১৮৩০ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত “হিন্দু থিয়েটার” থেকে শুরু করে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত, বাংলা রঙ্গমঞ্চ ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ হিসেবে টিকে ছিল। যদিও ১৮৬০ সালে “দি ক্যালকাটা পাবলিক থিয়েটার” স্থাপনের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়, এটি সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের প্রথম চেষ্টা ছিল। পরবর্তীতে ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত “বাগবাজার এমেচার থিয়েটার” ধীরে ধীরে একটি সাধারণ রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়, যা শেষ পর্যন্ত “ন্যাশনাল থিয়েটার” নামে কলকাতার প্রথম পেশাদার সাধারণ রঙ্গমঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই ন্যাশনাল থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ হয় দীনবন্ধু মিত্রের লেখা “নীলদর্পণ” নাটক, যা ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এটি বাংলা নাট্যচর্চা ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে।
যদিও “ন্যাশনাল থিয়েটার” ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এর জীবদ্দশা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। ১৮৭২ সালে এর প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিরোধের কারণে থিয়েটারটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রনাথ বসু, এবং ধর্মদাস সুরের মতো নাট্যপ্রেমী অভিনেতারা হতাশ হননি। তাঁরা নতুন রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। বিডন স্ট্রিটে মহেন্দ্রনাথ দাসের জমিতে একটি কাঠের থিয়েটার নির্মিত হয়, এবং এর নামকরণ করা হয় “গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার”। ১৮৭৩ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর এই থিয়েটারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, এবং ৩১শে ডিসেম্বর অমৃতলাল বসুর “কাম্য কানন” নাটকের মধ্য দিয়ে এর উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন না হলেও, পরদিন বেলভেডিয়ারে “নীলদর্পণ” নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
শুরুর প্রতিবন্ধকতাগুলি পেরিয়ে গ্রেট ন্যাশনালের উদ্যোক্তারা অভিনয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ১৮৭৪ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় মঞ্চস্থ করা হয় উমেশচন্দ্র মিত্রের “বিধবা বিবাহ”, মনোমোহন বসুর “প্রণয় পরীক্ষা”, এবং মধুসূদন দত্তের “কৃষ্ণকুমারী” এবং “কপালকুণ্ডলা” উপন্যাসের নাট্যরূপ। তবে দক্ষ অভিনেতার অভাব, নাটক নির্বাচনে ভুল, এবং অভিনেত্রীর অভাবে স্ত্রীচরিত্রে পুরুষ অভিনেতাদের অভিনয়ের কারণে থিয়েটারটি সাফল্য লাভ করতে ব্যর্থ হয়।
এ অবস্থায়, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার গিরিশচন্দ্র ঘোষের শরণাপন্ন হয়, যাঁর নির্দেশনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “মৃণালিনী” ও “বিষবৃক্ষ” মঞ্চস্থ হয়। গিরিশচন্দ্র প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন এবং থিয়েটারটি এবার জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর পর মঞ্চস্থ হয় “নবীন তপস্বিনী” ও “হেমলতা”। ন্যাশনাল থিয়েটারের অনেক সদস্য এবার গ্রেট ন্যাশনালে যোগ দেন।
১৮৭৪ সালের মে মাসের পর গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার কলকাতায় চার মাসের জন্য অভিনয় বন্ধ রাখে এবং দলটি মফস্বলে ইংরেজদের স্টেশন থিয়েটারে বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ করতে বের হয়। মফস্বলে “হেমলতা”, “যেমন কর্ম তেমনি ফল”, “কপালকুণ্ডলা” প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ করে কলকাতায় ফিরে আসে।
কলকাতায় ফিরে এসে গ্রেট ন্যাশনালে অভিনেত্রী নিয়োগ করা হয়। এতদিন কেবল বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনেত্রীরা স্ত্রীচরিত্রে অভিনয় করতেন। এবার কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি, যাদুমণি, হরিদাসী, ও রাজকুমারী নামে পাঁচজন অভিনেত্রী গ্রেট ন্যাশনালে যোগ দেন। তাঁদের নিয়ে প্রথম নাটক “সতী কি কলঙ্কিনী” মঞ্চস্থ হয় সেপ্টেম্বর ১৮৭৪-এ।
তবে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত বিরোধের কারণে গ্রেট ন্যাশনালে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ দেখা দেয়। ধর্মদাস সুরকে সরিয়ে ম্যানেজার করা হয় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যিনি “সতী কি কলঙ্কিনী” নাটকটির রচয়িতা ছিলেন। তাঁর ম্যানেজারত্বের সময় গ্রেট ন্যাশনালে “পুরুবিক্রম”, “ভারতে যখন”, এবং “ম্যাকবেথ”-এর বাংলা রূপান্তর “রুদ্রপাল” প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ হয়।
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ক্রমশ আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ বেড়ে যায়, এবং নগেন্দ্রনাথ দল ছেড়ে অমৃতলাল বসু ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে নতুন কোম্পানি “গ্রেট ন্যাশনাল অপেরা কোম্পানি” গঠন করেন।
এই অবস্থায় ধর্মদাস সুরকে আবার ম্যানেজার করা হয় এবং দলটি মঞ্চস্থ করে “শত্রুসংহার”। এই নাটকটি ভট্টনারায়ণের “বেণীসংহার”-এর ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় এবং এতে প্রথমবারের মতো মঞ্চে আবির্ভূত হন বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী।
১৮৭৫ সালের জানুয়ারিতে উপেন্দ্রনাথ দাসের “শরৎ-সরোজিনী” নাটকটি মঞ্চস্থ হয়, যা দর্শকমনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং টিকিটের চাহিদা তীব্র হয়। এই নাটকে সুকুমারীর ভূমিকায় গোলাপসুন্দরীর অসাধারণ অভিনয় তাঁকে সুকুমারী নামেই পরিচিত করে তোলে।
এরপর দলটি সারা ভারত সফরে বের হয়। ধর্মদাস সুরের নেতৃত্বে দল দিল্লি, আগ্রা, মিরাট, লাহোর, ও লক্ষ্ণৌ ভ্রমণ করে। লক্ষ্ণৌতে “নীলদর্পণ” মঞ্চস্থ করার সময় ইংরেজ দর্শকরা উত্তেজিত হন। এ সময় কলকাতায় মহেন্দ্রলাল বসুর নেতৃত্বে অস্থায়ীভাবে গ্রেট ন্যাশনালের কিছু নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে।
১৮৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারত সফর থেকে দল ফিরে এলে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। দলটির অর্জিত অর্থ ও উপহার সামগ্রী নিয়ে বিরোধ চরমে ওঠে এবং ধর্মদাস সুরকে সরিয়ে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চটির নাম পরিবর্তন করে “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার” নামে চালু করেন।
তবে মাত্র চার মাসের মধ্যে এই উদ্যোগ আর্থিকভাবে ব্যর্থ হয়। ভুবনমোহন আবার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার পুনরায় চালু করেন এবং ম্যানেজার হন উপেন্দ্রনাথ দাস। ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বরে “হীরকচূর্ণ” নাটক মঞ্চস্থ হয়, যা বরোদার রাজা গায়কোয়াড়ের সিংহাসনচ্যুতির সমসাময়িক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। এরপর উপেন্দ্রনাথ দাসের “সুরেন্দ্র-বিনোদিনী” ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সরোজিনী” প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ হয়।
এই সময়ে, ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অফ ওয়েলসের কলকাতায় আগমন নিয়ে “গজদানন্দ ও যুবরাজ” নামে একটি প্রহসন মঞ্চস্থ করা হয়। এই প্রহসন সরকারের কোপে পড়ে এবং বিভিন্ন সময়ে নাটকটির নাম পরিবর্তন করে অভিনীত হয়। এরপরে পুলিশকে নিয়ে “The Police of Pig and Sheep” নামে একটি প্রহসন মঞ্চস্থ হয়।
১৮৭৬ সালের মার্চ মাসে নাটক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া পেশ করা হয় এবং ডিসেম্বর মাসে “Dramatic Performance Act” পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও নাটকের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়, যা গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
অবশেষে ১৮৭৭ সালের ৬ই অক্টোবর “গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার”-এর সর্বশেষ মঞ্চায়ন হয় এবং থিয়েটারটির অস্তিত্ব কার্যত শেষ হয়ে যায়।