ধনী আত্মীয়, গরীব কৃপাপ্রার্থী, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি মান ও অবস্থানগত সংঘাত এই নাটকে প্রচুর। তুলনায় ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় শুধু বৃদ্ধ-তরুণ, ধার্মিক-নাস্তিক ছাড়া তেমন প্রবল প্রতিপক্ষসমূহ নেই, যাদের সংঘর্ষে নাটক গতিময় হবে। শেষ পর্যন্ত বাবাজীকেও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে পক্ষান্তরী হতে দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে “বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ”তে এক ধরনের সম্ভাবনাপূর্ণ কমেডি পাওয়া যায় যা ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় অনুপস্থিত। মাইকেল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার করেছেন।

‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে যে সমস্ত ত্রুটি ছিল সেগুলি ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’-এ প্রায় নেই। এই নাটকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের গভীরতা আছে এবং তার পরিধিও বিস্তৃত। হিন্দু বকধার্মিক ও মুসলমান সরলপ্রাণা গৃহবধূকে এরূপ একটি সংঘাতের কেন্দ্রে স্থাপন করে মাইকেল নাটকে যুগপৎ প্রাণ সঞ্চার করেছেন এবং তাঁর সামাজিক উদ্দেশ্যসমূহও সাধন করেছেন। এই মুসলমান চরিত্রের ব্যবহার আপাতঃদৃষ্টিতে হাস্যরসের পাশাপাশি একজন বকধার্মিকের পাপ বাসনার সাথে একটি বুদ্ধিমতী গ্রাম্য মেয়ের চরিত্রের সংঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও বস্তুত intrigue-এর প্রয়োজনে তার ব্যবহার ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।

“এই প্রহসন নকসার সীমা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে একটি ষড়যন্ত্রমূলক (intrigue) কাহিনীর পরিণাম ঘোষণা করেছে। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় কোনো পরিণত ঘটনা ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয় প্রহসনে সে ত্রুটি ঢাকা পড়ে গেছে। ‘একেই কি সভ্যতা’ চেয়ে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ অনেক বেশী সফল হয়েছে। [বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (সপ্তম খণ্ড)- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়]।

প্রহসনটিতে অবশ্য intrigue-এর কমতি নেই। ভক্তবাবু ফন্দি আঁটে পরস্ত্রী ভোগের জন্য, গদাধর ও পুঁটি ফন্দি আঁটে তাদের সরবরাহ করার জন্য। হানিফ ও বাচস্পতি এবং হানিফ ও ফাতেমা সবচেয়ে মারাত্মক ফন্দি আঁটে কৰ্ত্তাবাবুকে তার নিজের খেলায় পরাস্ত করার জন্য। এ ছাড়া রয়েছে intrigue-এর পরিবেশ, যাতে আছে রহস্য ও রোমাঞ্চ। ভগ্ন শিবমন্দিরের পাশে রাতের অন্ধকারে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে তা এই intrigue-এর সফল পরিসমাপ্তি।

“বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ”-র আবহ পুরোপুরি দেশজ। যশোর-খুলনা-চব্বিশ পরগণা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ফলে তা আরো অর্থপূর্ণ হয়েছে। মাইকেল সচেতন শিল্পী ছিলেন, প্রহসনে—যেখানে নাট্যকারকে মাঝে মাঝেই অতিসচেতন হতে হয়—এই গুণ কাজে লেগেছে। একটি একটি করে সামাজিক সমস্যাগুলি তিনি বিশ্বস্ততার সাথে উপস্থাপন করেছেন। ভূস্বামী-প্রজার সম্পর্ক, খাজনা আদায়ের কঠোর পন্থাসমূহ ও দরিদ্র লোকজনের বাস্তব অবস্থা ইত্যাদি প্রথম দৃশ্যে ফুটিয়ে তোলার পরই বকধার্মিক এবং দুশ্চরিত্রতার প্রসঙ্গটি প্রধান করে তুলে ধরেছেন।

এই নাটকে মাইকেল একটি চিরন্তন বিষয়বস্তুর সন্ধান পেয়েছেন বলে তাঁর শিল্পের সফল উত্তরণ ঘটিয়েছেন কাহিনী ও চরিত্র সৃষ্টিতে এবং প্রহসনের অনুষঙ্গ নির্মাণে। হানিফ ও ফাতেমার চরিত্র অত্যন্ত সাদামাটা কিন্তু জোরালো। তাদের রয়েছে একধরনের শক্তিশালী আবেদন। ভক্তবাবু চরিত্রটি একটু বেশী বক্র হলেও সফল, কারণ ভক্তবাবু কোনো বিশেষ ব্যক্তি না হয়ে বরং নাটকে একটি type বা প্রতিভূচরিত্র হিসাবে বেশী কার্যকর। এমনকি স্বল্প পরিসরে পঞ্চীর চরিত্রটিও চমৎকার। কমেডির চরিত্রসমূহও বর্ণনা এবং ঘটনার দ্বিবিধ সংযোগে উপস্থাপিত হয়। খণ্ড খণ্ড দৃশ্যের চরিত্রায়ণ ভাষা ও বর্ণনার গুণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

ফাতেমার মধ্যে মাইকেল নায়িকাদের একাধিক গুণ অর্পণ করেছেন—তার সহজাত আবেদন, লাস্যময়তা, বাকপটুতা, intrigue-এর প্রতি বিশ্বস্ততা একটি বিশেষ দেশজ বাঙালী গুণ হিসাবে যুক্ত হয়েছে। ফাতেমাকে কেন্দ্র করেই “বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ” কাহিনী গতিময় হয়েছে। একটি মেয়ের কর্মকাণ্ডকে হাস্যরসের নাটকে এতখানি প্রাধান্য এর আগে কেউ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। প্রহসনটি তাই এদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.