চন্ডীমঙ্গল মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। চন্ডীদেবীর কাহিনী এর উপজীব্য। এই চন্ডীদেবীও মূলত অনার্যসম্ভূতা, পরে বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রের দেবকল্পনার প্রভাবে পর্যায়ক্রমে পৌরাণিক দেবতায় পরিণত হন। এর বিষয়বস্তু দুটি সামাজিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। প্রথমটি কালকেতু-ফুল্লরার জীবনকথা এবং দ্বিতীয়টি ধনপতি-লহনা- খুলনার কাহিনী। কালকেতু একজন দরিদ্র ব্যাধ। দেবী চন্ডীর কৃপায় দারিদ্র্যপীড়িত জীবন থেকে কালকেতু-ফুল্লরা বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়। কিন্তু ধনগর্বে গর্বিত কালকেতু-ফুল্লরা দেবীকে বিস্মৃত হলে আবার তারা অশেষ দুর্গতিতে পড়ে। অবশেষে দেবীর শরণাপন্ন হয়ে তারা পুনরায় ধন-সম্পদ ও সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করে।
দ্বিতীয় কাহিনী অনেকটা মনসামঙ্গলের মতো। ধনপতি একজন ধনবান ও বিলাসী সওদাগর। তিনি শ্যালিকা খুলনার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর লহনার তত্ত্বাবধানে খুল্লনাকে রেখে তিনি যান বাণিজ্যে এবং সেখানে বারবনিতা আসক্ত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে দাসীর প্ররোচনায় লহনা খুল্লনার ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। একদিন বনে ছাগল চরাতে গিয়ে খুল্লনা বিপদে পড়ে চন্ডীর মাহাত্ম্য জানতে পারে। তারপর চন্ডীর কৃপায় সে বিদেশ প্রত্যাগত স্বামীর সোহাগ- ভাগিনী হয়। আরেক দিন গর্ভবর্তী খুল্লনাকে বাড়িতে রেখে ধনপতি পুনরায় বাণিজ্যে যান। ধনপতি ছিলেন শৈব, তাই চন্ডীবিদ্বেষ হেতু সেখানে তিনি কারারুদ্ধ হন। এদিকে খুল্লনার এক পুত্রসন্তান জন্মে। তার নাম রাখা হয় শ্রীমন্ত। শ্ৰীমন্ত বড় হয়ে চন্ডীর কৃপায় পিতাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। এরপর ধনপতি চন্ডীমাহাত্ম্য স্বীকার করেন।
স্পষ্টই বোঝা যায় যে, চন্ডীর মাহাত্ম্য প্রচার ও পূজা প্রচলনের উদ্দেশ্যেই উপযুক্ত কাহিনী দুটি সাজানো হয়েছে। তবে এর মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজের অনেক তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। সপত্নীবিদ্বেষ, পুরুষের ভোগলালসা ও রূপাসক্তি, নগর প্রতিষ্ঠা, ব্যাধসমাজের রীতি-নীতি ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, কালকেতুপীড়িত বন্য পশুদের চন্ডীর নিকট কাতর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে নির্যাতিত মানুষের দুঃখদুর্দশার রূপায়ণ ইত্যাদি বিষয় কাব্যে চিত্রিত হয়েছে। চন্ডীমঙ্গলের চরিত্রগুলি মানবীয় গুণাগুণসম্পন্ন এবং সমাজরসে পরিপুষ্ট। তাই সমালোচকদের দৃষ্টিতে চরিত্রকল্পনায় চন্ডীমঙ্গল শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত।
চন্ডীমঙ্গলের আদি কবি মাণিক দত্ত। তিনি মালদহের লোক ছিলেন বলে মনে করা হয় এবং তিনি ছিলেন চৈতন্যপূর্বযুগের কবি। তাঁর কাব্যের একটি অনুলিপির কাল ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ। চন্ডীমঙ্গলের দুজন শ্রেষ্ঠ কবি হলেন দ্বিজ মাধব ও মুকুন্দরাম। দুজনই ষোলো শতকের কবি এবং এঁদের হাতেই চন্ডীমঙ্গল মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুজনের কাব্যই বৈষ্ণব ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। দ্বিজ মাধবের কাব্যের রচনাকাল ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ। এতে চন্ডীমঙ্গলের কাহিনী সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করেছে এবং বৈষ্ণব পদাবলির অনুসরণে ছোট ছোট গীতিকবিতা সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
মুকুন্দরাম সমগ্র মঙ্গলকাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত। তাঁর কাব্যে ব্যক্তিজীবনের ঘটনাপঞ্জি একটি সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে। মানব জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, লাঞ্ছনা-উপভোগ ইত্যাদি বিপরীতধর্মী বৃত্তিগুলির অপূর্ব মিশ্রণে তিনি বিরল সমন্বয়শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এর ফলে চরিত্রগুলিতে যে জীবনমুখিতার সৃষ্টি হয়েছে তা সর্বকালের মানবপ্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
চন্ডীমঙ্গল ধারায় আরেকখানা গ্রন্থ আছে দ্বিজ রামদেবের অভয়ামঙ্গল। গ্রন্থটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে রচিত এবং এতে ঐ অঞ্চলের ভাষার প্রভাব আছে। এতে ‘ফেরাঙ্গি’ শব্দের উল্লেখ থাকায় পর্তুগিজ আগমনের পরে সতেরো শতকের মাঝামাঝি এটি রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। কাব্যে দ্বিজ মাধবের প্রভাব আছে।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
মঙ্গলকাব্য কী? মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও সময়কাল, মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক প্রেক্ষাপট
মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য বা মঙ্গলকাব্যের লক্ষণ গুলো লিখ
মনসামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
মনসামঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু ও মনসামঙ্গল কাব্যের কবি পরিচয়
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিজয়গুপ্ত সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি নারায়ণদেব সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিপ্রদাস পিপলাই সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও শিল্পমূল্য বিচার! মনসামঙ্গল কাব্যের গুরুত্ব বিচার
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে লিখুন
অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
অন্নদামঙ্গল কাব্যের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর সম্পর্কে লিখুন
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র