বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাবের আগে যে যুগকে তত্ত্ববোধিনীর যুগ বলা হয়, তা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক পরিবর্তনের সময়। এই যুগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, যার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। অক্ষয়কুমারের গদ্যশৈলী এবং তার প্রবন্ধগুলো বাংলা গদ্যের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত উভয়েই বাংলা গদ্যের বিকাশে অবদান রেখেছেন, কিন্তু তাদের অবদান ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। বিদ্যাসাগর বর্ণনামূলক গদ্যের শৈলীকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছিলেন, আর অক্ষয়কুমার প্রবন্ধের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের শক্তি ও সামর্থ্যকে প্রমাণ করেন। বিশেষত বিজ্ঞান, ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব নিয়ে তার লেখা প্রবন্ধগুলি বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। অক্ষয়কুমারের সাহিত্যিক প্রতিভা আবিষ্কার করেন ঈশ্বর গুপ্ত, যিনি তাকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং প্রায় ১২ বছর ধরে পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।
অক্ষয়কুমারের মানসিকতা ছিল বৈজ্ঞানিক, যা তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। আবেগ ও বিশ্বাসের পরিবর্তে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে তথ্য ও যুক্তির ওপর নির্ভর করে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের আলোচনায় তার অবদান অপরিসীম। যদিও তার রচনাগুলি মূলত সৃষ্টিশীল সাহিত্য নয়, তবে তার লেখায় বাংলা গদ্য এমন সরলতা ও প্রাঞ্জলতা লাভ করেছে যে তৎকালীন শিক্ষিত সমাজের জন্য তা এক প্রকারের আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। অক্ষয়কুমারের গদ্য শৈলীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল বাক্য গঠনে ছেদচিহ্নের উপযুক্ত প্রয়োগ এবং ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্য।
অক্ষয়কুমারের লেখা বিশেষত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হতো, যেখানে বিজ্ঞান, ধর্ম এবং সমাজবিজ্ঞানের ওপর তার বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বাহ্য প্রকৃতির সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার এবং ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়। প্রথম গ্রন্থটি ১৮৫২ এবং ১৮৫৩ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি ইউরোপীয় উদাহরণগুলিকে এড়িয়ে বাঙালি সমাজের প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয় গ্রন্থটি ছিল হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন উপাসক সম্প্রদায়ের ওপর একটি বিশদ গবেষণা। তার এই গ্রন্থে ১৮২টি সম্প্রদায়ের বিবরণ পাওয়া যায়, যা সেই সময়ের বাংলা ভাষার গবেষণামূলক রচনার মধ্যে প্রথম এবং অনন্য।
অক্ষয়কুমারের লেখা সম্পর্কে অধ্যাপক সুকুমার সেন বলেন, তার গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার উদাহরণ স্থাপন করে। তার লেখা রচনাগুলি গভীর চিন্তাশীল ও তথ্যসমৃদ্ধ ছিল, যা আজও গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। তার গবেষণা-সমৃদ্ধ রচনাগুলি যেমন ভাষাগত দিক থেকে শক্তিশালী ছিল, তেমনি বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণও গভীর ও বস্তুনিষ্ঠ ছিল।
অক্ষয়কুমারের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা ছিল পদার্থবিদ্যা এবং চারুপাঠ-এর তিনটি খণ্ড। চারুপাঠ দীর্ঘদিন পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। যদিও তার রচনাগুলি কিছুটা জটিল ও শ্লথগতি সম্পন্ন ছিল, তবে তার মনের ঋজুতা এবং যুক্তিনিষ্ঠতার জন্য তার লেখা প্রশংসিত হয়েছে।
অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলা গদ্যের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তার লেখা শুধু সাহিত্যিক নয়, বৈজ্ঞানিক ও সমাজিক জ্ঞানচর্চারও অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছে।