Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা গদ্য সাহিত্যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান

বাংলা গদ্যসাহিত্যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অনন্য এবং গভীর। তার লেখার মধ্যে কাব্যিক সৌন্দর্য, শিল্পের আভিজাত্য, এবং বাঙালি সংস্কৃতির গভীরতা মিলেমিশে এক অসাধারণ গদ্যভাষার রূপ নিয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ মূলত চিত্রশিল্পী হলেও, সাহিত্যজগতে তার প্রবেশ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। সাহিত্য ও চিত্রকলার এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ অবনীন্দ্রনাথের গদ্যশিল্পে পরিলক্ষিত হয়, যা বাংলা গদ্যকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক যাত্রার শুরু হয় মূলত ছোটদের জন্য লেখা থেকে। ১৩০২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহে তিনি লেখার জগতে প্রবেশ করেন। তার প্রথম দিকের রচনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘শকুন্তলা’ এবং ‘ক্ষীরের পুতুল’। এসব রচনায় অবনীন্দ্রনাথ কেবল ছেলেমেয়েদের মজার গল্প বলার জন্য নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করেননি, বরং তিনি ভাষার প্রতি এক গভীর নান্দনিক বোধ দেখিয়েছেন। ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ ছড়া এবং লোককথার মিশ্রণ বাংলা শিশু সাহিত্যকে নতুন এক দিগন্তে নিয়ে যায়। তার গদ্যে ছন্দময়তা ও কাব্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি চিত্রকলার রূপময়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গদ্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য

অবনীন্দ্রনাথের গদ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার ভাষার সরলতা এবং সৌন্দর্য। বাংলা চলিত ভাষার নিজস্ব ভঙ্গি, যেটা কথ্য ও লিখিত ভাষার মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল, তা তিনি অনায়াসে ব্যবহার করেছেন। ‘রাজকাহিনী’ গ্রন্থে তিনি যে ভাষার ব্যবহার করেছেন, তা ছিল কথ্য ও লিখিত ভাষার সুন্দর সমন্বয়। সেই ভাষার সরলতা এবং মাধুর্য কেবল শিশুসাহিত্য নয়, বড়দের জন্য লেখা রচনাগুলোকেও সহজ ও রসময় করেছে।

অবনীন্দ্রনাথ তার গদ্যে কল্পনার জগৎকে সহজভাবে ফুটিয়ে তোলেন। যেমন তার ‘চাইবুড়ার পুঁথি’, ‘মারুতির পুঁথি’ এবং ‘গোল্ডেন গুজ পালা’ প্রভৃতি রচনাগুলিতে কল্পনার এমন এক জগত তৈরি হয়েছে, যেখানে চিত্রশিল্পের রূপময়তা এবং কথকতার সরলতা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। এই রচনাগুলিতে তার কথকতার দক্ষতা এবং ভাষার ছন্দময়তা এক অদ্ভুত শিল্পরূপে ফুটে উঠেছে।

গদ্যের ছবিময়তা

অবনীন্দ্রনাথের গদ্য অনেক সময়ে চিত্রের মতো মনে হয়। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “অবনঠাকুর ছবি লেখে।” তার গদ্যশিল্পে আমরা শব্দ দিয়ে চিত্র আঁকার এক আশ্চর্য ক্ষমতা দেখতে পাই। তার গদ্যের বাক্যে যেমন মাধুর্য থাকে, তেমনি বাক্যের গঠন এবং শব্দের বুনট ছবির মতো স্পষ্ট। তার রচনায় ‘রাজকাহিনী’ বা ‘নালকে’-র মতো রূপকথার কাহিনীগুলি চিত্রকলার মিনিয়েচার পেন্টিংয়ের মতো নিখুঁত ও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। ‘নালকে’-র ধোঁয়াটে বর্ণনা যেন তার চিত্রকলার রূপকল্পকেই প্রকাশ করে।

অবনীন্দ্রনাথের লেখা শুধু চিত্রধর্মী নয়, সঙ্গীতের ছোঁয়াও আমরা পাই তার গদ্যে। যেমন ‘বুড়ো আঙলা’-তে যে সুরেলা ছন্দ রয়েছে, তা তার গদ্যকে সঙ্গীতময় করে তোলে। এতে কেবল গল্প নয়, একটা রিদম, একটা সুর মিশে যায় যা পাঠককে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। এই বৈশিষ্ট্য তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে আলাদা করে এবং তার গদ্যের স্বকীয়তা নিশ্চিত করে।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন

অবনীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে বাঙালি সংস্কৃতির গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার গল্পে পুরনো বাংলার ঐতিহ্য, কাহিনী, পুরাণের মিশ্রণ ঘটে। ‘রাজকাহিনী’-র গল্পগুলোতে রাজপুত ও মুঘল সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটলেও, সেগুলি বাঙালির রূপকথার আঙ্গিকে লেখা হয়েছে। ‘রাজকাহিনী’তে যেমন রাজাদের বীরত্ব, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের গল্প রয়েছে, তেমনি এসব গল্পে বাংলার মানুষের কল্পনা, অনুভূতি, এবং ঐতিহ্যের ছোঁয়াও পাওয়া যায়।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাগীশ্বরী শিল্পপ্রবন্ধাবলী’ তার শিল্প-ভাবনার গভীরতাকে প্রকাশ করে। এই প্রবন্ধগুলোতে তিনি ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাস, শৈলী, এবং তার প্রকৃতির উপর আলোকপাত করেছেন। ১৯২১ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তার প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির সংকলন এই প্রবন্ধমালা বাংলা শিল্প-সাহিত্যকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। তিনি ভারতীয় চিত্রকলার ষড়ঙ্গ (রূপ, রং, ছন্দ, ভাব, লক্ষণ, এবং প্রসাদ) নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা তার চিত্রশিল্পের মূল ভাবনার প্রতিফলন।

ভাষা ও শব্দকৌশল

অবনীন্দ্রনাথের গদ্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তার শব্দ নিয়ে খেলার ক্ষমতা। তার ভাষায় ছন্দময়তা যেমন ছিল, তেমনি ছিল শব্দের দক্ষ ব্যবহার। তিনি প্রায়ই স্ল্যাং বা সাধারণ কথ্যভাষার শব্দ ব্যবহার করতেন, যা তার গদ্যকে ঘরোয়া এবং অন্তরঙ্গ করত। তবে, তার ব্যবহৃত স্ল্যাং কখনোই অশ্লীল বা রুচিহীন হতো না, বরং তার ব্যবহারে সেই শব্দগুলো রঙিন এবং রসময় হয়ে উঠত।

অবনীন্দ্রনাথের গদ্যে যেমন রূপকথার কল্পনাপ্রবণতা ছিল, তেমনি ছিল রিয়ালিজমের ছোঁয়া। তিনি ছোট ছোট শব্দের মাধ্যমে গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতেন। যেমন:

“গোদা চিল সারাদিন বসে ভাবত আর থেকে থেকে চিললাত—চির আঁচির, পাচির, মাসির।”

এই রকম ছোট ছোট বাক্যে, তিনি কল্পনার জগৎকে এক বাস্তব জগৎ হিসেবে তুলে ধরতে পারতেন, যেখানে ভাষার ছন্দ, শব্দের বুনট, এবং কল্পনার মিলন ঘটে।

প্রবন্ধসাহিত্য ও অবনীন্দ্রনাথ

অবনীন্দ্রনাথের প্রবন্ধসাহিত্যও বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তার লেখা প্রবন্ধগুলোতে গভীর চিন্তাশীলতা এবং উচ্চমাত্রার বুদ্ধিবৃত্তিকতা বিদ্যমান। ‘বাগীশ্বরী শিল্পপ্রবন্ধাবলী’, ‘ভারত শিল্পের ষড়ঙ্গ’ ইত্যাদি প্রবন্ধে তিনি শিল্পকলার নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন, যা পরবর্তীকালে বাংলা শিল্পসাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার প্রবন্ধগুলোতে ভারতীয় শিল্পকলার প্রতি তার অনুরাগ এবং পাশ্চাত্য চিত্রকলার সঙ্গে তুলনা করে ভারতীয় শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা ছিল উল্লেখযোগ্য।

অবনীন্দ্রনাথের সাহিত্যের স্থায়ী প্রভাব

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যশিল্প বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি বিশেষ অর্জন। তার সাহিত্যিক দক্ষতা, ভাষার প্রতি তার সূক্ষ্ম বোধ, এবং কল্পনার বিচিত্র জগৎ বাংলা গদ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব থাকলেও, অবনীন্দ্রনাথ তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন।

তার গদ্যশৈলী শিশুদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি বড়দের মনকেও ছুঁয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক অবদান অমলিন থাকবে। তিনি কেবলমাত্র একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে নয়, একজন অসাধারণ সাহিত্যিক হিসেবেও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.