Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

ধর্মমঙ্গল মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার তিনটি প্রধান শাখার অন্যতম (অপর শাখাদুটি হল মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল)। এই কাব্য রচনার প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার লৌকিক অনার্য দেবতা ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার। এই কাব্যের উপাদান মূলত রাঢ় বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদান। ধর্মমঙ্গল কাব্যে দুটি কাহিনি সন্নিবেশিত হয়েছে: প্রথমটি পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি, এবং দ্বিতীয়টি লাউসেনের উপাখ্যান। দ্বিতীয় উপাখ্যানটিই কাব্যের মূল উপজীব্য। ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান কবিরা হলেন রূপরাম চক্রবর্তী (বর্ধমান, সপ্তদশ শতাব্দী) ও ঘনরাম চক্রবর্তী (বর্ধমান, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী)। এছাড়া এই কাব্যের অন্যান্য কবিরা হলেন ময়ূরভট্ট (ধর্মমঙ্গলের আদিকবি), শ্যাম পণ্ডিত, ধর্মদাস, রামদাস আদক, সীতারাম দাস, যাদুনাথ বা যাদবনাথ পণ্ডিত, খেলারাম চক্রবর্তী ও মানিকরাম গাঙ্গুলি। রাঢ় অঞ্চলের সমাজ ও রাজনীতি এই কাব্যের মূল উপজীব্য হওয়ায় কোনো কোনো সমালোচক এই কাব্যকে “রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য” বলে উল্লেখ করেন। তবে এই মত বিতর্কিত।

আখ্যানভাগ

হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান

সকল ধর্মমঙ্গল কাব্যের গোড়ার দিকে রাজা হরিশ্চন্দ্র বা হরিচন্দ্র ও রানি মদনার পুত্রলাভের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। এই কাব্যের হরিশ্চন্দ্রের পুত্রের নাম লুইচন্দ্র বা লুইধর। তবে এই উপাখ্যানটির সঙ্গে মূল কাহিনির অন্তরঙ্গ যোগ নেই। উপাখ্যানটি নিম্নরূপ :

রাজা হরিশ্চন্দ্র (কোনো কোনো পুথিতে হরিচন্দ্র) ও রানি মদনার সন্তানাদি ছিল না বলে নানাপ্রকার লাঞ্ছনা সহ্য করতে হত। একদা রাজা-রানি বনে ঘুরতে ঘুরতে বল্লুকা নদীর তীরে ভক্তদের ধর্মঠাকুরের পূজা করতে দেখেন। তা দেখে তাঁরাও পুত্রকামনায় ধর্মপূজা করেন। পুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাঁকে ধর্মের নিকট বলি দিতে হবে এই শর্তে ধর্মঠাকুর তাঁদের পুত্রবর দেন। কালক্রমে লুইচন্দ্র বা লুইধর নামে তাঁদের এক সর্বসুলক্ষণযুক্ত পুত্র জন্মায়। কিন্তু রাজা-রানি ধর্মকে দেওয়া তাঁদের প্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হন। যথাকালে ধর্মঠাকুর এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে উপস্থিত হয়ে রাজা ও রানির কাছে এসে বলেন যে, তিনি তাঁর উপবাসভঙ্গের পর লুইচন্দ্রের মাংস ভক্ষণ করতে চান। রাজা ও রানির কাতর অনুনয়ে তিনি কর্ণপাত করেন না, বরং তাঁদেরও তাঁর সঙ্গে বসে পুত্রমাংস ভক্ষণ করার আদেশ দেন। অগত্যা রাজা ও রানি লুইচন্দ্রকে খড়্গঙ্গাঘাতে হত্যা করে তাঁর মাংস রন্ধন করেন। কিন্তু তাঁরা ব্রাহ্মণবেশী ধর্মের আদেশানুসারে পুত্রমাংস ভক্ষণ করার পূর্বেই ধর্মঠাকুর স্ববেশ ধারণ করে তাঁদের হাত ধরে ফেলেন। জানা যায়, লুইচন্দ্রকে আদৌ কাটা হয়নি। ধর্মঠাকুরের মায়ায় হরিশ্চন্দ্র মায়া-লুইকে হত্যা করেছেন মাত্র। আসলে লুইকে নিজের কোলে লুকিয়ে রেখে ধর্মঠাকুর রাজা ও রানিকে পরীক্ষা করছিলেন। পুত্রকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেয়ে রাজা ও রানি মহাখুশি হলেন এবং মহাসমারোহে ধর্মপূজার আয়োজন করলেন।

এই কাহিনিটি অতি প্রাচীন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমান, পূর্বে ধর্মপূজার আসরে কেবল এই উপাখ্যানটিই গীত হত। আজও ধর্মপূজার দ্বিতীয় দিনে এটি গীত হয়। সকল ধর্মমঙ্গলেই এই কাহিনিটি রয়েছে। কোনো কোনো ধর্মমঙ্গলে আবার লাউসেনের প্রধান উপাখ্যানটির বদলে কেবল এই গল্পটিই স্থান পেয়েছে।

লাউসেনের উপাখ্যান

ধর্মমঙ্গল কাব্যের দ্বিতীয় তথা প্রধান কাহিনিটি গড়ে উঠেছে লাউসেনের বীরত্বগাথাটিকে কেন্দ্র করে। ধর্মপূজার ‘ঘরভরা’ অনুষ্ঠানের জন্য এই কাহিনিটিকে গীত আকারে চব্বিশ পালায় বিভক্ত করে বারো দিন ধরে গাওয়া হয়। এই কারণে এই কাহিনিটির অপর নাম ‘বারোমতি’ বা ‘বার্মাতি’। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “দেবকৃপাশ্রিত লাউসেন এই কাব্যের নায়ক এবং তাহার বীরত্বের অদ্ভুতরসের গল্পই ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান আকর্ষণ।” লাউসেনের উপাখ্যানটি নিম্নরূপ: ধর্মঠাকুর মর্ত্যে পূজা প্রচারের জন্য উৎসুক ছিলেন। এমন সময় স্বর্গের নর্তকী জাম্ববতী শাপগ্রস্থ হয়ে বমতি নগরে বেণুরায়ের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম হয় রঞ্জাবতী। রঞ্জাবতীর দিদি ছিলেন গৌড়েশ্বরের রাজমহিষী এবং তাঁর দাদা মহামদ ছিলেন গৌড়েশ্বরের মন্ত্রী। গৌড়েশ্বরের বিদ্রোহী সামন্ত তথা চণ্ডীর বরপুত্র ইছাই ঘোষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে গৌড়েশ্বরের অপর সামন্ত তথা ঢেকুরগড়ের অধিপতি কর্ণসেনের ছয় পুত্র ও পুত্রবধূগণ যুদ্ধে নিহত হন। কর্ণসেন নিজেও পরাজিত হন। কর্ণসেনকে সান্ত্বনাস্বরূপ গৌড়েশ্বর নিজ শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। বিবাহের পর রঞ্জাবতীকে নিয়ে কর্ণসেন ময়নাগড়ে নতুন সামন্তের পদে অধিষ্ঠিত হন। এদিকে বৃদ্ধ কর্ণসেনের সঙ্গে বোনের বিবাহ হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন মহামদ। গৌড়েশ্বরের কাজের প্রতিবাদ করতে না পেরে কর্ণসেনের সঙ্গেই শত্রুতা করেন তিনি। কর্ণসেনকে

বারবার ‘পুত্রহীন’ বলে গালি দিতে থাকেন মহামদ। এতে বিচলিত হয়ে রঞ্জাবতী পুত্রকামনায় কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন সহ ধর্মঠাকুরের পূজা করতে থাকেন। যথাকালে ধর্মঠাকুরের কৃপায় এক স্বর্গভ্রষ্ট দেবতা রঞ্জাবতীর গর্ভে জন্ম নেন। তাঁর নাম রাখা হয় লাউসেন। এতে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে মহামদ ইন্দা মেটে নামে এক অনুচরকে পাঠিয়ে লাউসেনকে অপহরণ করলেন। ধর্মঠাকুর কর্পূরবিন্দু থেকে আর একটি ছেলে সৃষ্টি করে রঞ্জাবতীকে দিলেন। তার নাম হল কর্পূর ধবল। এদিকে ধর্মঠাকুরের আজ্ঞায় হনুমান লাউসেনকে উদ্ধার করে রঞ্জাবতীর কোলে ফিরিয়ে দিলেন। এইভাবে রঞ্জাবতী হলেন দুই পুত্রের জননী।

ক্রমে লাউসেন বড়ো হয়ে উঠল। লেখাপড়া ও অস্ত্রবিদ্যায় অর্জন করল বিশেষ ব্যুৎপত্তি, এদিলে মল্লযুদ্ধেও হয়ে উঠল এক অপ্রতিরথ যোদ্ধা। গৌড়েশ্বরকে নিজ বীরত্ব দেখিয়ে খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে সে ভাই কর্পূর ধবলকে নিয়ে যাত্রা করল গৌড়ের উদ্দেশ্যে। পথে বাঘ, কুমির ইত্যাদি হিংস্র জন্তু বধ করে একদিকে যেমন নিজের খ্যাতি বৃদ্ধি করল, অন্যদিকে ভ্রষ্টা নারীদের প্রলোভন এড়িয়ে সে নৈতিক শুচিতারও পরিচয় দিল। এদিকে গৌড়ে পৌঁছেই লাউসেন মহামদের চক্রান্তে বন্দী হল। কিন্তু গৌড়েশ্বরকে বাহুবল দেখিয়ে খুশি করে সে অচিরেই মুক্তিলাভ করল। গৌড়েশ্বর তাঁকে প্রচুর পুরস্কার ও ময়নাগড়ের ইজারা দিলেন। ফেরার পথে কালু ডোম ও তার বউ লখ্যার সঙ্গে লাউসেনের সখ্যতা হল। লাউসেন এদেরও ময়নাগড়ে নিয়ে এল। কালুকে করল সেনাপতি। এরপর মহামদের চক্রান্তে গৌড়েশ্বর লাউসেনকে পাঠালেন কামরূপরাজকে দমন করতে। মহামদ ভেবেছিলেন প্রবল প্রতাপশালী কামরূপরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে লাউসেনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ধর্মঠাকুরের কৃপায় লাউসেন কামরূপরাজকে পরাজিত করে তাঁর কন্যা কলিঙ্গাকে বিয়ে করে দেশে ফিরল। এতে মহামদ ঈর্ষায় দগ্ধ হতে লাগলেন। তাঁর চক্রান্তে আবার গৌড়েশ্বর লাউসেনকে শিমূল রাজ্য আক্রমণ করতে পাঠালেন। লাউসেনও লোহার গণ্ডার কেটে শিমূল রাজকন্যা কানাড়াকে বিবাহ করে নিয়ে এল। এতে মহামদের ক্রোধ বেড়ে গেল। তাঁরই চক্রান্তে অজয় নদের তীরে ইছাই ঘোষের সঙ্গে লাউসেনের প্রবল যুদ্ধ হল। যুদ্ধে ইছাই পরাজিত ও নিহত হল। এরপর মহামদ লাউসেনকে অন্যভাবে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করলেন। তিনি কৌশলে গৌড়েশ্বরকে দিয়ে আদেশ করালেন যে, লাউসেন যদি ধর্মঠাকুরের বরপুত্র হয়, তবে তাকে পশ্চিমে সূর্যোদয় ঘটিয়ে দেখাতে হবে, নচেত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। হাকন্দ নামক স্থানে ধর্মের কঠোর তপস্যা করে লাউসেন এই অসাধ্যটিও সাধন করল।

লাউসেন যখন হাকন্দে তপস্যা করছিল, তখন সেই সুযোগে মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করে। যুদ্ধে সপত্নী কালুরায় মারা যায়। লাউসেনের প্রথমা স্ত্রী কলিঙ্গা বীরবীক্রমে যুদ্ধ করে প্রাণত্যাগ করে। শেষে বীরাঙ্গনা কানাড়ার হাতে পরাজিত হয়ে মহামদ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। দেশে ফিরে ধর্মঠাকুরের স্তব করে সকলকে বাঁচিয়ে তোলে লাউসেন। মর্ত্যে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচারিত হয়। মহামদ তাঁর কৃত পাপের জন্য কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ হয়। কিন্তু দয়াপরবশ হয়ে লাউসেন ধর্মঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করে তাঁকে রোগ থেকে মুক্তি দেয়। এরপর পরম গৌরবে কিছুকাল রাজত্ব করে পুত্র চিত্রসেনের হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে স্বর্গারোহণ করে লাউসেন।

আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)

মঙ্গলকাব্য কী? মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও সময়কাল, মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক প্রেক্ষাপট

মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য বা মঙ্গলকাব্যের লক্ষণ গুলো লিখ

মনসামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

মনসামঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু ও মনসামঙ্গল কাব্যের কবি পরিচয়

মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিজয়গুপ্ত সম্পর্কে লিখুন

মনসামঙ্গল কাব্যের কবি নারায়ণদেব সম্পর্কে লিখুন

মনসামঙ্গল কাব্যের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ সম্পর্কে লিখুন

মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিপ্রদাস পিপলাই সম্পর্কে লিখুন

মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও শিল্পমূল্য বিচার! মনসামঙ্গল কাব্যের গুরুত্ব বিচার

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে লিখুন

অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

অন্নদামঙ্গল কাব্যের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর সম্পর্কে লিখুন

ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র

ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবি ঘনরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে লিখুন

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.