Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

লেবেডেফের বেঙ্গলী থিয়েটার সম্পর্কে আলোচনা করুন

হেরাসিম স্টেপানোভিচ লেবেডেফ ছিলেন একজন বিশিষ্ট রুশ পণ্ডিত, যিনি ভারতীয় ভাষা, দর্শন, পুরাণ, জ্যোতিষ, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে গভীর আগ্রহের কারণে ভারতে এসেছিলেন। ১৭৮৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি মাদ্রাজে পৌঁছান এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তামিল ভাষা আয়ত্ত করেন। পরে সংস্কৃত ভাষা শেখার উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতায় আসেন এবং সেখানে গোলকনাথ দাস নামক একজন বিশিষ্ট বাঙালি পণ্ডিতের তত্ত্বাবধানে বাংলা, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। লেবেডেফ কেবল একজন পণ্ডিতই ছিলেন না, তিনি একজন গুণী সংগীতজ্ঞও ছিলেন।

যখন বাংলার জনসাধারণ যাত্রাভিনয় দ্বারা নাট্যরসের পিপাসা মেটানোর চেষ্টা করছিল, সেই সময় লেবেডেফ বাঙালির অভিনয় জগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনেন। তিনি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করে প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। এম. জড়রেলের লেখা ‘The Disguise’ নাটকের বাংলা অনুবাদ “কাল্পনিক সংবদল” নাম দিয়ে গোলকনাথ দাসের সহায়তায় তিনি এটি মঞ্চস্থ করেন। এছাড়াও, ‘Love is the Best Doctor’ নাটকটিও তিনি বাংলায় অনুবাদ করান।

লেবেডেফ কলকাতার ইংরেজদের ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’-এ গিয়ে সেখানকার দৃশ্যপট ও অভিনয় পর্যবেক্ষণ করেন এবং মিসেস ব্রিস্টোর নাচ ও গান দেখে বাঙালি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভেবেছিলেন, এতে যেমন দর্শকদের বিনোদন হবে, তেমনি তাঁরও কিছু আয় হবে। সেই সময় কলকাতায় ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল, তাই লেবেডেফের মনে প্রতিযোগিতার মনোভাবও কাজ করছিল। এর ফলে ১৭৯৫ সালে তিনি কলকাতার ২৫ নং ডুমতলায়, বর্তমানে যা এজরা স্ট্রিট নামে পরিচিত, সেখানে ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে তিনি সময়মতো অনুমতিও পান এবং সেই বছর ২৮ নভেম্বর ‘The Disguise’ নাটকের বাংলা অনুবাদ “কাল্পনিক সংবদল” মঞ্চস্থ করেন। এর পরের বছর, ১৭৯৬ সালের ২১ মার্চ, নাটকটির দ্বিতীয় অভিনয়ও অনুষ্ঠিত হয়। নাট্যশালাটি তিনি তিন মাসের মধ্যে বিলিতি রঙ্গমঞ্চের আদলে নিজেই নকশা করে নির্মাণ করেন, যা প্রমাণ করে তিনি দর্শকের রুচি ও চাহিদা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।

লেবেডেফের নিত্যসঙ্গী ছিলেন গোলকনাথ দাস, যিনি কেবল অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের সংগ্রহে সহায়তা করেননি, তাদের অভিনয় শিক্ষাও দিয়েছিলেন। তিনি সেই সময়ের বারবনিতা ও ঝুমুর, সারি, জারি গান, এবং কীর্তন গাওয়া মহিলাদের মধ্য থেকে অভিনেত্রী নির্বাচিত করেছিলেন। লেবেডেফের ইচ্ছা ছিল তাঁর নাটক শুধু কলকাতায় নয়, গ্রামাঞ্চলেও মঞ্চস্থ করা, এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা সফল হয়নি। ইংরেজি থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ তাঁর জনপ্রিয়তায় অসন্তুষ্ট হয়ে নানা প্রতিকূলতা তৈরি করেছিল। জোসেফ ব্যাটল নামে একজন ইংরেজ দৃশ্যপট শিল্পী প্রথমে লেবেডেফকে সহায়তা করলেও পরে প্রতিদ্বন্দ্বী টমাস রোয়ার্থের প্ররোচনায় লেবেডেফের দলের বিপক্ষে কাজ করেন। ফলস্বরূপ, লেবেডেফের প্রায় সকল অভিনেতা-অভিনেত্রী তাঁর দল ছেড়ে চলে যায়। আইনি সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করেও লেবেডেফ কোনো সাড়া পাননি, কারণ রোয়ার্থের প্রভাবে কেউ তাঁকে সাহায্য করতে আগ্রহী ছিল না। শেষমেশ তিনি থিয়েটারের সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম বিক্রি করে লন্ডন হয়ে নিজ দেশে ফিরে যান।

অবদান:

১. বাংলা নাট্যশালার পরবর্তী ধারাবাহিকতার সঙ্গে লেবেডেফের প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও তাঁর অভিনয়ের রীতির কিছু প্রভাব তৎকালীন যাত্রার ওপর পড়েছিল।

২. সামাজিক ও রসাত্মক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যে বাংলার নাট্যশালা একদিন প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, সে ইঙ্গিত তাঁর প্রচেষ্টায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

৩. বাংলা নাট্যশালায় নাচ ও গান, যা দীর্ঘকাল আধিপত্য বিস্তার করে আসছে, তার মূলে রয়েছে লেবেডেফের অবদান।

৪. যাত্রার মধ্যে দৃশ্যবিভাগ ও গর্ভাঙ্ক রচনার ধারণাগুলিও লেবেডেফের নাটকের প্রভাবেই এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

৫. সর্বোপরি, বাংলা রঙ্গালয়ের যে আজকের রমরমা অবস্থা, তার সূচনা মূলত লেবেডেফের হাত ধরেই হয়েছে, যা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

তাই বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাংলায় যেসব যাত্রার অভিনয় হয়েছে, তার মধ্যে যে নৃতনত্ব লক্ষ করা যায়, তা মূলত লেবেডেফের যুগান্তকারী অভিনয়ের ফল। তাঁর “The Disguise”-এর বাংলা অনুবাদিত নাটকের প্রভাবেই এই পরিবর্তন ঘটেছিল বলে অনেকেই মনে করেন। অতএব, তিনি যে বাংলা রঙ্গমঞ্চের ক্ষেত্রে একজন কিংবদন্তি পুরুষ, তা বললে অত্যুক্তি হবে না।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষক যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, তখন তাকে গবেষণা পদ্ধতি বলে। গবেষণা কোনো বিক্ষিপ্ত ও

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.