Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা গদ্য রচনার ধারায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও ‘হুতোম প্যাচার নকশা’র অবদান

সাহিত্যে কথ্যরীতির গদ্যভাষাকে স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরী। ১৯১৪ সালে তিনি ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা প্রকাশ করে কথ্যরীতির গদ্য প্রচারের জন্য জোরালাে আন্দোলন গড়ে তােলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সকল প্রকার গদ্য রচনায় চলতি ভাষা ব্যবহার করতে আরম্ভ করায় সাহিত্যে চলিত ভাষা তর্কাতীতভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলা গদ্যের উদ্ভব কাল থেকে সাধুরীতি এবং চলতি রীতির মধ্যে যে বিরােধ চলে আসছিল- এইভাবেই তার সমাধান হয়। ১৮০০ সাল থেকে ১৯১৪, অর্থাৎ এক শতাব্দীরও বেশি সময় বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে সাধু ও চলিত রীতিঘটিত বিরােধ-বিতর্ক একটানা চলে আসছে। ফোর্ট উইলিয়ম-এর লেখকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। সংস্কৃত পদের বাহুল্য এবং ক্রিয়াপদের সাধুরূপের ব্যবহার তাদের অধিকাংশ গদ্য রচনায় ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে রামরাম বসু এবং উইলিয়ম কেরি কথ্যভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করেন। রামরামের ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ এবং ‘কেরির কথোপকথন’ এইদিক থেকে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য রচনা। কিন্তু সাধারণভাবে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ভাষারীতিতে বাংলা গদ্যের সাধুরীতিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। রামমােহনের যুগে মােটামুটিভাবে কথ্যভঙ্গির ওপরে নির্ভর করতে চেষ্টা করেছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবানীচরণ ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কলকাতাকে কেন্দ্র করে নতুন বাঙালী সমাজের বিকার বিকৃতি ছিল তাঁর বিদ্রাপের লক্ষ্য। বাস্তব জীবনের ছবি ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে স্বভাবতঃই তাঁকে অনেক পরিমাণে লােকপ্রচলিত ভাষার ওপরে নির্ভর করতে হয়েছে। তার ‘নববাবু-বিলাস’ (১৮২৫) গ্রন্থের ভাষা এই কারণেই কথ্যরীতি নির্ভর হয়ে উঠেছে। রামমােহন রায় এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর মশাই তাদের সংস্কারমূলক আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে রক্ষণশীল সমাজের বিরাগভাজন হন। পত্র-পত্রিকায় তাদের উদ্দেশ্যে যে কটুক্তি করা হত অনেক সময়ে তারা সেই সব আলােচনার উত্তর দিয়েছেন। বিদ্যাসাগর এই জাতীয় কয়েকটা রচনায় গম্ভীর চালের সাধুভাষা পরিত্যাগ করে বঙ্গব্যঙ্গমুখর চলতি ভাষাই ব্যবহার করেছেন। দেখা যাচ্ছে বঙ্কিম-পূর্ব যুগের অনেক লেখকই প্রয়ােজনবােধে কথ্যরীতির গদ্য ব্যবহার করেছেন। তবুও একথা সত্য যে বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার, দেবেন্দ্রনাথের হাতে সাধু ভাষার পরিণতি যে পর্যায়ে পৌছেছে তার তুলনায় কথ্যরীতির গদ্যের কোন স্থির আদর্শ গড়ে ওঠেনি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বাহনরূপে কথ্যরীতির গদ্যের শক্তি কেউ পরীক্ষা করে দেখেন নি।

এই পটভূমিতে প্যারীচাঁদ মিত্রের (১৮১৪-৮৩) সাহিত্যচর্চার ইতিবৃত্ত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভাষারীতির সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা এবং একটা নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণের চেষ্টা প্যারীচাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। হিন্দু কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত প্যারীচাঁদ তখনকার মনীষীদের তুলনায় কোনদিক থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। মনীষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার সৃজনক্ষম প্রতিভা। ভাষা-বিষয়ে সচেতনতা এবং মৌলিক সৃষ্টি-প্রতিভাপ্যারীচাদের এই দুই বিশেষত্ব-সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে তৎকালীন বাংলা সাহিত্য বিদ্যাসাগরের হাতে যে ভাষা গড়ে উঠেছিল তা ‘সুমধুর ও মনােহর হলেও সর্বজনবােধগম্য ছিল না। দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে “সংস্কৃত বা ইংরেজী গ্রন্থের সার সংকলন বা অনুবাদ ভিন্ন বাংলা সাহিত্য আর কিছুই প্রসব করিত না; বাঙালী লেখকেরা গতানুগতিকের বাহিরে হস্ত প্রসারণ করিতেন না।” “এই দুইটি গুরুতর বিপদ হইতে প্যারীচাদ মিত্রই বাংলা সাহিত্যকে উদ্ধৃত করেন। যে ভাষা সকল বাঙালীর বােধগম্য এবং সকল বাঙালী-কর্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যবহার করিলেন এবং তিনিই প্রথম ইংরেজী ও সংস্কৃতের ভাণ্ডারে পূর্বগামী লেখকদিগের উচ্ছিষ্টাবশেষের অনুসন্ধান না করিয়া, স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার হইতে আপনার রচনার উপাদান সংগ্রহ করিলেন। এক ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামক গ্রন্থে এই উভয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল।”

১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে প্যারীচাদ তার বন্ধু রাধানাথ শিকদারের সহযােগিতায় মাসিক পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। স্পষ্টভাবে ঘােষণা করা হয়, এই পত্রিকায় “যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক।” অর্থাৎ কথ্যরীতির গদ্যই হবে এই পত্রিকার সমস্ত রচনার ভাষা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার সঙ্গে সাধারণ বাঙালী পাঠকদের পরিচয় সাধনের জন্য সাধারণ মানুষের প্রবন্ধাদি রচনার মাধ্যমে প্যারীচাদ এইভাবে বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন আবহাওয়া সৃষ্টি করলেন।

এই পত্রিকাতেই তিনি টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ধারাবাহিকভাবে ‘আলালের ঘরের দুলাল প্রকাশ করেন। আলালের ঘরের দুলাল বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস, স্বাধীন কল্পনা দ্বারা সৃষ্ট বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ এবং কথ্যরীতিতে রচিত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে।

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, “উহাতেই প্রথম এই বাংলাদেশে প্রচারিত হইল যে, যে বাংলা সর্বজনমধ্যে কথিত এবং প্রচলিত, তাহাতে গ্রন্থ রচনা করা যায়। সেই রচনা সুন্দরও হয় এবং যে সর্বজন-হৃদয়-গ্রাহিতা সংস্কৃতানুযায়ী ভাষার পক্ষে দুর্লভ, এই ভাষার তাহা সহজ গুণ। এই কথা জানিতে পারা বাঙালী জাতির পক্ষে অল্প লাভ নহে, এবং এই কথা জানিতে পারার পর হইতে উন্নতির পথে বাংলা সাহিত্যের গতি অতিশয় দ্রুতবেগে চলিতেছে।” আলালের ঘরের দুলালের ভাষা আদর্শ ভাষা নয়। কিন্তু এই গ্রন্থেই প্রমাণিত হয় যে লােক প্রচলিত বাংলা ভাষাও ভাব-প্রকাশের দিক থেকে সংস্কৃতনির্ভর ভাষার চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। প্যারীচাদের প্রভাবে পরবর্তী লেখকেরা সংস্কৃত রীতি এবং কথ্যরীতির গদ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করে আদর্শ গদ্যভাষা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এই কারণেই বাংলা গদ্যভাষার বিবর্তৃনের ইতিহাসে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বইটির গুরুত্ব অপরিসীম। কথ্যভাষাশ্রয়ী ভাষাভঙ্গিতে কলকাতার নাগরিক জীবনের পরিবেশকে কত বাস্তব ও জীবন্তভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, আলালের ঘরের দুলালে’র এই বর্ণনায় তার উদাহরণ মেলে ঃ “রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে- বলদেরা গরু লইয়া চলিয়াছে-ধােপার গাধা থপাস ২ করিয়া যাইতেছে- মাছের ও তরকারির বাজরা হু হু করিয়া আসিতেছে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন—মেয়েরা ঘাটে সারি হইয়া পরস্পর মনের কথা কহিতেছে।”

প্যারীচাদ-অবলম্বিত ভাষারীতি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার নিদর্শনরূপে গ্রহণযােগ্য বলে স্বীকৃত হলৈও এর ন্যূনতা এবং দুর্বলতা-বিষয়েও আমাদের অবহিত হওয়া প্রয়ােজন। তার ভাষা অনেকের দ্বারাই সমকালে প্রশংসিত হলেও একালে আমরা যখন ভাষারীতির বিশুদ্ধি-বিষয়ে বেশি সচেতনতা লাভ করেছি, তখন প্যারীচাদের ভাষারীতিতে সামঞ্জস্যের অভাবকে কিছুটা পীড়াদায়ক বলেই মনে করি।

সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয় দ্বিতীয় খণ্ডে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অধ্যাপক ভট্টাচার্য লিখেছেন, “প্যারীচাদ প্রকৃতপক্ষে বিদ্যাসাগরের সাধুরীতিই গ্রহণ করেছিলেন, তবে তৎসম শব্দের পরিবর্তে প্রচুর দেশি বিদেশি শব্দ, বাংলা বিশিষ্ট বাগভঙ্গি এবং কথােপকথনে মৌখিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। তবে, এর ফলে বহু স্থলেই সাধু ও চলিত রীতির মিশ্রণ ঘটেছে এবং পরিমিতিবােধের অভাব ঘটেছে। প্যারীচাদ সাধুভাষার কাঠামােতে মৌখিক ভাষার ব্যবহার করেন এবং দ্বারা চলিত ভাষার শক্তি পরীক্ষা করেন। মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি ঘােষণা করেছিলেন, ‘যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাবসকল রচনা হইবেক।’ কিন্তু বাস্তবে ইনি অপর সকল গ্রন্থ, এমন কি উপন্যাসেও সাধুভাষারীতিই ব্যবহার করেছেন। ‘মদখাওয়া বড় দায়’ গ্রন্থের ভাষাও সাধুরীতির অনুসারী। প্যারীচাঁদের ভাষা-বিষয়ে পরস্পর বিরােধী দুটি চরমপন্থী অভিমতের পরিচয় পাওয়া যায়…… বাক্যের গঠনে সাধুরীতি ব্যবহার করতে গিয়েও প্যারীচাদ অনেক সময়ই রীতি লঙ্ঘন করেছেন, ফলে তা’ কখনাে আদর্শ ভাষা হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি। তবে বাংলা ভাষার বিশিষ্ট প্রাণশক্তির আবিষ্কারে তিনি যে তৎপর ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় বাংলা বাধারা, ধ্বন্যাত্মক শব্দ, শব্দদ্বিত্ব এবং বাগ্রীতির ব্যবহারে।”

শুধু ভাষার দিক থেকে নয়, আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসরূপেও ঐতিহাসিক মর্যদাসম্পন্ন রচনা। ইতিপূর্বে সামাজিক নকশাজাতীয় রচনাগুলিতে (যেমন ভবানীচরণের ‘নববাবুবিলাস’) উপন্যাসের অস্পষ্ট পূর্বাভাস দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত উপন্যাস রচিত হয়নি। তাছাড়া ইতিপূর্বে হানা ক্যাথরিন মুলেন্স রচিত ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ (১৮৫২) গ্রন্থকেও অনেকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বলে মনে করেন। কিন্তু খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারের সীমাবদ্ধ উদ্দেশ্য ও খ্রীষ্টান পরিবারের সীমার মধ্যেই আখ্যানটির বিষয় আবদ্ধ থাকায় সামাজিক প্রেক্ষাপট সেখানে বিকশিত হতে পারে নি বলে মুলেন্সের গ্রন্থ ঠিক উপন্যাসের লক্ষণ অর্জন করতে পারে নি। সমাজপটে ব্যক্তি চরিত্র স্থাপন করে একটা নির্দিষ্ট কাহিনীর বন্ধনের মধ্যে বাস্তব জীবনচিত্র পরিস্ফুট করা উপন্যাস শিল্পের প্রাথমিক দায়িত্ব, বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাদই প্রথম সমাজ ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপােড়েন গড়ে ওঠা একটা নির্দিষ্ট, পূর্ণায়ত কাহিনী ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থে উপস্থাপন করলেন। বড়লােকের আদুরে ছেলে মতিলালের পদস্খলন ও শেষে সৎপথে ফিরে আসা উপন্যাসটির মূল প্রসঙ্গ, ঘটনাগুলি মতিলালকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ঠকচাচা’ নামক চরিত্রটিই এই উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ।

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ঠকচাচা উপন্যাসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জীবন্ত সৃষ্টি, উহার মধ্যে কুট কৗশল ও স্তোকবাক্যে আশ্বাস দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতার এমন চমৎকার সমন্বয় হইয়াছে যে, পরবর্তী উন্নত শ্রেণীর উপন্যাসেও ঠিক এইরূপ সজীব চরিত্র মিলে না। বেচারা, বেণী, বক্রেশ্বর, বাঞ্ছারাম প্রভৃতি চরিত্রও-কেহ বা আনুনাসিক, উচ্চারণে, কেহ বা সঙ্গীতপ্রিয়তায়, কেহ বা কোন বিশেষ বাকভঙ্গীর পুনরাবৃত্তিতে—স্বাতন্ত্র্য অর্জন করিয়াছে।..কৃত্রিম সাহিত্যরীতি বর্জন ও কথ্যভাষার সরস ও তীক্ষ্ণাগ্র প্রয়ােগে আলাল’-এর বর্ণনা ও চরিত্রাঙ্কণ আরও বাস্তব রসসমৃদ্ধ হইয়াছে।”

প্যারীচাদের অন্যান্য রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ‘মদ-খাওয়া বড় দায়, জাতি থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯), ‘রামারঞ্জিকা’ (১৮৬১), ‘অভেদী’ (১৮৭১), ‘আধ্যাত্মিক’ (১৮৮০)।

প্যারীচাঁদ মিত্রের রচনার রীতি অনুসরণ করেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০)। প্রায় কিশাের বয়স থেকে কালীপ্রসন্ন বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একটিমাত্র গ্রন্থ রচনা করে কালীপ্রসন্ন বাংলা গদ্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন, সেই গ্রন্থ হুতােম পাচার নকশা (১৮৬২)। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে কলকাতার সমাজে বাবু নামে অভিহিত একশ্রেণীর বিত্তবান মানুষের আধিপত্য দেখা দেয়। নীতিহীন বিলাসব্যসন এবং কুরুচিপূর্ণ আমােদ-প্রমােদে তাদের দিন কাটত। উনবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক রচনায় তারাই আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হয়েছে। হুতােম প্যাচার নকশা’য় এই শ্রেণীর মানুষের বিকৃত জীবনযাত্রা এবং সাধারণভাবে কলিকাতার সামাজিক আবহাওয়ার বাস্তব চিত্র আঁকা হয়েছে। শুধু কথ্যভাষার ভঙ্গিই নয় শব্দ ব্যবহারেও তিনি চলতি ভাষার ভাণ্ডারের ওপরেই একান্তভাবে নির্ভর করেছেন। প্যারীচাঁদের ভাষায় বহু ক্ষেত্রে সাধুভাষার ক্রিয়ারূপ এবং বাক্য গঠনের সাধুরীতি অনুসরণ করা হয়েছে দেখা যায়। কালীপ্রসন্ন কোথাও সাধুরীতি অনুসরণ করেন নি। চড়কতলার মেলার তাই বর্ণনা অত্যন্ত বাস্তব মজার- “এদিকে চড়কতলায় টিনের ঘুরঘুরি, টিনের মুহুরি দেওয়া তলতা বাঁশের বাঁশী, হলদে রংকরা বাঁখারির চড়কগাছ, ছেঁড়া ন্যাকড়ার তৈরি গুরিয়া পুতুল, শােলার নানাপ্রকার খেলনা, পেল্লাদে পুতুল, চিত্তির করা হাঁড়ি বিক্রি কত্তে বসেচে, ড্যানাক ড্যানাক ড্যাড্যাং ড্যাং চিঙ্গিড়ি মাছের দুটো ট্যাং ঢাকের বােল বাজে, গােলাপিখিলির দোনা বিক্রি হচ্ছে।”

প্যারীচাঁদ মিত্র বা কালীপ্রসন্ন সিংহ একান্তভাবে চলতি ভাষার ওপরে নির্ভর করবার যে দুঃসাহস দেখালেন তার ফলে সংস্কৃত-নির্ভর গদ্যের সঙ্গে কথ্যরীতির গদ্যের সামঞ্জস্য বিধানের একটা সম্ভাবনা দেখা দিল। বঙ্কিমচন্দ্র এই দিক থেকেই প্যারীচাদের রচনার গুরুত্ব নির্দেশ করে বলেছেঃ “বাংলা ভাষার এক সীমায় তারাশঙ্করের ‘কাদম্বরী অনুবাদ, আর এক সীমায় প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল’। ইহারা কেহই আদর্শ ভাষায় রচিত নয়। কিন্তু আলালের ঘরের দুলালে’র পর হইতে বাঙালী লেখক জানিতে পারিল যে, এই উভয় জাতীয় উপযুক্ত ভাষার উপযুক্ত সমাবেশ দ্বারা এবং বিষয় ভেদে একের প্রবলতা অপরের অল্পতার দ্বারা, আদর্শ বাংলা গদ্যে উপস্থিত হওয়া যায়। প্যারীচাঁদ মিত্র আদর্শ বাংলা গদ্যের সৃষ্টিকর্তা নহেন, কিন্তু বাংলা গদ্য যে উন্নতির পথে যাইতেছে প্যারীচাঁদ প্রধান ও প্রথম কারণ। ইহাই তাহার অক্ষয় কীর্তি।”

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.