বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) একটি অমর নাম। তিনি বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতিতে যেমন বিশেষ অবদান রেখেছেন, তেমনি পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস ও বৌদ্ধধর্মের গবেষণায়ও নিজেকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি জ্ঞানচর্চায় গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং ইতিহাস ও সাহিত্য সমানভাবে চর্চা করেছেন। তার প্রবন্ধ, উপন্যাস, এবং গবেষণামূলক রচনাগুলি বাংলা সাহিত্যের গদ্যভাষার বিকাশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। তার রচনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তথ্যের সঠিকতা, বাচনভঙ্গির সরলতা এবং বিষয়বস্তুর গভীরতা।
এই ব্লগে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাহিত্যিক অবদান এবং গদ্য সাহিত্যে তার সার্থকতা নিয়ে একটি বিস্তৃত মূল্যায়ন তুলে ধরা হবে। তার জীবন, সাহিত্যিক কর্ম, প্রবন্ধ সাহিত্য এবং উপন্যাসের বিভিন্ন দিকগুলো পর্যালোচনা করা হবে।
১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জীবনী ও প্রেক্ষাপট
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জীবন ও কর্মের বিশ্লেষণ শুরু করার আগে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা প্রয়োজন। তিনি ১৮৫৩ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জামালপুর জেলার কাশিমবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার ইচ্ছায় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হলেও, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি মেধাবী এবং জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। তার বিদ্যাচর্চার প্রাথমিক প্রভাব ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পুরাতত্ত্ব চর্চা। এই দুই ব্যক্তিত্ব তার মননে গভীর প্রভাব ফেলে।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় তার প্রবন্ধগুলো প্রকাশের মাধ্যমে হরপ্রসাদ সাহিত্যে প্রবেশ করেন। সেই সময়ের জন্য এটি ছিল একটি বড়ো সুযোগ, যা তার সাহিত্যিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দেয়। ইতিহাস ও পুরাবৃত্তি চর্চায়ও তার আগ্রহ ছিল গভীর, যা পরবর্তীতে তার গবেষণামূলক রচনাগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়।
২. বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে হরপ্রসাদের ভূমিকা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাহিত্যিক অবদান বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি বাংলা গদ্য ভাষার বিকাশে অগ্রগণ্য ছিলেন এবং তার রচনায় ভাষার সাবলীলতা ও বর্ণনার স্বচ্ছতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলা গদ্যের প্রাথমিক পর্যায়ে বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের সঙ্গে তার রচনাগুলি গদ্য সাহিত্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
২.১ প্রবন্ধ সাহিত্য
প্রাবন্ধিক হিসেবে হরপ্রসাদের কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার প্রবন্ধগুলি শুধুমাত্র তথ্যনির্ভর ছিল না, বরং সাহিত্যিক শৈলীতেও সমৃদ্ধ ছিল। তার রচিত প্রবন্ধগুলি বঙ্গদর্শন, আর্য দর্শন, সাহিত্য, নব্যভারত, সাহিত্যমুখী পত্রিকা ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীরতা তুলে ধরেছেন, তবে তার লেখায় কোনো দুর্বোধ্যতা ছিল না। এর কারণ, তিনি সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে লিখতেন। তার লেখায় সর্বদা একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৌতুকবোধ কাজ করতো, যা প্রবন্ধগুলিকে সহজ, রমণীয় এবং সুপাঠ্য করে তুলতো। তার প্রবন্ধে বাচনভঙ্গির সজীবতা এবং সাধুভাষার কাঠামোয় কথ্যভাষার মিলন তাকে অন্যান্য লেখকদের তুলনায় আলাদা করেছে।
২.২ ইতিহাস ও সংস্কৃতি
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর গবেষণায় প্রাচীন বাংলা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি গভীর অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। তিনি প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ ও গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার উদ্যোগে খুঁজে পাওয়া “চর্যাপদ” প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের এক অতীব মূল্যবান নিদর্শন, যা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কবিতার সংকলন বলে মনে করা হয়।
তিনি ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য অনেক দূর দেশে ভ্রমণ করেছেন এবং নিজের লেখার মাধ্যমে সেই ইতিহাসের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। তার রচিত গ্রন্থ ‘প্রাচীন বাংলার গৌরব’ ইতিহাস ও পুরাবৃত্তি চর্চায় একটি অমূল্য সংযোজন। এই গ্রন্থে তিনি বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নানা দিক বিশদভাবে তুলে ধরেছেন।
৩. উপন্যাস ও সৃষ্টিশীল রচনা
প্রবন্ধের পাশাপাশি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সৃষ্টিশীল সাহিত্যেও বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার রচিত ‘বেনের মেয়ে’ এবং ‘কাঞ্চনমালা’ উপন্যাস দুটি বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
৩.১ ‘বেনের মেয়ে’
হরপ্রসাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘বেনের মেয়ে’ (১৯২২)। এটি একটি ঐতিহাসিক আখ্যায়িকা, যেখানে প্রাচীন বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়েছে। এই উপন্যাসে তিনি দশম-একাদশ শতাব্দীর বাংলার বৌদ্ধ সমাজের জীবন ও পরিবেশ জীবন্তভাবে চিত্রিত করেছেন। উপন্যাসটির পাত্র-পাত্রীরা কাল্পনিক হলেও পরিবেশের বাস্তবতা এবং ঐতিহাসিক সত্যের গভীরতা এটি পাঠকদের মুগ্ধ করে। সুকুমার সেনের মতে, ‘বেনের মেয়ে’ বাংলা গদ্যের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
৩.২ ‘কাঞ্চনমালা’
‘কাঞ্চনমালা’ (১৯১৬) হরপ্রসাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, যেখানে সামাজিক মূল্যবোধ এবং নারী জীবনের জটিলতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই উপন্যাসে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন এবং নারীর আত্মমর্যাদার প্রশ্ন নিয়ে হরপ্রসাদ আলোচনা করেছেন। নারী চরিত্রের প্রতি তার সংবেদনশীলতা এবং সামাজিক বাস্তবতার নিরীক্ষা তাকে অন্যান্য সমকালীন লেখকদের চেয়ে আলাদা করেছে।
৪. ভাষার প্রাঞ্জলতা ও রমণীয়তা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে তার প্রাঞ্জলতা ও সরলতার কথা উল্লেখ করতে হয়। তার লেখায় তিনি যেভাবে সাধুভাষার ব্যবহার করেছেন, তাতে কথ্যভাষার সজীবতা যুক্ত করে একটি নতুন ধারা প্রবর্তন করেছেন। তার প্রবন্ধ ও উপন্যাসে ভাষার স্বচ্ছতা এবং সাবলীলতা পাঠকদের মুগ্ধ করেছে। শাস্ত্রীমশাইয়ের ভাষার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি উল্লেখযোগ্য:
“শাস্ত্রী মহাশয় বাংলা ভাষায় একজন প্রধান নিবন্ধকার ছিলেন। তিনি কেবল ইতিহাস ও সাহিত্য লইয়াই নহে, উপরন্তু আধুনিক বাঙালির জীবনের ছােটো খাটো নানা সমস্যা লইয়াও আলােচনা করিয়াছেন। তাহার প্রবন্ধের মধ্যে লক্ষণীয় তাহার বিচারশৈলীর যৌক্তিকতা, তাহার রচনাভঙ্গির। সাবলীলতা এবং মধ্যে মধ্যে হাস্যরসের অবতারণায় তাঁহার রােচকতা এবং সর্বোপরি, তাহার ভাষার প্রাঞ্জলতা।”
হরপ্রসাদ তার লেখায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন, তবে তার লেখার বাচনভঙ্গি সর্বদা সহজবোধ্য এবং প্রাণবন্ত ছিল। তার প্রবন্ধে হাস্যরস, কৌতুকবোধ এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। পাঠকের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার মতো তার লেখার ভঙ্গি বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন।
৫. হরপ্রসাদের গবেষণার সার্থকতা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একজন প্রতিভাবান গবেষকও ছিলেন। তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল প্রাচীন বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্ম। বিশেষ করে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শনগুলির অনুসন্ধানে বিশেষভাবে কৃতিত্ব অর্জন করেন।
৫.১ চর্যাপদ আবিষ্কার
তার গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারে ‘চর্যাপদ’ পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার। এই আবিষ্কার বাংলা ভাষার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ ‘চর্যাপদ’ হলো বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য সংকলন। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের শিকড় সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয় এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
৫.২ বৌদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অবদান
হরপ্রসাদের গবেষণার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বৌদ্ধ সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রতি তার অবদান। তিনি বৌদ্ধধর্ম এবং তার প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেন। তার গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বৌদ্ধধর্ম’ এবং প্রবন্ধগুলি বাংলা এবং ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি মূল্যবান দিক উন্মোচন করেছে।