বৈষ্ণব পদাবলী: বৈষ্ণব পদাবলি বা বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য নামে খ্যাত এক শ্রেণীর ধর্মসঙ্গীত সংগ্রহ। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যর সূচনা ঘটে চর্তুদশ শতকে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস-এর সময়ে তবে ষোড়শ শতকে এই সাহিত্যের বিকাশ হয়। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা।
বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব
শ্রীকৃষ্ণ হলেন সৎ-চিৎ আনন্দের মূর্তিমান বিগ্রহ।রাধা তাঁরই প্রকাশাত্মিকা শক্তি।শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী অংশ সঞ্জাত রাধা সৃষ্টি হয়েছেন তাঁরই লীলাসুখানুভবের জন্য।শ্রীরাধা আয়ান বধূ।তাই শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর প্রেম অসামাজিক, পরকীয়া।জীবও তেমনই তত্ত্বের দিক থেকে শ্রীকৃষ্ণের স্বকীয় হলেও রূপ-রস-গন্ধযুক্ত জগতের সঙ্গে সে এমনই নিবিড়ভাবে আবদ্ধ যে সে তার স্বকীয়তা ভুলে যায়। সেই ভুল ভাঙলে জীব ভগবানের ডাকে সাড়া দেয়, তখন ঘটে তার পরকীয়া অভিসার। এভাবেই তৈরী হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব।
বৈষ্ণব পদাবলী বিভিন্ন পর্যায়
পূর্বরাগ
শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর “উজ্জ্বলনীলমণি’তে শৃঙ্গারকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ক)বিপ্রলম্ভ খ) সম্ভোগ। আবার বিপ্রলম্ভকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিও, ও প্রবাস। শ্রীরূপ গোস্বামী পূর্বরাগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-
“রতির্যা সংগমাৎ পূর্বং দর্শনশ্রবণাদিজা। তয়োরুন্মীলতি প্রাজৈ পূর্বরাগ স উচ্যতে।।”
প্রকৃত মিলনের আগে নায়ক নায়িকার পারস্পরিক দর্শন প্রভৃতি থেকে জাত মিলনেচ্ছাময় রতি উপযুক্ত সঞ্চারীভাব ও অনুভাবের দ্বারা পুষ্ট হয়ে প্রকাশ পেলে তাকে পূর্বরাগ বলে।
পূর্বরাগ অবস্হার সঞ্চারীভাব হল ব্যাধি, শঙ্কা, অসূয়া, শ্রম, ক্লম বা ক্লান্তি, নির্বেদ, ঔৎসুক্য, দৈন্য, চিন্তা, নিদ্রা, জাগরণ, বিষাদ, জড়তা, উন্মাদ, মোহ ও মৃত্যু।
কৃষ্ণবিষয়ক রতির সাধারণী, সমঞ্জসা ও সমর্থার বিভাগ অনুসারে পূর্বরাগের সাধারণ, সমঞ্জস ও প্রৌঢ় এই তিনটি ভাগ। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রৌঢ়-পূর্বরাগের প্রধান দশটি সঞ্চারীভাব—লালসা, উদ্বেগ, জাগরণ, তানব, জড়িমা, বৈয়গ্র, ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ এবং মৃতির (মৃত্যু বাসনা) মধ্য দিয়ে এই পূর্বরাগ “দশা” রূপ লাভ করে।
অনুরাগ
যে রাগ নিত্য নব রূপে সর্বদা অনুভূত প্রিয়জনকেও নতুনভাবে অনুভব করিয়ে প্রতি মুহূর্তেই প্রেমকে নবীনতা দান করে তাকেই অনুরাগ বলে।
শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর “উজ্জ্বল নীলমণি” গ্রন্থে অনুরাগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন ….
“সদানুভূতমপি যঃ কৃর্যান্নবনবং প্রিয়ম্। রাগো ভবন্নবনবঃ সোহগনুরাগ ইতীর্যতে।।”
অনুরাগের ফলে প্রিয়স্বাদ বাসনার তৃপ্তি হয়না কখনো আর প্রীতিও পরিণতি পায়না। অনুরাগের লক্ষণ চারটি। ক)পরস্পরবশীভাব, খ) প্রেমবৈচিত্ত, গ) অপ্রাণীতেও জন্মলাভের উৎকট লালসা, ঘ) বিরহেও কৃষ্ণ অনুভব বা বিপ্রলম্ভে বিস্ফুর্তি।
অভিসার
অভিসার শব্দের অর্থ সংকেত স্হানে গমন। আগে উদ্দিষ্ট স্হানে যাওয়া বোঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত হতো। ক্রমশ এটি প্রেমিক প্রেমিকার মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্পরের অভিমুখে যাত্রাকেই বোঝাতে থাকে। “রসকল্পবল্লী”তে উদ্ধৃত অভিসারিকার সংজ্ঞা হল– ” কান্তার্থিনী তুখা যাতি সংকেতং অভিসারিকা।” কান্তের উদ্দেশ্যে যিনি সংকেত স্থানে
গমন করেন, তিনিই অভিসারিকা। নারায়ণদাস রচিত গীতগোবিন্দের ” সর্বাঙ্গসুন্দরী” টীকায় অভিসারিকার সংজ্ঞা হল-
“দুর্বার দারুণ মনোভাববহ্নিতপ্তা পৰ্য্যাকুলাকুলিত-মানসমাবহস্তি।
নিঃশঙ্কিনী ব্ৰজতি যা প্রিয়সঙ্গমার্থং সানায়িকা খলু ভবেদভিসারিকেতি।।”
দুর্বার দারুণ মদন-বহ্নিতে উওপ্তা, যে নায়িকা আকুল মনে নির্ভয়ে প্রিয়র সাথে মিলিত হওয়ার জন্য যাত্রা করেন তিনিই অভিসারিকা।
শ্রীরূপ গোস্বামীর “উজ্জ্বল নীলমণি’তে অভিসারিকার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে—–
” যা ভি সারয়তে কান্তং স্বয়ং বা ভি সত্যপি।
সা জ্যোৎস্নী তামসী যান যোগ্যবেশাভিসারিকা।। লজ্জয়া স্বাঙ্গলীনের নিঃশব্দাখিলমন্ডনা । কৃতাবগুন্ঠা স্নিগ্ধৈক সখিযুক্তা প্রিয়ং ব্রজেৎ।।”
“রসকল্পবল্লী”তে অভিসারিকার সংকেত স্থান কি কি হতে পারে তারও উল্লেখ আছে। নিকুঞ্জকানন, উদ্যান, জলশূন্য পরিখা, অট্টালিকার গবাক্ষ, নদী তীরের কন্টকযুক্ত বাঁধ, গৃহের পিছন, ভাঙা মঠ মন্দিরকে অভিসারের সংকেত স্থান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
পীতাম্বর দাস “রসমঞ্জরী”তে আট ধরনের অভিসারের কথা বলেছেন।
“সেই অভিসার হয় পুন আট প্রকার। জ্যোৎস্নী, তামসী, বর্ষা, দিবা অভিসার।। কুাটিকা, তীর্থযাত্রা, উন্মত্তা, সঞ্চরা। গীত পদ্য রসশাস্ত্রে সৰ্ব্বজনোৎকরা।।”
আসলে অভিসারের এই সময় বৈচিত্র্যই বুঝিয়ে দেয় অভিসারের কোনও দিন-ক্ষণ নেই। প্রাণের আবেগ অসময়কেও সময় করে তোলে। বৈষ্ণব পদাবলীতেও শ্রেষ্ঠ অভিসার- বিষয়ক বেশিরভাগ পদই বর্ষণমুখর রাতে রাধার তিমিরাভিসারের বর্ণনা ।
অভিসার পর্যায়ের বিশেষত্ব হল প্রকৃতি এখানে রাধাকৃষ্ণের প্রেমে বা রাধাকৃষ্ণের মিলনের পথে প্রতিকূল ভূমিকা গ্ৰহণ করেছে। আর সেই প্রতিকূলতার কষ্টিপাথরে যাচাই হয়েছে রাধার ‘নিকষিত হেম’ তুল্য কৃষ্ণপ্রেম। এই রাধা বিঘ্নবিজয়িনী, অধ্যাত্মপথযাত্রিণী।
প্রেম বৈচিত্র্য ও আক্ষেপানুরাগ
“প্রিয়স্য সন্নিকর্ষোহনপি প্রেমোৎকর্ষস্বভাবতঃ।
যা বিশ্লেষধিয়ার্তিস্ত প্রেমবৈচিত্ত্যমুচ্যতে।।”
প্রেমোৎকর্ষহেতু প্রিয়তমের নিকটে অবস্থান করেও বিচ্ছেদের ভয় থেকে যে আর্তি তাকে প্রেমবৈচিত্র্য বলে। বৈচিত্ত্য শব্দের অর্থ চিত্তের অন্যথা ভাব। গোপী প্রেমে বিশেষ করে মহাভাবময় রাধাপ্রেমে এই ভূবের প্রকাশ বিশেষভাবে হয়ে থাকে।
দীনবন্ধু দাস তাঁর ” সংকীর্তনামূতে” প্রেমবৈচিত্তের যে আটটি বিভাগ করেছেন তা হল— রূপানুরাগ, উল্লাস অনুরাগ, পাঁচ ধরনের আক্ষেপানুরাগ ও রসোদগার। পাঁচ ধরনের আক্ষেপানুরাগ হল কৃষ্ণের প্রতি, মুরলীর প্রতি, নিজের প্রতি, সখীগণের প্রতি, ও দূতির প্রতি আক্ষেপ।
আক্ষেপানুরাগে শ্রীমতি রাধার সর্বদা বিরহ অবস্থার প্রকাশ। প্রায় অকারণ বিরহ কাতরতা, কৃষ্ণ মথুরায় না গেলেও স্বল্পকালীন বিচ্ছেদের অসহনীয় অবস্থায় আক্ষেপই এই পর্যায়ের পদের বৈশিষ্ট। আক্ষেপানুরাগ প্রেমবৈচিত্র্যেরই অংশ। প্রেমবৈচিত্র্য্যে রাধাকৃষ্ণ ঘনিষ্ঠ মিলনের মধ্যেও বিরহ কাতরতা অনুভব করেন। আর আক্ষেপানুরাগে স্থায়ী দুঃখকাতরতা লক্ষ করা যায়। এই দুঃখ যেহেতু রাধার অনুভবের ব্যাপার তাই এর শেষও নেই। প্রকৃতপক্ষে আক্ষেপানুরাগের মধ্যেই
মহাভাবস্বরূপিণী রাধার সমাজ সংস্কার, নিজের অদৃষ্ট, কৃষ্ণের দেওয়া দুঃখ, এমনকি নিজের কাছ থেকে পাওয়া দুঃখের পূর্ণ পরিচয় লাভ করা যায়।
মাথুর
‘মাথুর বিরহ পর্যায়ের একটি অবস্থা। পূর্বে মিলিত যুবক যুবতীর কেউ যদি দেশান্তরে গমন করেন তখনই বিরহ সম্ভব হয়। এই অবস্থাকে বলে প্রবাস। ‘উজ্জ্বল নীলমণি’তে শ্রীরূপ গোস্বামী বলেছেন….
পূর্বসঙ্গত ঘোíনোর্ডবেদ্দেশান্তরাদিভিঃ। ব্যবধানম্ভ যৎপ্রাজ্ঞৈঃ স প্রবাস ইতির্যতে।।
প্রবাস বিপ্রলম্ভ নিকট প্রবাস ও দূর প্রবাস ভেদে দুরকমের। কালিয়দমনে, গোচারণে নন্দমোক্ষণে, কার্যানুরোধে, স্থানান্তরগমনে এবং রাসের অন্তর্ধানে… এই পাঁচ প্রকার নিকট প্রবাস হয়।
দূর প্রবাস তিন প্রকার।– ভাবী, ভবন ও ভূত বা মথুরা প্রবাস। ভাবী বিরহে হঠাৎ বিরহ ঘনিয়ে আসছে বলে মনে হয়। যেমন একটি রথ এসেছে দেখে আশঙ্কা হয়, কৃষ্ণ বুঝি ওই রথে চড়ে চলে যাবেন। কৃষ্ণ চলে যাচ্ছেন এই অবস্থা হল ভবন বিরহ। কৃষ্ণ আসবেন কথা দিয়ে চলে গেছেন কিন্তু নির্দিষ্ট দিন উত্তীর্ণ হওয়ার পরও তিনি এলেন না। এই অবস্থা হল ভূত প্রবাস। এই অবস্থায় নায়িকার যে দশ দশা হয় শ্রীরূপ গোস্বামী তার বিভিন্ন নাম দিয়েছেন… চিন্তা, জাগরণ, উদ্বেগ, তানব বা কৃশতা, মলিনাঙ্গতা, প্রলাপ, ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ ও মৃত্যু।
প্রবাসের আরও একরকম বিভাজন হয়। বুদ্ধি পূর্বক ও অবুদ্ধি পূর্বক।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
বৈষ্ণব পদাবলী কী? বৈষ্ণব পদাবলী বিভিন্ন পর্যায় ও বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব গুলো আলোচনা করুন
বৈষ্ণব পদাবলির কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে লিখুন
বৈষ্ণব পদাবলির কবি চণ্ডীদাস সম্পর্কে লিখুন
বৈষ্ণব পদাবলির কবি গোবিন্দ দাস সম্পর্কে লিখুন
বৈষ্ণব পদাবলির কবি জ্ঞানদাস সম্পর্কে লিখুন