Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত গীতিকবিতার ধারাটির পরিচয়

গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য: রঙ্গলাল থেকে কাহিনী-আশ্রিত আখ্যায়িকা কাব্য রচনার যে ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল, উনবিংশ শতাব্দীর সকল প্রধান কবি তজ্জাতীয় আখ্যায়িকা কাব্য এবং মহাকাব্য রচনায় উৎসাহ বােধ করেছেন। কিন্তু এই কাহিনী-আশ্রিত কাব্যধারার পাশে খণ্ড গীতিকবিতা রচনার প্রয়াসেরও একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। ঈশ্বর গুপ্ত থেকে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত খণ্ড গীতিকবিতা রচনার পরিমাণ কম নয়। কিন্তু খণ্ড কবিতামাত্রই গীতিকবিতা কিনাএ বিষয়ে প্রথমেই একটা স্পষ্ট ধারণা করে নেওয়া প্রয়ােজন। যথার্থ লিরিক কবিতা বা গীতিকবিতা কাকে বলে? আকারে ছােট হওয়াটাই গীতিকবিতার একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। “The essence of lyrical poetry is personality.”

গীতিকবিতায় কবির ব্যক্তিত্বের প্রকাশই প্রধান হয়ে উঠতে দেখা যায়। বিশ্বচরাচর-সম্পর্কে একজন অনুভূতিশীল, কল্পনা-প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির অন্তর্জগতে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যে আবেগ আন্দোলিত হয়ে ওঠে তারই নির্যাসিত রূপ বাণীমূর্তি লাভ করে সার্থক গীতিকবিতার নিটোল অবয়বে। রচনার বিষয় যাই হােক, গীতি-কবি আপন ব্যক্তি-স্বরূপকেই প্রকাশ করেন তার রচনায়। আবেগের একমুখিতা, ভাবসংহতি এবং উপলব্ধির গভীরতা ভিন্ন গীতিকবিতা রসােত্তীর্ণ হতে পারে না। এই সূত্রটি মনে রেখে উনবিংশ শতাব্দীর কাব্যধারায় গীতিকবিতার বিকাশ-সম্পর্কে আলােচনায় অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।

বিচিত্র বিষয় নিয়ে কবিতা রচনার একটা নােতুন ধারা বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শুরু হয়েছিল। সংবাদপত্রের সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত বাস্তব জীবন-সম্পর্কে অতিমাত্রায় আগ্রহী ছিলেন। বস্তুনিষ্ঠতা এবং ব্যঙ্গপরায়ণতা তাঁর মননভঙ্গির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। দ্রুত রূপান্তরশীল সমাজের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রাচীন ও আধুনিক জীবনবাদের দোটানায় সংশয়ে দোলায়িত ঈশ্বর গুপ্ত ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন, তার কৌতুকাবহ ভঙ্গিতে খাদ্য বর্ণনার কবিতা লিখেছেন, কবিতায় নীতি উপদেশ বিতরণ করেছেন।

ঈশ্বর গুপ্তের এই বিচিত্র কাব্যসৃষ্টিতে অন্তর্মুখী ভাব-প্রেরণার পরিচয় না থাকায় সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও এগুলিকে যথার্থ গীতিকবিতার নিদর্শনরূপে গ্রহণ করা চলে না। গীতিকবিতার বিষয়বস্তুতে কবিহৃদয়ের যে গভীর প্রতিফলন কাঙ্ক্ষিত, তার পরিবর্তে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় স্থল বিষয়ের একান্ত বাহ্য বর্ণনা এবং কখনাে কখনাে সাংবাদিকতার ধর্ম কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে মাত্র। তবে ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী ঈশ্বর গুপ্ত একান্ত নৈরাশ্যের মধ্যেও অকৃত্রিমভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে অকস্মাৎ এমন দু চারটি চরণ লিখেছেন যার মধ্যে কবির গভীর উপলব্ধি উচ্ছুসিত হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত বিরল এইরকম কয়েকটি কবিতায় ঈশ্বর গুপ্ত কিছু পরিমাণে গীতিকবিতার স্বাদ সঞ্চার করতে পেরেছেন।

ঈশ্বর গুপ্তের পরে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করতে হয়। কিন্তু রঙ্গলালের অসংযত উচ্ছে সময় আখ্যানধর্মী কাব্যগুলিতে কোথাও উৎকৃষ্ট গীতিকবিতার রসাস্বাদ পাওয়া যায় না। কবি মধুসূদনও প্রথম থেকে মহাকাব্য রচনায় সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। মহাকাব্যের কবিরূপেই তাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু মধুসূদনের কাব্যগ্রন্থাবলীর সতর্ক বিশ্লেষণে মনে হয় তার কাব্যপ্রেরণা গীতিকাব্যের অনুকুল ছিল। এ বিষয়ে মধুসূদনের নিজস্ব বক্তব্যকেও সাক্ষ্যরূপে গ্রহণ করা চলে।

তিনি লিখেছিলেন, “But there is a wide field of romantic and lyric poetry before me and I think I have a tendency in the lyrical way.” মহাকাব্য রচনার জন্য যে বস্তুনিষ্ঠ কল্পনাভঙ্গি প্রয়ােজন, জন্ম-রােমান্টিক মধুসূদনের তা ছিল না। জগৎ ও জীবনকে নির্লিপ্তভাবে দেখা তাঁর মতাে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবির পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই মহাকাব্যের আকারে তিনি ঘটনা ও চরিত্রের বিন্যাসে যা রচনা করেছেন তার মধ্যেও কবির নিজস্ব ব্যক্তিরূপের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, আশা-আকাঙ্ক্ষা, নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘মেঘনাদবধ’কেও তাই কোন সমালােচক মহাকাব্যের আকারে বাঙালী জীবনের গীতিকাব্যই বলেছেন।

মধুসূদনের লিরিক-প্রবণতা মেঘনাদবধ কাব্য রচনার সময়ে অন্যভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্যে। বৈষ্ণব কাব্যের মাথুর রসপর্যায়ে রাধার তীব্র বিরহ বেদনার যে কাব্যরূপ সৃষ্ট হয়েছে মধুসূদন সেই প্রসঙ্গ অবলম্বন করে ব্রজাঙ্গনার ছন্দ-সৌন্দর্যমণ্ডিত কবিতাগুলিতে রােমান্টিক হৃদয়াবেগ অবারিত করে দিয়েছেন। একটি কাহিনীর আদল এখানেও আছে-কিন্তু তাতে কবিতাগুলির লিরিক গুণ নষ্ট হয় নি। তবে কবির উৎকৃষ্ট লিরিক রচনা চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে।

চতুর্দশপদী বা সনেট রচনায় একটা নির্দিষ্ট নিয়মের বন্ধন মেনে চলতে হয়, ফলে কবিহৃদয়ের ভাব যথেচ্ছভাবে প্রকাশিত হতে পারে না ঠিকই। তবুও সনেট গীতিকবিতারই প্রকারভেদ। কবির ব্যক্তিত্বই লিরিকের প্রধান বিষয়, মধুসূদনের সনেটের বিষয়ও তারই ব্যক্তিত্বের বিশ্ব। জীবনে কবি যা কিছু সঞ্চয় করেছেন, যাতে আনন্দ পেয়েছেন, তাঁর প্রীতি ও ভালােবাসা যে সব ব্যক্তি বা বস্তুর সংস্পর্শে উদ্দীপিত হয়েছে সেই একান্ত আপন জিনিসগুলিই প্রীতি ও সৌন্দর্যরসে আবিষ্ট করে সনেটগুলিতে প্রকাশ করেছেন।

কবি মধুসূদনের বিশিষ্ট ধ্যান-ধারণা, আবেগ-অনুভূতির বিচিত্রতার স্বাদ গ্রহণ ভিন্ন সনেটগুলির আর কোন আকর্ষণ নেই। লিরিক কবিতায় প্রার্থিত কবি ব্যক্তিত্বের আসঙ্গরস বাংলা কাব্যে মধুসূদনেই প্রথম পাওয়া যায়। এর সঙ্গে তার ‘আত্মবিলাপ’ এবং অনুরূপ আরও দুটি একটি উৎকৃষ্ট লিরিক কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়। ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় কবির সমগ্র জীবনের নিহিত বেদনা নির্যাসিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

মধুসূদন-পরবর্তীকালের দুজন প্রধান কবি হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র প্রচুর খণ্ড গীতিকবিতা রচনা করেছিলেন। হেমচন্দ্রের ‘কবিতাবলী’ গ্রন্থের দু খণ্ড ‘বিবিধ কবিতা’ ও ‘চিত্তবিকাশ’ নামক দুটি সংকলন এবং নবীনচন্দ্রের ‘অবকাশরঞ্জিনী’ দু খণ্ড উনবিংশ শতাব্দীর গীতিকবিতায় বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য সংযােজন। হেমচন্দ্রের রচনাবলীর মধ্যে ‘ভারত সঙ্গীত’, ‘পদ্মের মৃণাল’, ‘প্রভু কি দশা হবে আমার’ প্রভৃতি কবিতায় উচ্ছসিত দেশাত্মবােধক ও ব্যক্তি-জীবনের তীব্র দুঃখবােধ গীতিকাব্য রচনারই যােগ্য বিষয়। বাইরের বিচারে তার কবিতাকে গীতিকবিতাই বলতে হয়, কারণ এসব খণ্ডকাব্যে কবির ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির প্রকাশই মুখ্য প্রেরণা। কিন্তু হেমচন্দ্র আবেগ সংহতির অভাবে কবিতার রসসিদ্ধি আয়ত্ত করতে পারেন নি।

তার খণ্ডকবিতাগুলি গীতিকবিতারই নিদর্শন, কিন্তু শিথিলবদ্ধ রচনাভঙ্গি ও অনিয়ন্ত্রিত ভাবেচ্ছাসের জন্য রচনাগুলি কবিতা হিসেবে রসােত্তীর্ণ হয় নি। নবীনচন্দ্র সম্পর্কেও এই কথাই বলা চলে। আকৈশাের তিনি উদ্দীপ্ত ভাবাবেগ নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন, কিন্তু রসম্রষ্টা হিসেবে তাঁর কৃতিত্বও প্রশ্নাতীত নয়। তার প্রবল ভাবাতিরেক খণ্ডকাব্যগুলিকে গীতিকবিতার নিটোল রসরূপে উন্মীলিত হয়ে উঠতে দেয় নি। অন্তর্বর্তী ভাবপ্রেরণার চেয়ে বহির্ঘটনাআশ্রিত উদ্দীপনাই তার কবিতার বেশি। অতএব দেখা যাচ্ছে উন্নততর শিল্পবােধ এবং সংযমের অভাবে এই দুই কবির গীতিকাব্য রচনার প্রয়াস অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে।

সমসাময়িক পাঠক সমাজের দ্বারা স্বীকৃত এবং জনপ্রিয় কবিরূপে মধুসূদনের পরেই হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের নাম উল্লেখ করা হলেও বাংলা কাব্যে নতুন সুর যােজনার দিক থেকে তাদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাব্য-সৃষ্টির মর্যাদার অধিকারী বিহারীলাল চক্রবর্তী। তখনকার ইংরেজীনবিশ কবিদের স্বদেশানুরাগ এবং বীররসাত্মক মহাকাব্য রচনার উচ্চকণ্ঠ কোলাহলের মধ্যে বিহারীলালের আত্মমনস্ক কাব্যচর্চা তেমন সমাদর লাভ করেনি। না করাই স্বাভাবিক। এই আত্মনিমগ্ন কবি আপন ভাবলােকে এমনই সমাহিত যে পাঠক-সমাজ সম্পর্কে যেন অবহিতই ছিলেন না। শ্রোতা-নিরপেক্ষভাবেই তিনি আপন আনন্দ-বেদনার গান গেয়েছেন। কিন্তু তার রচনাবলী সমসাময়িক কাব্যিক পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থেকে পাঠ করলে সহজেই বােঝা যায় তিনি বাংলা কাব্যে সম্পূর্ণ এক নতুন সুরের স্রষ্টা।

মােহিতলালের একটি উক্তি এখানে স্মরণীয়- “বিহারীলালের কাব্য যেন আদি লিরিক জাতীয়, তাহার প্রেরণা একেবারে গীতাত্মক। বাহিরের বস্তুকে গীতিকবি নিজস্ব ভাব কল্পনায় মণ্ডিত করিয়া যে একটি বিশেষ রূপ ও রসের সৃষ্টি করেন, ইহা তাহা হইতেও ভিন্ন, কবি নিজের আনন্দে ধ্যানকল্পনার আবেশে, সর্বত্র নিছক ভাবের সাধনা করিয়াছেন; তাহার কাব্যের প্রধান লক্ষণ ভাববিভােরতা। তাহার কল্পনা অতিমাত্রায় Subjective; তিনি যখন গান করেন, তখন সম্মুখে শ্রোতা আছে এমন কথাও ভাবেন না। ভাবকে স্পষ্টরূপ দিবার আকাঙ্ক্ষাই তাহার নাই। কিন্তু এই আত্মনিমগ্ন কবির স্বতঃ-উৎসারিত গীতধারায় এমন সকল বাণী নিঃসৃত হয়, যাহাতে সন্দেহ থাকে না যে, তাহার মনােভূঙ্গ সরস্বতীর আসন-কমলের মর্মমধু পান করিয়াছে, সেই পদ্মের পরাগধুলি সর্বাঙ্গে মাখিয়া কবিজীবন সার্থক করিয়াছে।”

এই গীতাত্মক কবি প্রবৃত্তি, এই বিশুদ্ধ Subjective কল্পনা বস্তুত ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যে আর কোন কবির মধ্যেই দেখা যায় নি। বস্তুবিশ্বের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কাব্য সৃষ্টি সম্ভব নয়, কিন্তু বহির্জাগতিক অভিজ্ঞতা বিহারীলালে সহজেই গীতাত্মক অনুভূতিতে রূপান্তরিত হয়। একান্তভাবে অন্তর্মুখী ভাবকল্পনানির্ভর কবি বিহারীলালের কাব্যেই যথার্থভাবে আধুনিক গীতিকবিতার সূচনা হয়েছে। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালকে বাংলার গীতিকাব্যকাননে ‘ভােরের পাখি’ বলে অভিহিত করেছেন। বিহারীলালের কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯)।

এই কাব্যে কবি প্রেম, প্রীতি এবং সৌন্দর্য-চেতনার বিগ্রহরূপে সারদার মূর্তি কল্পনা করেছেন। সারদা দেবীর সঙ্গে কবির বিচিত্র সম্পর্কের লীলা এই কাব্যের বিষয়। এমন কাব্যবিষয় ইতিপুর্বে আর কোন কবির কাব্যে দেখা যায় না। প্রেম, প্রীতি, সৌন্দর্যবোধ প্রভৃতি যে সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি কবিমানসে এক অখণ্ড কল্পনার বৃত্তে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে সেই অনুভূতির পূর্ণায়ত রূপটিকেই তিনি সারদা মর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছেন। কবির কল্পনার জগৎটিকেই একমাত্র কাব্যবিষয়রূপে গ্রহণ করার এই দৃষ্টান্ত বাংলা কাব্যে এক নব-দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। সারদার উদ্দেশ্যে বিহারীলাল বলেন-

“তুমি বিশ্বের আলাে তুমি বিশ্বরূপিণী। 

প্রত্যক্ষে বিরাজমান, 

সর্বভূতে অধিষ্ঠান,

তুমি বিশ্বময়ী কান্তি, দীপ্তি অনুপমা, 

কবির যােগীর ধ্যান, 

ভােলাপ্রেমিকের প্রাণ,

মানব-মনের তুমি উদার সুষমা।”

এই সৌন্দর্য-প্রতিমার ধ্যান বাংলা কাব্যে সম্পূর্ণ অভিনব। সৌন্দর্য বা কাস্তিটুকু, প্রেমের পাত্র থেকে পৃথকভাবে প্রেমানুভূতিএকটা বিমূর্তভাবে কল্পনায় ধারণ করা এবং তারই বাণীমূর্তি নির্মাণের যে দৃষ্টান্ত বিহারীলালের কাব্যে দেখা গেল, তা একটা নতুন প্রেরণারূপে উত্তরকালের সকল কবিকেই প্রভাবিত করেছে। এই প্রেরণাই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি রবীন্দ্রনাথে সম্পূর্ণতা লাভ করেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.