সাহিত্যে কথ্যরীতির গদ্যভাষাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরী। ১৯১৪ সালে তিনি ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা প্রকাশ করে এই গদ্যরীতির প্রচারে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথও তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গদ্য রচনায় চলতি ভাষার ব্যবহার শুরু করেন, যার ফলে সাহিত্যে চলিত ভাষা অনিবার্যভাবে স্বীকৃতি পায়। বাংলা গদ্যের শুরু থেকে সাধু এবং চলিত রীতির মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তা এইভাবেই সমাধান হয়। ১৮০০ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, বাংলা গদ্যে সাধু ও চলিত রীতির মধ্যে বিরোধ চলছিল।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, যাদের লেখা গদ্যে সংস্কৃত পদের আধিক্য এবং সাধু ক্রিয়াপদের প্রয়োগ দেখা যেত। তবে রামরাম বসু এবং উইলিয়াম কেরি কথ্যভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করেন। রামরামের ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ এবং কেরির ‘কথোপকথন’ উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তবুও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সাধু রীতিই প্রতিষ্ঠিত হয়।
রামমোহনের যুগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যঙ্গ রচনায় কথ্যভঙ্গির ওপর নির্ভর করতে চেষ্টা করেন। তাঁর ‘নববাবু-বিলাস’ (১৮২৫) গ্রন্থের ভাষা কথ্যরীতিনির্ভর ছিল। রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগর রক্ষণশীল সমাজের বিরাগভাজন হলেও, বিদ্যাসাগর কয়েকটি রচনায় সাধুভাষা ত্যাগ করে চলিত ভাষা ব্যবহার করেন। বঙ্কিম-পূর্ব যুগের অনেক লেখক প্রয়োজন অনুসারে কথ্যরীতির গদ্য ব্যবহার করলেও, সে সময়ে এই গদ্যরীতির শক্তি এবং আদর্শ তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এই পটভূমিতে প্যারীচাঁদ মিত্রের (১৮১৪-১৮৮৩) সাহিত্যচর্চা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি ভাষারীতির সমস্যার প্রতি সচেতন ছিলেন এবং নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করতেন। প্যারীচাঁদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভাষা বিষয়ে সচেতনতা এবং মৌলিক সৃজনশীলতা। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সম্পর্কে বলেন, তৎকালীন বাংলা সাহিত্য বিদ্যাসাগরের গঠিত ভাষা সুমধুর হলেও তা সর্বজনবোধ্য ছিল না। প্যারীচাঁদই প্রথম কথ্যরীতির গদ্য ব্যবহার করেন এবং ইংরেজি ও সংস্কৃতের চিরাচরিত পথ অনুসরণ না করে স্বভাবের ভাণ্ডার থেকে রচনার উপাদান সংগ্রহ করেন। তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থে এই উভয় লক্ষ্য সফল হয়।
১৮৫৪ সালে প্যারীচাঁদ ‘মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশ করেন, যেখানে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল যে পত্রিকার সমস্ত লেখা চলিত ভাষায় রচিত হবে। এর মাধ্যমে প্যারীচাঁদ বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। এই পত্রিকাতেই তিনি টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন, যা ১৮৫৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, “এই বাংলা ভাষায় প্রথমবার দেখানো হলো যে, সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত এবং প্রচলিত বাংলায়ও সাহিত্য রচনা সম্ভব। তাতে রচনাগুলি সুন্দর হতে পারে এবং এমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে, যা সংস্কৃতের সঙ্গে যুক্ত ভাষায় পাওয়া কঠিন। বাঙালি জাতির পক্ষে এটাই ছিল একটি বড় প্রাপ্তি, এবং এরপর থেকে বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতি অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে।”
“আলালের ঘরের দুলাল” এর ভাষা আদর্শ নয়। তবে এই বই প্রমাণ করে যে প্রচলিত বাংলা ভাষাও ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে সংস্কৃতনির্ভর ভাষার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। প্যারীচাঁদের প্রভাবে, পরবর্তী লেখকরা সংস্কৃতের রীতি ও কথ্য ভাষার গদ্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে আদর্শ গদ্যভাষা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কারণেই বাংলা গদ্যভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে “আলালের ঘরের দুলাল” এর গুরুত্ব অপরিসীম। এতে কলকাতার নাগরিক জীবনের বাস্তব ও জীবন্ত চিত্রণ পাওয়া যায়, যেমন—“রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে, কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে, বলদেরা গরু লইয়া চলিয়াছে, ধোপার গাধা থপাস ২ করিয়া যাইতেছে, মাছের ও তরকারির বাজরা হু হু করিয়া আসিতেছে…”
প্যারীচাঁদের ভাষারীতি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার নিদর্শন হিসেবে গ্রহণযোগ্য হলেও এর সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাঁর ভাষা সমসাময়িকদের দ্বারা প্রশংসিত হলেও, আধুনিক যুগে ভাষার বিশুদ্ধতা নিয়ে সচেতনতা বাড়ায়, তাঁর ভাষারীতিতে সামঞ্জস্যের অভাব কিছুটা বিরক্তিকর মনে হয়।
অধ্যাপক ভট্টাচার্য তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন, “প্যারীচাঁদ মূলত বিদ্যাসাগরের সাধুরীতি গ্রহণ করেছিলেন, তবে তৎসম শব্দের পরিবর্তে প্রচুর দেশি ও বিদেশি শব্দ এবং কথ্যভাষার ব্যবহার করেছেন। ফলে সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ এবং পরিমিতির অভাব হয়েছে।…”
“আলালের ঘরের দুলাল” শুধু ভাষার দিক থেকেই নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবেও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক তুলে ধরে বাস্তব জীবনের চিত্রায়ণ উপন্যাসের মূল দায়িত্ব। প্যারীচাঁদই প্রথম এই সম্পর্কের টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ কাহিনী উপস্থাপন করেছেন।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ঠকচাচা এই উপন্যাসের সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র। এর মধ্যে এমন কৌশল ও স্তোকবাক্যের মিশ্রণ ঘটেছে যা পরবর্তী উন্নত উপন্যাসেও পাওয়া যায় না।… আলালের ঘরের দুলালে কথ্যভাষার প্রয়োগে চরিত্রচিত্রণ আরও বাস্তব হয়েছে।”
প্যারীচাঁদের রচনাশৈলী অনুসরণ করেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর “হুতোম প্যাঁচার নকশা”য় বাবুদের বিলাসী জীবনযাত্রা এবং কলকাতার সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। চলতি ভাষার ব্যবহারে কালীপ্রসন্ন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র প্যারীচাঁদের রচনার গুরুত্ব নির্দেশ করে বলেছেন, “বাংলা ভাষার এক প্রান্তে তারাশঙ্করের ‘কাদম্বরী’ অনুবাদ, আর অন্য প্রান্তে প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। তারা কেউই আদর্শ ভাষায় লিখিত নয়। কিন্তু ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে বাঙালি লেখক শিখল যে, এই দুই ভাষার সংমিশ্রণ করে আদর্শ গদ্য সৃষ্টি করা যায়। প্যারীচাঁদ বাংলা গদ্যের উন্নতির পথপ্রদর্শক ছিলেন, আর এটাই তাঁর অবিনশ্বর কীর্তি।”