Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য, পটভূমি ও প্রেক্ষাপট

বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প রচয়িতাদের মধ্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের (১৮৭৩-১৯৩২) একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। যদিও তিনি অনেক উপন্যাস রচনা করেছেন, তবুও মূলত ছোটগল্প রচয়িতারূপে তিনি সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-নৈপুণ্য, অন্তর্লোকচারী গভীর আবেগের ঘাত-প্রতিঘাত, জীবনের বিপুল বিস্তার—প্রথম শ্রেণির উপন্যাসের এই সমস্ত লক্ষণ তার উপন্যাসে পাওয়া যায় না। জীবনের দূরবগাহ ও জটিল দিকগুলোর মর্মোদ্ঘাটনে তিনি বিশেষ উৎসাহ অনুভব করেননি, এবং সে ক্ষমতাও তার ছিল না। তবে আমাদের পারিবারিক জীবনের যে ক্ষুদ্র নদী আমাদের কুটির প্রাঙ্গণের পাশ দিয়ে প্রবাহিত, তার শান্ত, স্তিমিত ধারা এবং সুখ-দুঃখের দুই-একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গ ও লঘু চপল ফেনোচ্ছ্বাসের চিত্রণে প্রভাতকুমার বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। সংকীর্ণ পরিধির মধ্যেই তিনি তার বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বল পরিচয় রেখে গেছেন। লঘু, হাস্যতরল ভাবকল্পনা, জীবনের সরল ও স্বচ্ছন্দ বিকাশ, এবং শেষে অনুকূল দৈবের দাক্ষিণ্যে সমস্ত স্বল্পস্থায়ী দুর্ভাগ্যের মধুর পরিণতি—ঘটনার আবর্তহীন একটানা প্রবাহ—এগুলোই তার উপন্যাসের সাধারণ লক্ষণ। তার চরিত্রসমূহ বাংলার সাধারণ নরনারী। তারা ঘটনাস্রোতের সঙ্গে ভেসে চলে; তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো বিশ্লেষণযোগ্য জটিলতা বা মনস্তত্ত্বের দুর্বোধ্যতা নেই। (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘নবীন সন্ন্যাসী’ (১৯১২), ‘রত্নদীপ’ (১৯১৭), এবং ‘সিন্দুর-কোটা’ (১৯১৯) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার প্রথম উপন্যাস ‘রমাসুন্দরী’ ১৩০৯-১৩১০ বঙ্গাব্দের মধ্যে ভারতীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, এবং গ্রন্থবদ্ধ হয় ১৩১৪ সালে। ঘটনাবৈচিত্র্য ও ভ্রমণরসকে প্রাধান্য দেওয়ায় উপন্যাসটির নায়িকা রমাসুন্দরীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পূর্বাপর সঙ্গতিতে চিত্রিত হতে পারেনি। ‘জীবনের মূল্য’ (১৩২৩) উপন্যাসে প্রভাতকুমার ট্র্যাজেডি রচনার চেষ্টা করেছেন, তবে অন্তর্দৃষ্টি ও আবেগের গভীরতার অভাবে সেই প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। ‘মনের মানুষে’ (১৯২২) প্রধান চরিত্র কুঞ্জের শিশুসুলভ সরসচিত্ততা, কুসংস্কার ও দৈবশক্তিতে বিশ্বাস, ইন্দুবালার প্রতি তার প্রেমের কৌতুকাবহ অসঙ্গতি এবং অবশেষে আদর্শবাদের উচ্চূড়া থেকে সাংসারিকতার নিম্নভূমিতে তাদের মিলন অত্যন্ত উপভোগ্য। ‘নবীন সন্ন্যাসী’তে নায়ক মোহিত ধর্মপরায়ণ; সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণায় সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করে, তবে অবশেষে পীড়িত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে। লেখক নায়কের কৃচ্ছসাধন নিয়ে স্নিগ্ধ বিদ্রুপ-মিশ্রিত কৌতুকরসের সৃষ্টি করেছেন। এই উপন্যাসের কুটচক্রী গদাই পাত্র একটি অবিস্মরণীয় চরিত্র। ‘রত্নদীপ’ প্রভাতকুমারের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এখানে কাহিনী আকস্মিক দৈবসংঘটনের ওপর নির্ভরশীল হলেও, দ্বন্দ্বময় বেদনায় ও আবেগের গভীরতায় চরিত্র চিত্রণ সার্থক হয়েছে। নায়ক রাখালের চরিত্রে সংযম ও আত্মোৎসর্গ-প্রণয়াবেগ, বৌরানীর তীব্র বেদনা, এবং রাখালের প্রকৃত পরিচয় লাভের পর আত্মধিক্কারের যন্ত্রণায় পরিস্ফুট চারিত্রিক শুচিতা পাঠকের হৃদয়কে মুগ্ধ করে। কূটচক্রী, জুয়াচোর খগেন, এবং অভিনেত্রী কনকের চরিত্রও উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত।

শ্রীকুমারবাবু রত্নদীপ’ সম্বন্ধে যথার্থ বলেছেন, “অন্তর্দ্বন্দ্বের গভীরতা, আবেগের অন্তর্ভেদী শক্তি ও জীবনের ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্যে প্রকাশমান রহস্যময়তা এই উপন্যাসে স্মরণীয়ভাবে অভিব্যক্ত হইয়াছে।” ‘সিন্দুরকৌটা’ সাধারণ স্তরের উপন্যাস। এখানে বাঙ্গালী খ্রীষ্টান যুবতী সুশীর আগের বিয়ে যেখানে অসিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে, বিনয়ের প্রথমা পত্নী স্বামীর সঙ্গে সুশীর বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে, বিনয় ও সুশীর মিলনের সমস্ত বাধা অপসারিত হয়েছে, তাতে নিছক গল্পরস ব্যতীত আর কিছু পাওয়া যায় না।

ব্যারিস্টার প্রভাতকুমার ছাত্রাবস্থায়ই কবিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রবর্তনায়ই কথাসাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। তিনি ছােট গল্প রচনায় যতােটা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন উপন্যাস-রচনায় তা’ হতাে না। ছােটগল্পকে বাড়িয়ে নিয়ে উপন্যাসে দাঁড় করাতেন বলে তা যেমন আর ছােটগল্প থাকতাে না, তেমনি তা’ উপন্যাসও হয়ে উঠতে পারেনি। প্রভাতকুমার অন্ততঃ চৌদ্দটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোন গভীরতর জীবন-দর্শনের প্রকাশ ঘটেনি) তাই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্রতিতুলনায় তাঁর উপন্যাস অনেকটাই সাদামাটা, শুধু গল্পের টানেই পাঠক যতটুকু তৃপ্তি পাবার, পেয়ে নেয়।

ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তার উপন্যাসে আধুনিক কালের মতাে উৎকৃষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক বা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কোন সঙ্কটমুহূর্ত সৃষ্টি করেনি, এককথায় তাঁর উপন্যাসের ফুলগুলিকে কোন চিন্তাকীট দংশন করেনি, কথারসের করুণাধারা তত্ত্বের পাষাণ প্রাচীরে কোথাও বাধা পায়নি। সহজ, সরল, সরস—স্বচ্ছতােয়া তটিনীর মতাে তার কাহিনী বয়ে যায়, মাঝে মাঝে দু’চারটি বাধা বিপত্তির উপলখণ্ডে আহত হয়ে সে স্রোতধারা কোথাও ঈষৎ ঘূণি সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু তার আয়ুও যেমন পরিমিত, চাঞ্চল্যও তেমনি স্বল্প। আসল কথা প্রভাতকুমার বাস্তব বাংলাদেশের পল্লী ও নগরজীবনকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-সংঘাতহীন প্রসন্ন বাঙালী-জীবনের সুখপাঠ্য কাহিনী রচনা করেছিলেন।”

রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের সূর্য এবং চন্দ্র উভয়েই যখন মধ্যাকাশে বিরাজমান, সেকালে প্রভাতকুমারের সগর্বে আত্মপ্রকাশ অবশ্যই তার শক্তিমত্তার পরিচায়ক প্রভাতকুমার রবীন্দ্রনাথের প্রবর্তনাতেই কথাসাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হ’লেও তার উপন্যাসে যেমন, তেমনি ছােটগল্পেও তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ না করে আপন প্রবণতা এবং বিশ্বাস অনুযায়ী চলেছেন। তার এই স্বাতন্ত্রের জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথের অন্তরালে চাপা পড়ে যান নি। প্রভাতচন্দ্র উপন্যাস রচনায় তেমন সার্থকতার পরিচয় দিতে না পারলেও ছােটগল্পে তাঁর কৃতিত্ব যথাযােগ্য স্বীকৃতি লাভ করেছে। ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য-বিষয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু অভিমতও রয়েছে। তিনি বলেন, “ছোটগল্পে চরিত্র-বিকাশের স্থান নাই। বর্ণিত চরিত্র বিকশিতভাবেই পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করা এবং ঘটনাটির সঙ্গে সে চরিত্রের সামঞ্জস্য বিধান করিয়া দিতে পারিলেই লেখকের কার্য সম্পন্ন হইল।” তিনি নিজেও এই ধারাই অনুসরণ করেছেন, ফলে তার গল্পগুলি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “হাসির হাওয়ায়, কল্পনার ঝোঁকে পালের উপর পাল তুলিয়া একেবারে হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে, কোথাও যে কিছুমাত্র ভার বা বাধা আছে তাহা অনুভব করিবার জো নাই।” প্রভাতচন্দ্রের রচিত শতাধিক গল্পের মধ্যে অল্প সংখ্যক গল্পেই ট্র্যাজিক রস দানা বাঁধলেও তার অবশিষ্ট সব গল্পই হাল্কারসের ভিয়েনে চাপিয়ে তৈরি। ফলে এক সময় তার হাল্কা মধুর গল্পের চেয়েও বেশি মানুষের সহজ সরল জীবনের মজার দিকটা আবিষ্কারেই তিনি বেশি আনন্দ পেতেন, তাই চরিত্র নয়, চিত্র এবং কাহিনী-রচনা করেই গল্পের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলতে চেষ্টা করতেন।

ছোটগল্প রচনাতেই প্রভাতকুমার সমধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে আমাদের ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ বাঙালি-জীবন ছোটগল্পের পক্ষেই অধিকতর উপযোগী। তার গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘নবকথা’ (১৮৯৯), ‘যোড়শী’ (১৯০৬), ‘দেশী ও বিলাতী’ (১৯০৯), ‘গল্পবীথি’ (১৯১৩), ‘পত্রপুষ্প’ (১৯১৭), ‘যুবকের প্রেম’ (১৯২৮), ‘নূতন বউ’ (১৯২৮) এবং ‘জামাতা বাবাজী’। প্রভাতকুমারের গল্পগুলোর মধ্যে উচ্চাঙ্গের কল্পনা, অন্তর্দ্বন্দ্বের জটিলতা বা আবেগের গভীর ঘাত-প্রতিঘাত পাওয়া যায় না। বাঙালির জীবনের ছোটখাটো সুখ-দুঃখ, অসঙ্গতি, পারিবারিক বিরোধের স্নিগ্ধ, সহানুভূতিপূর্ণ রূপায়ণে, বাস্তব জীবনের নিখুঁত চিত্রণে ও লঘু কৌতুকরসে এ গল্পগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রভাতকুমারের কয়েকটি ছোটগল্প সম্পর্কে আলোচনা করলেই তার সহজ, সরল জীবনরসিকতার বৈশিষ্ট্য বোঝা যাবে। ‘বলবান জামাতা’ গল্পে নামের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসমঞ্জস পালোয়ানী চেহারা নিয়ে দীর্ঘকাল পরে জামাই শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হলে তাকে চিনতে না পারার দরুণ যে বিভ্রাট দেখা দিয়েছে, নির্মল কৌতুকরসেই তার মনোরম উপসংহার ঘটেছে। ‘ভুল শিক্ষার বিপদ’ গল্পে ট্রেনের সহযাত্রী যুবকের প্রতি এক বৃদ্ধের অশিষ্ট, উৎকেন্দ্রিক আচরণের মাধ্যমে তার জীবনের এক করুণ অভিজ্ঞতা মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে উদ্ঘাটিত হয়েছে। ‘রসময়ীর রসিকতা’-য় নিজের মৃত্যুর পর স্বামীর দ্বিতীয়বার বিয়ে বন্ধ করার জন্য রসময়ীর চক্রান্ত এক বিচিত্র হাস্যরস সৃষ্টি করেছে। আমাদের কুসংস্কারের মৃদু কৌতুকমণ্ডিত ব্যঙ্গে, পরিকল্পনার অভিনবত্বে, প্রথমদিকে অলৌকিকতার রহস্যসূজনে এই কৌতুকরসোজ্জ্বল গল্পটি সত্যই অভিনব। ‘কাশীবাসিনী’-তে এক পতিতা নারীর করুণ অপত্যস্নেহের কাহিনী গল্পটির মধ্যে এক গভীরতার সুর সঞ্চার করেছে। প্রভাতকুমারের গল্প উনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগের বাঙালির জীবনধারা বাস্তবরসোজ্জ্বলতায় ফুটে উঠেছে।

‘বায়ু পরিবর্তনে’ দুএকটি তুলির আঁচড়েই হরিধনের পরশ্রীকাতর, ঈর্ষাপরায়ণ নীচ চরিত্রটি ফুটে উঠেছে। হরিধনের দ্বারা প্রতারিত তার ভাবী শ্বশুর যখন ঔদার্যবশত তাকে গাড়িভাড়া বাবদ পাঁচ টাকা দেন তখন আমাদের মনে হয়, লেখক তার ক্ষমাস্নিগ্ধ প্রসন্ন জীবনদৃষ্টিতে এই চরিত্রটিকেও ক্ষমা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে দেখিয়েছেন, গ্রামের পোস্টমাস্টার বর্ষার নির্জন সন্ধ্যায় এক অনাথ বালিকার সঙ্গে নিজের প্রতি মধুর সম্পর্ক রচনা করেছিল, আর প্রভাতকুমারের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের নায়ক পোস্টমাস্টার অপরের প্রেমপত্র চুরি করে নিজের বিকৃত রোমান্স-বাসনা তৃপ্ত করে। চুরি করা পত্রের সংকেত অনুসারে তার প্রেমভিক্ষার হাস্যকর ও কিছুটা পরিমাণে শোকাবহ পরিণতিতে শেষ হয়েছে। গল্পের শেষ অংশে সে অপরের চিঠি ও সরকারি টাকা চুরি করেও স্বদেশী ডাকাতির অজুহাত দিয়ে ইন্সপেক্টরের পদ লাভ করেছে, এই চরিত্রটিও লেখকের ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়নি। ‘খোকার কাণ্ড’ গল্পে গোড়া ব্রাহ্ম হরসুন্দরবাবুর স্ত্রী হিন্দু, প্রাচীন সংস্কার-বিশ্বাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, স্বামীর আরোগ্য কামনায় শিবপূজা করতে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে। খোকার পিতৃসম্বোধন তার আত্মগোপনের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। ‘খুড়া মহাশয়’-এ খুড়োর ভূতের ভয়ের সুযোগ নিয়ে একটা ঘোরতর সাংসারিক অবিচারের প্রতিকার প্রদর্শিত হয়েছে। ‘আদরিণী’-তে মোক্তার জয়রামের বলিষ্ঠ অথচ স্নেহপরায়ণ চরিত্র এবং একটি হাতির প্রতি তার স্নেহ আমাদের মুগ্ধ করে।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প রচনার শিল্পকুশলতা সম্পর্কে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন- “জীবনের খণ্ডাংশ নির্বাচনে, তার ছোটখাটো বৈষম্য-অসঙ্গতির উদ্ঘাটনের দ্বারা তাহার উপর মৃদু হাস্যকিরণ-সম্পাতে, আলোচনার লঘু-কোমল স্পর্শে, দ্রুত অথচ অকম্পিত রেখাঙ্কনে সকল প্রকার গভীরতা ও আতিশয্যের সযত্ন পরিহারে, আকস্মিক অথচ অভ্রান্ত যবনিকাপাতের সমাপ্তি কৌশলে এই সমস্ত দিক দিয়েই তিনি উচ্চাঙ্গের নিপুণতার নিদর্শন দিয়েছেন… ছোটগল্পের আর্ট ও রচনার কৌশল, ইহার পরিমাণবোধ ও সমাপ্তি বিষয়ে তাহার দক্ষতা অসাধারণ।” সমালোচকেরা ছোটগল্প রচয়িতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরেই প্রভাতকুমারের স্থান নির্দিষ্ট করেছেন।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.