Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

পৌরাণিক নাটক কী? পৌরাণিক নাটকের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী? বাংলা ভাষার একটি পৌরাণিক নাটক আলোচনা কর

কোনও দেশের ধর্মজীবনের সঙ্গে জড়িত প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে পৌরাণিক নাটক (mythological drama) রচিত হয়। পৌরাণিক বিষয়বস্তুর নাট্যরূপায়ণে ভক্তিরসের উদ্দীপনের দিকে নাট্যকারের লক্ষ্য থাকে, তার সঙ্গে মানবরসের মিশ্রণও লক্ষ্য করা যায়। কখনও কখনও নাট্যকারের পৌরাণিক বিষয়বস্তুর আবরণে সমকালীন জীবনের আদর্শ বা জীবনচেতনাকেও রূপায়িত করেন। ‘কেইন’ (Cain) নাটকের বিষয়বস্তু বাইবেলের বিশ্বের প্রথম নরহস্তা কেইনের কাহিনী, সে শয়তানের অনুচর হয়ে তার প্ররোচনায় ঈশ্বরের প্রতি একান্ত অনুরক্ত ভাই অ্যাবেলকে হত্যা করেছে; ঈশ্বর তাকে শাস্তি দিয়েছেন, অনুতপ্ত কেইন বিশ্বসংসার থেকে নির্বাসিত হয়েছে। কিন্তু এই নাটককে প্রচলিত অর্থে পৌরাণিক নাটক বলা চলে না, কবি কেইনকে আদর্শ বীরপুরুষ, নিজের সমাজদ্রোহী ও উদ্ধৃত সত্তার প্রতিমূর্তিরূপেই উপস্থাপিত করেছেন। অলৌকিক পৌরাণিক বিষয় নিয়ে রচিত হয় বলে পৌরাণিক নাটকে অতিপ্রাকৃত ঘটনা সন্নিবিষ্ট হয়।

আমরা এখানেই সাধারণ নাটকের তুলনায় পৌরাণিক নাটকের পার্থক্য লক্ষ্য করি। সাধারণ সামাজিক নাটকের ভিত্তি বাস্তব জীবনের অনুকৃতি (imitation of real life)। এই জাতীয় নাটকের ঘটনার আকস্মিক যোগাযোগ, চরিত্র চিত্রণে অতিরঞ্জন, নিয়তির রহস্যময়তা ইত্যাদি থাকতে পারে; কিন্তু তারা বাস্তবরূপে প্রতীয়মান হবে, সম্ভাব্যতার সীমা অতিক্রম করবে না, দর্শকদের এই প্রত্যাশা নাট্যকারকে পূরণ করতেই হবে। সেইজন্য সাধারণ নাটকের রচয়িতাকে দৃশ্য, ঘটনা ও চরিত্রের বাস্তবরূপ প্রতীয়মানতা এবং সমস্ত অংশের কার্যকারণের যুক্তি শৃঙ্খলারক্ষা সম্পর্কে অবহিত থাকতে হয়। পৌরাণিক নাটকের ক্ষেত্রে এই দায় নাট্যকারকে বহন করতে হয় না, তাঁর পৌরাণিক বিষয়বস্তু পরিবেশনের মূল ভিত্তি ভক্তি-বিশ্বাস, শুধু তার অলৌকিকতাকে নাট্যকলাকৌশলসম্মত করে তোলার প্রতিই তাঁর দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখতে হয়।

ইয়োরোপে ধর্মানুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই নাটকের সূত্রপাত ঘটে। খ্রীস্টানদের দুটি উৎসব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্রীসমাস বা বড়দিন, অন্যটি ইস্টার। এই দুটি উৎসবকেই কেন্দ্র করে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম থেকে তাঁর পুনরুত্থান পর্যন্ত তাঁর জীবনের ঘটনাবলীকে নাটকের রূপ দেওয়া হত। দশম শতাব্দীতে ইস্টার উপলক্ষে ল্যাটিন ভাষায় রচিত একটি নাটক পাওয়া যায় যেখানে তিনজন নারী ও একজন দেবদূত যীশুখ্রীষ্টের কবরের কাছে কথোপকথনরত, এই দৃশ্য উপস্থাপিত। অতঃপর নতুন নতুন চরিত্র এই ধরনের প্রাথমিক ও অপরিণত নাট্যরচনায় সন্নিবিষ্ট হতে থাকে এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে যীশুখ্রীষ্টের জীবনকাহিনী সুষ্ঠু নাট্যরূপে উপস্থাপিত হয়। এতদিন পর্যন্ত গীর্জার মধ্যেই অভিনয়ের অনুষ্ঠান হত, তারপর তা স্থানান্তরিত হল গীর্জার প্রাঙ্গণে, অবশেষে কিছুদিন পরে জনাকীর্ণ বাজারের কাছে। ল্যাটিনের পরিবর্তে ইংরেজিতে নাটক রচিত হতে থাকে। এই নাটকগুলিকে বলা হয় মিস্ট্রি প্লে (Mystery Play), ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এই জাতীয় ধর্মীয় পৌরাণিক নাটক বহু রচিত হয়েছিল। তাদের উপজীব্য ছিল শুধু বাইবেলের কাহিনী। এই সময়ে আরেক ধরনের ধর্মীয়-পৌরাণিক নাটক রচনা ও অভিনয় শুরু হয়, তাদের বলা হত মির‍্যাল্ প্লেজ (Miracle Plays), তাদের বিষয়বস্তু বাইবেলের ঘটনাবলী বা খ্রীষ্টান সাধুসম্ভের জীবন কাহিনী। এই সময় ফরাসী ভাষায়ও এই ধরনের নাটক রচিত হতে থাকে। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে রচিত এই নাটকগুলিকে Mysteries বলা হতে থাকে। এ ধরনের সবচেয়ে পুরনো নাটক যা পাওয়া গেছে তা হল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগের Mystered’ Adam। এই শতাব্দীতেই রচিত Jean Bodel-এর Jeude Saint Nialas দ্বিতীয় শ্রেণীর ধর্মীয়-পৌরাণিক নাট্যধারায় একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। বাস্তব জীবনের মতই এই রচনায় অকুণ্ঠভাবে হাস্যরসাত্মক ও সিরিয়াস বা গুরুগম্ভীর উপাদানগুলিকে সমন্বিত হতে দেখি। বিশুদ্ধ কৌতুক, চরিত্রের বৈচিত্র্য প্রভৃতির জন্য উৎসাহ এবং লোকভাষার সজীবতা প্রতিটি দৃশ্যকেই জীবন্ত করে তুলেছে। এই সময় জার্মান ভাষায়ও এই জাতীয় ধর্মীয়-পৌরাণিক নাটক রচিত হতে থাকে। জার্মান নাটকগুলির অভিনয় স্থানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য: বাজারের যে স্থানে এই নাটকগুলি অভিনীত হত, তা ছিল মধ্যযুগীয় বিশ্বের প্রতীক, স্বর্গ, পৃথিবী ও নরক এই তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। নাটকের ঘটনা তিনটি স্থানেই যুগপৎ প্রদর্শিত হত, পৃথিবীতে এমন কোনও ঘটনা ঘটত না যার অনুরূপ ঘটনা ও ফলাফল স্বর্গে ও নরকে দেখা যেত না।

ইংরেজ নাট্যকার জন হেউডের The Four P’s, মনোমোহন বসুর ‘সতী’ নাটক, ‘হরিশচন্দ্র’ নাটক, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বিশ্বমঙ্গল’, ‘জনা’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদনের ‘নরনারায়ণ’, মন্মথনাথ রায়ের ‘কারাগার’ ইত্যাদি পৌরাণিক নাটকের উদাহরণ। পৌরাণিক নাটক যে কিভাবে সমকালীন জীবনভাবনায় অনুরঞ্জিত হয়, তার পরিচয় মেলে ‘হরিশচন্দ্র’ নাটকে, মনোমোহন তাঁর এই নাটকে হিন্দুমেলায় গীত তাঁর বিখ্যাত গান ‘দিনের দিন সবে দীন, হয়ে পরাধীন’ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার একটি গানে করভার জর্জরিত দেশের দুঃখ প্রকাশিত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলায় অজস্র পৌরাণিক নাটক রচিত হয়েছিল। ভক্তিরসের প্রতি আকর্ষণ বাঙালি মানসের জাতীয় প্রবণতা। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাধনায় যখন বাঙালীর দেব-দেবী কল্পনা ও অধ্যাত্মচেতনা প্রত্যক্ষ সত্যরূপে উদ্ভাসিত হয়েছিল, তখন ধর্মানুভূতির প্রবল ভাবোচ্ছ্বাস জাতীয় মানসকে প্লাবিত করেছিল, তার উদ্দীপনাই গিরিশচন্দ্র ও ক্ষীরোদপ্রসাদের পৌরাণিক নাটকে বিধৃত হয়েছে।

পৌরাণিক যুগের অলৌকিক ঘটনা, ঈশ্বরের মানুষীরূপে আবির্ভাব ও মানুষের মত ভাবাধীনতা, ভক্তির অসাধ্য সাধন—সমস্তই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের বাঙালি জনসাধারণের নবজাগ্রত ধর্মবিশ্বাস প্রবণতায় জীবন্ত সত্য ও রসচেতনার উদ্দীপকরূপে গৃহীত হয়। মধ্যযুগের যাত্রাগান, ধর্মীয় আকুতি ও সঙ্গীতপ্রাধান্য নিয়ে আধুনিক যুগের উন্নত অভিনয় কৌশল ও নাট্যরীতির পরিমার্জনায় বাঙালির মানসলোকে নতুন জন্ম পরিগ্রহ করে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি থেকে সংগৃহীত অলৌকিক আখ্যানবস্তুকে আধুনিক যুক্তিবাদী মানসের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য মনস্তাত্ত্বিক কলা ও কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা বাঙালি নাট্যকারেরা অনুভব করতেন না, এদেশের জনসাধারণের মনের সহজ বিশ্বাস, বিশেষত ভক্তিরসবিহ্বলতার ওপর নির্ভর করে তাঁরা পৌরাণিক ঘটনাবলীকে যুগোচিত কোনও পরিবর্তন ছাড়াই নাটকে সন্নিবিষ্ট করতেন। আধুনিক সাহিত্য বিচারে এই পৌরাণিক নাটকগুলি প্রকৃত নাটক নয়, নাটকের আধারে সংরক্ষিত অলৌকিক রসের আত্মবিস্তার মাত্র। যেখানে দেবমহিমা ও ভক্তের আত্মনিবেদনই নাটকের উপজীব্য, সেখানে জাগতিক নিয়ম বা কার্যকারণশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্বসংঘাত ইত্যাদির বিশেষ কোনও গুরুত্ব থাকতে পারে না। তবু এই যাত্রাধর্মী, ভক্তিরসাত্মক পৌরাণিক নাটকগুলির নিজস্ব কাব্যরূপ ও বিশেষ সুর ছিল, যেখানে দেবতার গুণগান ও ভক্তের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে রাজেন সরকার ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি নাট্যকারেরা ঈশ্বরের সঙ্গী বা উভয়কামী প্রেমিকের ভূমিকায় বাণীর আকারে ঈশ্বরের গুণগান গেয়ে গেছেন। আমাদের সবে মিলে দেখো, সাধারণ পণ্ডিতপাঠক ভক্তিবাদী বা পৌরাণিক নাটকের কাব্যরূপের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছেন; কিন্তু ভারতীয় নাটক যখন যুগোপযোগী দৃষ্টিতে বিবেচিত হয়, তখন দেখা যায়, পৌরাণিক নাটক রচনার মধ্যে সমকালীন জীবনের আদর্শ, চরিত্র, ভাবনার স্রোত প্রবাহিত হয়েছে। তথাপি ভক্তিরসের পরিবেশে সমকালীন জীবনের বাস্তবতা ও সত্যসমূহ রূপায়ণের লক্ষ্যে প্রচুর নাটক রচনা হয়েছে।

পৌরাণিক নাটকের অবকাশে সমাজের সংকট, সামাজিক শৃঙ্খলা, মানবতার সংকট ও সংকটের সঙ্গী হিসাবে ঈশ্বরের আয়োজন নিয়ে এবং মানবসত্তার পরিচয় নিয়ে গঠিত হয়েছে নাটক, যা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক নাটক। এজন্য জাতীয়, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জাগরণগুলির সময় জাতীয় জীবনের সংকট এবং সংকটের ভেতরে একজন স্বজাতির পরিচয়, রাষ্ট্রের উদ্বোধনের আয়োজন ও রাষ্ট্রের মাধ্যমে আকাশের সাথে মানবতার সম্পর্ক এবং তার সঙ্গী হিসাবে ঈশ্বরকে অস্বীকার করার যুক্তি এবং ধর্মীয় আদর্শের প্রতি উদ্দীপনার চাহিদা ও চেতনার প্রতিফলন পায়।

আমরা পবিত্র ভারতের দেশপ্রেমী ও দেশপ্রেমিকার প্রণয়ের জন্য ঈশ্বরের আরাধনা ও মানবতা রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উঠি। এটি পৌরাণিক নাটকের আদর্শিক ঐক্য এবং ভক্তিরসের সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণ করে।

আধুনিক নাটক রচনার জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন সমাবেশে ও সম্প্রদায়ের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরার, পৌরাণিক নাটকের দিকে ছাড়িয়ে যেতে হয়েছিল। তবে, সামগ্রিকভাবে, পৌরাণিক নাটকগুলি মানুষের হৃদয়ে আবেগ, চিন্তা ও ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি চিরন্তন ধারা।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.