বাংলা গদ্য সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের অবদান অপরিসীম এবং উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজের নবরূপ নির্মাণে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। মাত্র তিরিশ বছর (১৮৪০-৭০ খ্রিষ্টাব্দ) বেঁচে থাকলেও, কালীপ্রসন্ন তার স্বল্পায়ু জীবনে বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে যে অবদান রেখেছেন, তা আজও অনন্যসাধারণ। তার সাহিত্যকর্ম, সমাজসেবা, ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন পদক্ষেপ বাঙালি সমাজকে নতুন রূপে গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে।
কালীপ্রসন্ন সিংহ ও বিদ্যোৎসাহিনী সভা
কালীপ্রসন্ন সিংহ বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে তার ভূমিকা রাখার প্রথম পদক্ষেপ নেন যখন তিনি মাত্র চতুর্দশবর্ষীয় তরুণ। ১৮৫৩ সালে, তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্যে একটি সভা প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র রূপ নেয়। এই সভার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলা সাহিত্যচর্চা করা এবং সাহিত্যিকদের বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদান করা। কালীপ্রসন্ন নিজে এই সভায় তার রচিত কবিতা ও প্রবন্ধ পাঠ করতেন। এই সভায় প্যারীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, কৃষ্ণদাস পাল প্রমুখ খ্যাতনামা সাহিত্যিক এবং মনীষীরা অংশগ্রহণ করতেন। শুধু বাঙালি সাহিত্যিকরাই নয়, সভায় তখনকার ইংরেজ শিক্ষাবিদদেরও আমন্ত্রণ জানানো হতো, যাতে তারা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন।
বিদ্যোৎসাহিনী সভার মুখপত্র ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’ প্রতি মাসে সভার সদস্যদের রচনা নিয়ে প্রকাশিত হতো। এভাবে কালীপ্রসন্নের উদ্যোগে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি সুদৃঢ় ভিত্তি গড়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ প্রবর্তনের জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সম্মাননা দেওয়ার ঘটনা বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
কালীপ্রসন্নের সমাজসেবামূলক অবদান
সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাশাপাশি কালীপ্রসন্ন সিংহ সমাজসেবায়ও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের জন্য যখন পাদ্রী জেমস লঙকে দণ্ডিত করা হয়, তখন কালীপ্রসন্ন বিচারকক্ষে তার জরিমানা হিসেবে ধার্য করা এক হাজার টাকা পরিশোধ করেছিলেন। এটি শুধু কালীপ্রসন্নের উদার মানসিকতার পরিচয়ই দেয় না, এটি সমাজ সংস্কারের জন্য তার অঙ্গীকারকেও স্পষ্ট করে।
বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চের প্রতিষ্ঠা
কালীপ্রসন্ন সিংহ বিদ্যোৎসাহিনী সভার উদ্যোগে ১৮৫৬ সালে কলকাতায় ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’ স্থাপন করেন। এই রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের বিখ্যাত নাটক ‘বেণীসংহার’, কালীপ্রসন্নের নিজের লেখা নাটক ‘বিক্রমোর্ব্বশী’ এবং ‘সাবিত্রী-সত্যবান’ অভিনীত হয়। এই উদ্যোগ বাংলা নাট্যজগতের বিকাশে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কালীপ্রসন্নের এই প্রচেষ্টার ফলে বাংলা থিয়েটার সংস্কৃতি গঠনমূলক একটি মঞ্চ পায় এবং এটি বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে ওঠে।
হুতোম প্যাচার নকশা: ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্যে এক বিপ্লব
কালীপ্রসন্ন সিংহ বাংলা গদ্য সাহিত্যে তার সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন তার বিখ্যাত রচনা ‘হুতোম প্যাচার নকশা’ (১৮৬১) প্রকাশের মাধ্যমে। এই ব্যঙ্গাত্মক গ্রন্থ বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে একটি অনন্য স্থান দখল করেছে। যদিও সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে এটি তার রচনা নয়, বরং ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই বিষয়ে সুনিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কালীপ্রসন্নকেই এই গ্রন্থের লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়।
‘হুতোম প্যাচার নকশা’ ছিল তৎকালীন কলকাতার সমাজজীবনের একটি বাস্তব এবং ব্যঙ্গাত্মক ছবি। এই রচনায় তিনি কলকাতার ধনী পরিবারের সন্তানদের ভোগবিলাস ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রার চিত্র অঙ্কিত করেছেন। কালীপ্রসন্ন এখানে সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, বড়লোকদের বিকৃতরুচি এবং কুৎসিত আমোদপ্রমোদকে ব্যঙ্গ করেছেন। যেমন ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসটি প্যারীচাঁদ মিত্র লিখেছিলেন, যা ছিল তৎকালীন বাবু সম্প্রদায়ের বিলাসী জীবনযাত্রার একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রতিচ্ছবি, তেমনি ‘হুতোম প্যাচার নকশা’ও সেই ধাঁচে লেখা হলেও এটি একেবারে ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র। এতে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার মাধ্যমে ব্যঙ্গাত্মক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, যা বাংলার গদ্য সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে।
হুতোম প্যাচার নকশার ভাষা ও শৈলী
‘হুতোম প্যাচার নকশা’র ভাষা ছিল সম্পূর্ণ কথ্য। বাংলার সাহিত্যিক ভাষায় যে সাধু রীতির প্রচলন ছিল, কালীপ্রসন্ন সেই ধারা ভেঙে কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিয়েছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র এবং ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই সাধু ভাষার শৃঙ্খল ভেঙেছিলেন, কিন্তু কালীপ্রসন্ন কথ্য ভাষাকে সাহিত্যিক ভাষারূপে ব্যবহার করেছিলেন। এই সাহসী পদক্ষেপই তাকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে আলাদা স্থান করে দেয়।
প্রফেসর পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “বাংলা সাহিত্যে হুতোম প্যাচার নকশা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি বাংলা গদ্য সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তন করে। এর আগের সমস্ত সাহিত্য সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ ছিল, কিন্তু কালীপ্রসন্ন সম্পূর্ণ চলিত ভাষায় লিখেছেন এবং এই রচনায় কথ্য ভাষার নিজস্ব লঘুত্ব এবং গুরুত্ব দুটিই রয়েছে।”
মহাভারতের অনুবাদ ও কালীপ্রসন্নের সাহিত্যে অবদান
কালীপ্রসন্ন সিংহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক অবদান হলো বেদব্যাসের মহাভারতের বাংলা অনুবাদ। সাতজন পণ্ডিতের সাহায্যে দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমে (১৮৬০-৬৬) তিনি এই মহান ধর্মগ্রন্থের সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন। কালীপ্রসন্ন মাত্র বিশ বছর বয়সেই এই মহাকাব্যের অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন, যা ছিল তার মনীষা এবং অধ্যবসায়ের চমৎকার উদাহরণ। এমন একটি কাজ সম্পন্ন করা সেই সময়ে ছিল এক অত্যন্ত কঠিন কাজ, কিন্তু কালীপ্রসন্ন তার কর্মে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন এবং সফলভাবে তা সম্পন্ন করেন।
এই অনুবাদ কার্য বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায় শুরু হয়েছিল এবং বিদ্যাসাগরও তাকে এই কাজে সহায়তা করেছিলেন। মহাভারতের তিন হাজার কপি তিনি ছাপিয়েছিলেন এবং তা বিনামূল্যে বিতরণ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এই মহাভারতের অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে এক অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।
কালীপ্রসন্নের মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
মাত্র তিরিশ বছর বয়সে ১৮৭০ সালে কালীপ্রসন্ন সিংহের মৃত্যু হলেও তার অবদান বাংলা সাহিত্য এবং সমাজের অঙ্গনে আজও জীবন্ত। তার অমর রচনা এবং সাংস্কৃতিক উদ্যোগ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।