বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম ধাক্কা থিতিয়ে গেলে, ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস ‘গোরা’। তবে এটিকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে দেখা সঠিক হবে না। কারণ, ‘গোরা’ শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি। এতে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধ কেবল দেশীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সব সীমানা অতিক্রম করে গেছে। এই উপন্যাসে তাঁর বিশ্বাত্মবোধেরও প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ড. নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন, “গোরা’ বাংলা সাহিত্যে একমাত্র উপন্যাস যেখানে সমগ্র শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারা, আদর্শ, বিক্ষোভ, আন্দোলন, ধর্ম ও জাতীয় জীবনের নতুন আদর্শের সন্ধান, যুক্তি-তর্ক, অনুভূতির উত্তেজনা, বুদ্ধি ও বীর্যের দীপ্তি—এককথায় একটি সমগ্র সমাজের জীবনধারা প্রতিফলিত হয়েছে। এই উপন্যাসে ব্যক্তি জীবনের চেয়ে বৃহত্তর সামাজিক ও জাতীয় জীবনধারার সঙ্গে চরিত্রদের সম্পর্ককে তুলে ধরা হয়েছে। এটি এমন একটি উপন্যাস যা আধুনিক মহাকাব্যের মতো প্রসারিত ও গভীরতাসম্পন্ন।”
গোরা, যাকে শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর সন্তান হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে, আসলে ছিল এক আইরিশ দম্পতির সন্তান। সে ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল, এবং আত্মপরিচয়ের সংকট তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের রূপ নেয়। উপন্যাসে শুধু গোরা, কৃষ্ণদয়াল বা আনন্দময়ীই নয়, বরং সুচরিতা, বিনয়, ললিতা—প্রত্যেকেই এক একটি জীবন্ত চরিত্র। হিন্দু সমাজের সমান্তরালে ব্রাহ্ম সমাজের অবস্থানও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ খুবই নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ জীবনের সত্যনিষ্ঠ পরিচয় তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন মতাদর্শ উপস্থাপন হলেও সেগুলো আরোপিত মনে হয় না; প্রতিটি চরিত্রের স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিষয়বস্তু এবং উপন্যাস শিল্পের দিক থেকে ‘গোরা’ একটি অসামান্য সৃষ্টি।
অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস-শিল্পের পূর্ণতা অর্জনের যে আদর্শকে ধারণ করেছেন, তা তিনি সফলভাবে বাস্তবায়িত করেছেন। এই উপন্যাসে তাঁর কল্পনা ও শিল্পের নিখুঁত রূপায়ণ তাঁর মানসিক অভীপ্সার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে।”
রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’ রচিত হয় ১৯১৬ সালে, যা তাঁর স্বদেশিক মনােভাবের প্রতিফলন। যদিও এটিকে ‘গোরা’র অনুবৃত্তি হিসেবে ধরা যায়, তবু বিষয়গত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কার্জনের ভাঙা বঙ্গ আবার যুক্ত হলেও আন্দোলন থেমে যায়নি, বরং তা স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের একটি ক্ষুদ্র অংশ মূল ধারার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নেয়। রবীন্দ্রনাথ সন্ত্রাসবাদকে কখনো সমর্থন করেননি, তবে এই উপন্যাসে তিনি এক উগ্র সন্ত্রাসবাদীকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। নিখিলেশ ও বিমলা—এই অভিজাত দম্পতির জীবনে সন্ত্রাসবাদী সন্দীপের আবির্ভাব ঘটে। বিমলা সন্দীপের প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু সন্দীপ মূলত স্বার্থান্বেষী ও লোলুপ প্রকৃতির। শেষমেশ নিখিলেশ বিমলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। উপন্যাসটি তিনটি প্রধান চরিত্রের আত্মকথনের মধ্য দিয়ে কাহিনীকে উপস্থাপন করে, যা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে একটি নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। মানসিক দ্বন্দ্ব এবং চরিত্রের প্রতিক্রিয়া উপন্যাসটিকে গতিশীল করেছে। এই উপন্যাসেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম চলিত ভাষা ব্যবহার করেন, যা ‘ঘরে-বাইরে’কে বাংলা সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মর্যাদা দিয়েছে।
ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, “সৃষ্ট চরিত্রগুলো একাধারে জীবনঘটনার নায়ক ও ব্যাখ্যাতা হিসেবে সংঘাতের বহিরূপ এবং মানস প্রতিক্রিয়াগুলোকে সমন্বিতভাবে উপস্থাপন করেছে, যা উচ্চতর সৃষ্টিশক্তির পরিচায়ক।”
পূর্ববর্তী দুটি দেশাত্মবােধক উপন্যাসেরই অনুকৃত্তিরূপে রচিত হয় রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’ -এটিতেও স্বাদেশিকতা এবং দেশাত্মবােধের বেনামিতে ফুটে উঠেছে সন্ত্রাসবাদের এক বীভৎস রূপচিত্র। উপন্যাস-হিশেবে ‘চার অধ্যায়’ বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার নয়। ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেন, “সমস্ত বইটিতে দৃশ্য বর্ণনাগুলি বাদ দিলে যাহা বাকি থাকে, তাহা আগাগােড়াই ব্যক্ত হইয়াছে নাটকীয় চরিত্রের সংলাপের ভিতর দিয়া ও ঘটনার সংঘাত, চরিত্রের অভিব্যক্তি, ঘটনার সঙ্গে চরিত্রের দ্বন্দ্ব, চরিত্রগুলির পরিচয় ও ব্যঞ্জনা সমস্তই প্রকাশিত হইয়াছে কথার ভিতর দিয়া, অবিরল অতিশ্রান্ত মুখের কথায়। তা ছাড়া মেলােড্রামার স্পর্শও সুস্পষ্ট। আখ্যানবস্তুতেও রােম্যান্টিক নাটকীয় উপাদান প্রচুর। কিন্তু লিরিক প্রকৃতি ও আকৃতি এ দুয়ের দ্বন্দ্ব ‘চার অধ্যায়ে’ র সাহিত্যরস ব্যাহত হইয়াছে।” উপন্যাসের মূল সুরটি গীতিকাব্যের হলেও এর গঠনভঙ্গি নাটকের উপযােগী। এর বিষয়বস্তু এবং কাহিনীর গঠন বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, “দেশসেবার নামে কীভাবে অতীন্দ্র-এলা স্বকীয় মানবধর্ম বিসর্জন দিতে বাধ্য হলাে, অথচ এলা ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল বৈপ্লবিক কার্যের আহ্বানে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে এর মধ্যে দেখতে পেয়েছিল নীচতা, মিথ্যাচার এবং অবিশ্বাস ও অন্তরের দুর্গতি। তবু এই উপন্যাসের প্রবল আকর্ষণ এলা ও অতীনের প্রেমকাহিনী, তাদের অতিশয় অর্থবহ এবং ব্যঞ্জনাময় সংলাপ এবং তাদের প্রেমের অনিবার্য ট্র্যাজিক পরিণতি।….নরনারীর জীবনের সহজ স্বাভাবিক বিকাশের প্রেরণাই প্রেম, আলােচ্য উপন্যাসে প্রেমের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, সেটিই ‘চার অধ্যায় উপন্যাসের একটি প্রধান প্রমাণ।”