অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে এদেশে বিভিন্ন ইংরেজ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এইসব নাট্যশালায় ইংরেজি নাটকের অভিনয় দেখে এদেশীয় ইংরেজি-শিক্ষিত মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্য আদর্শের রঙ্গালয় স্থাপন ও নাটক অভিনয়ের ইচ্ছা ও আগ্রহ জাগে। পুরাতন যাত্রা পাঁচালি আর তাদের ভালো লাগতো না।
এই উৎসাহ ও আগ্রহের বশবর্তী হয়ে কয়েকজন বাঙালী ধনী ব্যক্তি ব্যক্তিগত একক প্রচেষ্টায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করে কয়েকটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করে নাট্যাভিনয় অনুষ্ঠান করেছিলেন। এই ধরনের প্রচেষ্টা চলেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত। এদের মধ্যে প্রসন্ন কুমার ঠাকুর (হিন্দু থিয়েটার), নবীনচন্দ্র বসু ও প্যারীমোহন বসুর বাড়ির নাট্যশালা উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু এইসব নাট্যশালা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, অল্পকাল পরেই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এগুলি ছিল ব্যক্তিগত খেয়াল ও সখের ব্যাপার এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন, একটির সঙ্গে অন্যটির কোন যোগ ছিল না। এগুলির লুপ্ত হয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ, জনসাধারণের শিক্ষা ও রুচির অভাব। আরও একটি বড় কারণ বাংলা ভাষায় রচিত নাটকের অভাব। বাংলা নাটকের অভাবের ফলেই বাঙালীদের প্রতিষ্ঠিত ঐসব নাট্যশালায় ইংরেজি নাটকের অভিনয় হত। অর্থাৎ ইংরেজি নাটকের অভিনয় জনসাধারণের বোধগম্য ছিল না, তাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। ঐ সব অভিনয় অনুষ্ঠান নিতান্তই কৃত্রিম ছিল।
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে জনৈক সমালোচক দৃশ্যপট উদ্ঘাটন করে লিখেছেন, “In the absence of the original Bengali plays they proceeded and influenced as they were by the charm of the English performances, to meet their want by creating plays in English. But it hardly satisfied the dramatic appetite of the general public for it was all Greek to them. They had already infilled an inordinate taste for the theatrical amusements and naturally looked forward to being entertained by appropriate plays written in their own language.”
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের (১৮৫২) পর থেকে পাশ্চাত্য আদর্শে বাংলা নাটক রচনা শুরু হয় এবং বাংলা ভাষায় রচিত নাটকের অভাব ধীরে ধীরে দূর হতে থাকে।
এর ফলেই পূর্ববর্তী সময়ে যে ইংরেজি নাটকের অভিনয়ের কৃত্রিম প্রচেষ্টা চলছিল, তারও অবসান ঘটে। ১৮৫৭ সালে যে আবার এক ধনী গৃহের নাট্যশালা স্থাপন এবং নাট্যাভিনয়ের যে ধারা শুরু হয়, তা একটা স্থায়ী রূপ নেয়। এই সময় থেকেই এদেশে নাট্যাভিনয় এবং নাটক রচনার ক্ষেত্রে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনার জোয়ার এবং নূতনত্ব দেখা দিয়েছিল। ১৮৫৭ সাল থেকেই বাংলাদেশে বাঙালীর নাট্যশালায় বাংলা নাট্যাভিনয়ের ধারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলতে শুরু করে। ইংরেজি নাটকের অভিনয়ও এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
এই নতুন ধারার নাট্যাভিনয় শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ সালের ৩০শে জানুয়ারী সরস্বতী পূজার দিনে পরালোকগত লক্ষপতি আশুতোষ দেবের (সাতু বাবু) বাড়িতে। এই অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ। অভিনয় হয়েছিল নন্দকুমার রায় কৃত ‘শকুন্তলা’ নাটকের অনুবাদ। এই অভিনয়ের পর বিভিন্ন নাট্যশালায় আরো অনেক নূতন নাটকের অভিনয় হতে লাগল।
এর পর বাঙালীর দ্বারা স্থাপিত নাট্যশালায় আর কোন ইংরেজি নাটকের অভিনয় হয়নি, অথবা ইংরেজী নাটক অভিনয়ের জন্য কখনও কোন বাঙালী নাট্যশালা স্থাপন করেননি।
পূর্ববর্তী প্রসন্নকুমার ঠাকুর, নবীনচন্দ্র বসু, প্যারীমোহন বসু এবং অন্যান্য ধনী ব্যক্তিদের গৃহে নাট্যশালা স্থাপন ও ইংরেজি নাটকের অভিনয় এবং ১৮৫৭ সালের আশুতোষ দেবের বাড়িতে বাংলা নাটকের অভিনয় – এই দুয়ের পার্থক্য সম্পর্কে সুন্দর সমালোচনা ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল সমকালীন ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় ১৮৫৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী: “কিন্তু তাহারা (পূর্ববর্তী নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাতাগণ) নাটক সম্বন্ধে, এই রুচি পুনঃ পুনঃ উত্তম অভিনয়ের দ্বারা পূর্ণ বিকশিত না করিয়া যেটুকু উপকার করিয়াছিলেন, তাহাও ছোটখাট ঈর্ষা ও দলাদলির দ্বারা নষ্ট করিয়া দিলেন এবং তাঁহাদের নাট্যশালার উপর যে যবনিকাপাত হয়েছিল তাহা আর উত্তোলিত হয়নি।”
বৎসরের পর বৎসর কাটিয়ে গেল। নাট্যশালা বলিয়া আমাদের যে একটা জিনিস ছিল, তাহাও আমরা ভুলিয়া গেলাম। এমন সময়ে একটা নিমন্ত্রণপত্র পেয়ে জানিতে পারলাম যে পূর্ববর্তী নাট্যশালার ভস্মাবশেষের উপর ফিনিক্স পক্ষীর ন্যায় আর একটি বঙ্গীয় নাট্যশালা আবির্ভূত হয়েছে। এই নিমন্ত্রণের আরও উৎসাহের বিষয়— যে নাটকটির অভিনয় হবে, তা একটি সত্যিকার বাংলা নাটক— কালিদাসের বিখ্যাত নাটক শকুন্তলার বঙ্গানুবাদ।”
‘শকুন্তলা’র বঙ্গানুবাদ এই নাটকের অভিনয় খুবই ভালো হয়েছিল। “হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার ঐ বিবরণেই আরও জানা যায়, সকল অভিনেতাই সুন্দর অভিনয় করেন। যে যুবকটি শকুন্তলার ভূমিকা গ্রহণ করেন তাহার অঙ্গভঙ্গী চলাফেরা সত্যিই নারীর মতো এবং যে চরিত্র তিনি অভিনয় করছিলেন, তাহার উপযুক্ত হয়েছিল। কোন সুনিপুণ অভিনেতার নিকট শিক্ষালাভ না করেও যে তারা এত সুন্দর অভিনয় করেছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
১৮৫৭ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী এই শকুন্তলা নাটকের দ্বিতীয়বার অভিনয় হয় এবং ২৬শে ফেব্রুয়ারী ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ উচ্চপ্রংশিত হয়। এই দ্বিতীয় অভিনয়ে প্রচুর দর্শক সমবেত হয়েছিল এবং উৎসাহিত হয়ে উদ্যোক্তা তৃতীয় অভিনয়ের সঙ্কল্প করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় অভিনয়ে নাটকের তৃতীয় অঙ্ক পর্যন্ত অভিনীত হয়েছিল।
নাটকের অন্যতম অভিনেতা মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্মৃতিকথা’ থেকে জানা যায়, নাটকে কে কোন ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। শকুন্তলা—শরৎবাবু নিজে। তিনি বিশ হাজার টাকার অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে শকুন্তলার রানীবেশ দেখান।
দুষ্মন্ত–প্রিয়মাধব মল্লিক, দুর্বাসা—অন্নদা মুখোপাধ্যায়, অনুসূয়া অবিনাশচন্দ্র ঘোষ, প্রিয়ম্বদা—ভুবনমোহন ঘোষ, আশ্রমের ঋষিকুমার—মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, স্টেজ ম্যানেজার-শরৎবাবুর ভগ্নিপতি উমেশচন্দ্র দত্ত। নাটকের গান করেছিলেন কবিচন্দ্ৰ নামে এক ব্যক্তি। আশুতোষ দেবের বাড়িতে শকুন্তলা নাটকের এই অভিনয়ের প্রশংসা করে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় (১৮৫৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী) যে মন্তব্য করা হয়েছিল, তাতে এই অভিনয়ের সুফল সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব।
‘সমাচার চন্দ্রিকা’র মতে, আমাদের দেশের সংস্কৃত ভাষায় উচ্চস্তরের সাহিত্যমূল্যসম্পন্ন নাটক থাকা সত্ত্বেও সেগুলির প্রতি পূর্ববর্তী নাট্যশালা প্রতিষ্ঠাতা ও অভিনয়ের উদ্যোক্তাগণ যে দৃষ্টি দেননি, তা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এবং দ্বিতীয়তঃ, আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ স্বদেশের সাহিত্য ভাণ্ডারের রসাস্বাদনের সুযোগ করে দিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং সেজন্য তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
‘শকুন্তলা’ নাটকের অভিনয়ের পর এই রঙ্গমঞ্চেই মণিমোহন সরকার রচিত বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’র নাট্যরূপ ‘মহাশ্বেতা’ নাটকের অভিনয় হয় ১৮৫৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। ১৮৫৭ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বরের এডুকেশন গেজেটে প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে এই অভিনয় ভালো হয়েছিল।
আশুতোষ দেবের বাড়ির নাট্যশালায় অভিনীত নাটকগুলির বিশেষ অবদান এই যে এই অভিনয় থেকেই এদেশে বাঙালীর নাট্যশালায় বাংলা নাটকের অভিনয় ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। ‘শকুন্তলা’ অভিনয়ের অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতার নূতন বাজারে রামজয় বসাকের বাড়ির নাট্যশালায় রামনারায়ণ তর্করত্ন মহাশয়ের রচিত ‘কুলীন কুলসর্বলস্ব’ নাটকের অভিনয় হয় ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। এই নাটকে সমকালীন সমাজজীবনের সংস্কারমূলক বিষয়ের অবতারণা করা হয়। এর ফলে এই নাটকের অভিনয়ে সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন ও উৎসাহের সৃষ্টি হয়।
এই নাটকের দ্বিতীয়বারের অভিনয় অনুষ্ঠিত হয় রামজয় বসাকের বাড়িতেই, আর তৃতীয় অভিনয় হয় বড়বাজার অঞ্চলের গদাধর শেঠের বাড়িতে ১৮৫৮ সালের ২২শে মার্চ। এই তৃতীয় অভিনয়ে প্রায় সাতশত দর্শকের সমাগম হয়েছিল। দর্শকদের মধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়, নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কিশোরীমোহন মিত্র প্রভৃতি গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। এমনকি উৎসাহিত হয়ে ১৮৫৮ সালের ৩রা জুলাই মফঃস্বলে চুঁচুড়াতে নরোত্মম পালের বাড়িতেও ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ অভিনীত হয়। এই অভিনয়ের ফলে কুলীন ব্রাহ্মণগণ খুব ক্রুদ্ধ হন। প্রকৃতপক্ষে আশুতোষ দেবের বাড়ির অভিনয় বাংলার নাট্যশালা এবং নাটকাভিনয়ের ভবিষ্যত অগ্রগতির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।