মনসামঙ্গল মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। সর্পদেবী মনসার কাহিনী এর উপজীব্য। বাংলার লোকসমাজে বহু পূর্ব থেকেই সর্পপূজার প্রচলন ছিল। মনসা অনার্য দেবতা, তাই অনার্য দ্রাবিড় সভ্যতা থেকে এর আগমন ঘটেছে বলে মনে করা হয়। সর্পের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই দাক্ষিণাত্যবাসী দ্রাবিড়দের মধ্যে এই সর্পদেবীর পূজার প্রচলন হয়। বিষধর সাপ সাধারণত জঙ্গলেই থাকে, তাই সর্পদেবীর বিষহরী, জাঙ্গুলী, পদ্মাবতী ইত্যাদি নামও দেখা যায়।
মনসামঙ্গলের প্রচলিত কাহিনীটি হচ্ছে বণিক চন্দ্রধর বা চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে মনসার দ্বন্দ্ব এবং শেষপর্যন্ত চন্দ্রধর কর্তৃক মনসার পূজা প্রদানের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি। চন্দ্রধর ছিলেন শিবভক্ত। মনসা চাইলেন চাঁদের মাধ্যমে লোকসমাজে তার পূজা প্রচার করতে। কিন্তু পূজা দেওয়া থাক দূরের কথা, চাঁদ তাকে দেবী বলেই স্বীকার করেন না। এতে চাঁদ এবং তাঁর পরিবারের ওপর নেমে আসে মনসার চরম অত্যাচার। ক্রোধবশত মনসা চাঁদের সপ্তডিঙ্গা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেন এবং তাঁর সাত ছেলেকে সর্পদংশনে মেরে ফেলেন। অবশেষে কনিষ্ঠপুত্র লখিন্দরের সদ্য পরিণীতা স্ত্রী বেহুলার পতিভক্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অসীম মনোবল এবং কঠোর সাধনার কাছে দৈবশক্তি পরাভব মানে এবং চাঁদের সপ্তডিঙ্গাসহ সাত পুত্রকে পুনরুজ্জীবিত করে বেহুলা শ্বশুর বাড়ি ফিরে যায়।
মনসামঙ্গলের এই কাহিনী মূলত নিগৃহীত মানবতার জীবনকথা। মানবিকতার সর্বময় পরাভব ও গ্লানিকর সেই যুগে চন্দ্রধর ও বেহুলা দুটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও প্রতিবাদী চরিত্র। উচ্চ-নীচ ভেদ, আর্য-অনার্য দ্বন্দ্ব ইত্যাদি তৎকালীন সমাজের বিষয়গুলি মনসা-চাঁদ-বেহুলার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। দেবতা ও মানুষের দ্বন্দ্বে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য এবং চাঁদের সঙ্গে মনসার বিবাদে আর্য-অনার্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে। কারণ চাঁদ ছিলেন শিবের ভক্ত। শিব অনার্যসম্ভূত হলেও আর্যদেবতাদের শ্রেণীভুক্ত। পরিণামে অবশ্য এই বিভেদ আর থাকেনি। বেহুলার ব্যক্তিত্বের কাছে দেবতাদের পরাজয় এবং চন্দ্রধর কর্তৃক মনসার পূজা দেওয়ায় সব বিভেদ দূর হয়ে যায়। এসব ঘটনা থেকে আরও একটি বিষয় পরিস্ফুট হয় যে, মানুষ প্রকৃতপক্ষে দৈবশক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং দৈবই মানুষের ওপর নির্ভরশীল; দৈব ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু মানুষ ছাড়া দৈবের কোন অস্তিত্ব নেই। তাই পূজা প্রচারের জন্য অন্যান্য দেবতার মতো মনসাকেও একজন মানুষ অর্থাৎ চন্দ্রধরের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। বেহুলা চরিত্র থেকে ভারতীয় নারী, বিশেষত বাঙালি নারীর পতিভক্তির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।
মনসামঙ্গলের আদি কবি কানা হরিদত্ত, কিন্তু তাঁর গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। তিনি ১৩শ শতকে জীবিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। এরপর আর যাঁরা মনসামঙ্গল রচনা করেন তাঁরা হলেন পুরুষোত্তম, নারায়ণদেব (আনু. ১৫শ শতক), বিজয়গুপ্ত এবং বিপ্রদাস পিপিলাই বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলই (১৪৯৪) সর্বাপেক্ষা পরিচিত এবং সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন। বিপ্রদাসের গ্রন্থ মনসাবিজয় পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে রচিত বলে গবেষকদের অনুমান।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
মঙ্গলকাব্য কী? মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও সময়কাল, মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক প্রেক্ষাপট
মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য বা মঙ্গলকাব্যের লক্ষণ গুলো লিখ
মনসামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
মনসামঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু ও মনসামঙ্গল কাব্যের কবি পরিচয়
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিজয়গুপ্ত সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি নারায়ণদেব সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিপ্রদাস পিপলাই সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও শিল্পমূল্য বিচার! মনসামঙ্গল কাব্যের গুরুত্ব বিচার
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে লিখুন
অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
অন্নদামঙ্গল কাব্যের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর সম্পর্কে লিখুন
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র