পোস্ট মডার্নিজম নিয়ে কয়েকজন তাত্ত্বিকের আলোচনা করা হলো:
জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতর
জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতরের জন্ম ১৯২৪ সালে। ১৯৬৮ সালে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পোস্ট মডার্নিজমের প্রবক্তাদের মধ্যে লিওতর অন্যতম। জ্যাঁকা লাকা অচেতন ও অবচেতনকে ভাষার প্রক্রিয়ার মত মনে করেন। কারন অবচেতন স্তরে অবদমিত ক্রিয়াগুলো অবচেতনে এসে আকার প্রাপ্ত হয়। এমনকি তৃতীয় মাত্রার আকারও হয় এবং স্বপ্নের মাধ্যমে দৃশ্য হয়ে ওঠে।কিন্তু ভাষা দ্বিমাত্রিক, আকার প্রাপ্ত হয় না। ভাষার মধ্যে সদিও চিত্র নিহিত থাকার চেষ্টা করে, তবুও ভাষার প্রক্রিয়া চলাকালীন অবচেতন স্তর থেকে চিত্রগুলো ভাষার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধা দেয় এবং ভাষার শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে। অবচেতন বা অচেতন স্তরে এই চিত্র বা আকারধর্মীতা ঠিক সেইভাবেই ভাষাকে বাধা দেয়।
ভাষায় যখন আমরা কোন ধ্বংস প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করতে চাই তখন মৃত্যুর চিত্র,আর্তনাদের চিত্র ভাষাকে ধ্বংস ক্রিয়ায় প্রকৃত উপস্থাপনায় বাধা দেয়। ফলে ধ্বংস ক্রিয়াকে আমরা ঠিকমত বর্ণনা করতে পারি না। লিওতর তাঁর ১৯৭৪ সালের “The postman condition. A report on knowledge” – এ বলেছেন যে বেশ কিছুদিন যাবৎ ভাষা, ভাষার ক্ষেত্র, ভাষার বিভিন্ন থিওরি, যোগাযোগের ব্যবস্থা,কম্পিউটার, কম্পিউটারের ভাষা, ডাটা ব্যংক, কম্পিউটারের ভাষার অনুবাদ ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপারই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানই তার আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং ফলতঃ জ্ঞেনের ক্ষেত্রের উপর এর একতা সামগ্রিক প্রতিফলন মতে গেছে। প্রযুক্তির এরকম পরিবর্তনের ফলে এমন একটা সময় আসতে পারে যে, যে জ্ঞান কম্পিউটারের ভাষায় পরিবর্তন করা যাবে না,সে জ্ঞান হয়তো ভবিষ্যতে ঠিকবেই না।
অর্থাৎ জ্ঞান ক্রমশঃ পরিমাণগত হয়ে যাবে। সংবাদ ও জ্ঞান সমার্থক হবে এবং কোনো ব্যক্তির কাছে জ্ঞান ও সংবাদ বিক্রি হবে। ভবিষ্যতে সংবাদের জন্য জাতির মধ্যে যুদ্ধ হয়তো হবে। রাষ্ট্র ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়বে এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলো ক্রমশ কর্তৃত্ব পাবে, আধিপত্য বিস্তার করবে। তিনি বলেন বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞান কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে, আইনসিদ্ধ, ব্যপ্ত ও বিশ্বাসযোগ্য করে নিচ্ছে সেদিকটার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার। তিনি বিজ্ঞান ভিত্তিক বর্ণনাকে ‘ডিসকোর্স’ এবং অন্য ধরনের জ্ঞানকে ‘ন্যারেটিভ’ বললেন। লিওতরের মতে পোস্ট মডার্নিজম হচ্ছে গোটা ন্যারেটিভের প্রতি অবিশ্বাস।
ফেডরিক জেমসন
উত্তরাধুনিকতার অন্যতম চিন্তানায়ক ফেডরিক জেমসন ১৪ই এপ্রিল ১৯৩৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম গ্রহন করেন। তার চিন্তা ধারা মার্কসবাদকে অনুসরণ করেছেন। মার্কসবাদী হিসেবে জেমসন বস্তুর সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে আগ্রহী। তিনি মার্কসবাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুসরণ করেছেন। তিনি উত্তর আধুনিক যুগকে শিল্পোত্তর ভগ্নাংশের যুগ হিসেবে না দেখে ধনতন্ত্রের চরম অবস্থার একটা তরঙ্গের মতো মনে করেন এবং অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ধনতন্ত্রের তিনটি যুগ চিহ্নিত করেছেন। এক বাজারি পুঁজি বা জাতীয় বাজারি পুঁজির যুগ।দুই আধুনিকতার যুগ এবং তিন পোস্ট মডার্নিজমের যুগ।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত তিনি শিল্পের যে পুঁজি সঞ্চিত হয়েছে তাকে বাজারি পুঁজি বা জাতীয় বাজারি পুঁজির যুগ বলেছেন এর পরে আধুনিক যুগ। ধনতন্ত্রের জাতীয় বাজারি অর্থনীতি থেকে জাত অধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন বিচ্ছিন্নতার কথা, শিকড়হীনতার কথা এবং ব্যক্তি পরিচয়ের সংকটের কথা। এগুলোর কথা বলতে গিয়ে তিনি এডওয়ার্ড মানচের দ্য স্কীম নামক ছবিটির কথা উল্লেখ করেছেন।
পোস্ট মডার্নিজমের বর্ননা করলেন সংযোগহীনতা, অসংলগ্নতা ও বিচ্ছিন্ন ভগ্নাংশের সংস্কৃতি বলে। ভগ্ন সংস্কৃতি গোষ্ঠী গুলির তৈরি। এক এক গোষ্ঠীর ভাষা যেন সেই গোষ্ঠীর অধিকার।
জেমসনের মতে উত্তর আধুনিক শহরবাসীরা প্রত্যেকে এক এক জন বিচ্ছিন্ন ভগ্নাংশের মতো অলীক বীক্ষনের মধ্যে, পন্যমনস্কতায় মুগ্ধ হয়ে ভোগ্যপন্যের সংস্কৃতির মধ্যে অগভীর আসার একটা বলয়ের মধ্যে দ্রুততম অথচ অবশ্যম্ভাবী বিস্ফোরণের প্রতীক্ষায় বয়ে গেছে।
এখনকার উন্নত বিশ্বের যে পরিবেশ ইন্টারনেট, কম্পিউটার, এস্কেলেটর, এলিভেটর, বিমান, ইত্যাদি অনুভুতি শূন্যতার মধ্যে কিম ধরা অনুভূতি থেকেও না থাকার এবং সারবিহীন শূন্যতার অনুভূতি এটিই উত্তর আধুনিক ব্যক্তি অস্তিত্বের কেন্দ্রহীনতার ও শূন্যতার অনুভূতি তিনি সারোত্ত বলেন, আধুনিক যুগে সহিত্যিকের অস্তিত্ব ছিল। পার্চ পড়ে বুঝা যেত কার লেখা কিন্তু উত্তর আধুনিক যুগে এটি বুঝার কোন উপায় নাই। পোস্ট মডার্নিজমের ভাষার স্বাভাবিকতা না থাকায় সাহিত্যিবাদের লেখা অনুসরণ করা যায় না বলে অনুকরণের মধ্যমে শুধু প্যাস্টিচ তৈরি সম্ভব।
জেমসন যেহেতু মার্কসবাদী তাই তিনি ইতিহাসের শক্তিকে বিশ্বাস করতেন এবং তিনি মনে করেন বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে মার্কসবাদী মানচিত্র প্রয়োজন অর্থ্যাৎ পোস্ট মডার্নিজম থেকে তিনি আশ্রয় খুঁজেছেন মার্কসবাদে।
জাঁ বোদ্রিয়ার
উত্তরাধুনিকতাবাদের আরেকজন তাত্ত্বিক হচ্ছেন সরাসি দার্শনিক জ্যা বোদ্রিয়ার।তিনি ফ্রান্সে জন্ম ও মৃত্যু বরণ করেন। প্রত্যেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের অগ্রগামী দার্শনিক হিসেবে সমাদৃত। তাঁকে পোস্টমডার্নিজমের পুরোহিত বলা হ। তিনি তাঁর রচিত ‘Simulation (১৯৮১ সালে রচিত, ১৯৮৩ সালে অনূদিত) গ্রন্থের মাধ্যমে উত্তরাধুনিকতার আলোচনায় সামিল হন। বোদ্রিয়ার মূলত অপসৃত বাস্তবতা” (the lose of the real) বিষয়ক বহুলালোচিত বিষয়ের সঙ্গে জড়িত।
যে আলোচনার প্রধান বক্তব্য হচ্ছেঃ আধুনিককালে সিনেমা, টিভি, বিজ্ঞাপনের সর্বব্যাপী প্রভাবের ফলে মানুষের চেতনা থেকে বাস্তব ও কল্পিত, বাস্তব ও মোহ, অগভীর ও গভীর ভাবনার মধ্যে যে ব্যবধান তা ক্রমে অপসৃত হচ্ছে। ফলে জন্ম নিচ্ছে “অধিবাস্তবতা’ (hyper areality)। যে অধিবাস্তবতায় বাস্তবতা ও কল্পনা, বাস্তবতা ও মোহ এ সবের মধ্যে ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে ক্রমেই।তিনি তাঁর আলোচনা শুরু করেন সমৃদ্ধ অতীত নিয়ে, যখন কোন বিষয়ের উপরিভাগের কোন সংকেত বা চিহ্ন দিয়ে তার অন্তর্গত বিষয়ের বাস্থব গভীরতা বুঝা যেত (an outward sing of inward grace ‘to cite the words of the Roman catechism)।
মিশেল ফুকো
পল মিশেল ফুকো একজন ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক।তিনি ১৫ ই অক্টোবর ১৯২৬ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন।২৫ জুন ১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে মারা যান।
তিনি ক্ষমতা ও জ্ঞানের সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। অর্থক ও অর্থিতের নির্দিষ্ট অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং ক্ষমতাকে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে,বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সরানো ছড়ানো, প্রবাহিত বলে বলেনে করেন। এবং স্থানী পর্যায়ে যেখানেই ক্ষমতা থাকবে সেখানেই প্রতিরোধ আন্দোলন থাকবে বলে তিনি মনে করতেন। ফুকো স্থানী জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব দিয়ছেন যে জ্ঞান এক বিশেষ কালে, বিশেষ চিন্তার ক্ষমতার বলয়ে, বিশেষ প্রথাগত ব্যবহারগত আরো বৃহত্তর ভাবনামণ্ডলে, আচ্ছন্ন দমিত অবস্থায় বর্তমান থাকে। এই দমিত জ্ঞানের পুনরুত্থানকে তিনি গুরুত্বপ দিয়েছেন। তিনি একটি থিওরি দিয়েছেন তা’হল জিনিয়ালজি বা বংশানুচরিত জ্ঞান।
ফুকো ক্ষমতার কোনো রকম কেন্দ্রীকতাকে বা উৎসকে স্বীকার করেন না। ক্ষমতার কেন্দ্রহীন এবং অস্তিত্বর তিনি বলেছেন। তিনি ক্ষমতাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন – এক. জুরুডিকেল বা আইনজাত ক্ষমতা।দুই লিবারেল বা রাজনৈতিক ক্ষমতা তিন মার্কসবাদী চিন্তায় ক্ষমতা বা ক্ষমতার মার্কসবাদী স্বরূপ।
ফুকোর মতে ক্ষমতার প্রয়োগটাই আসল কথা। প্রকৃত পক্ষে ক্ষমতা হচ্ছে তাই, যা নাকি দমন করে রাখে। ক্ষমতা দমন করে রাখে স্বভাবকে, শ্রেণিকে, ব্যক্তিবিশেষকে তো অবশ্যই। অন্যদিকে ক্ষমতাকেই আবার যেভাবে দমিত রাখা হোক না কেন তার থেকে একটা সংঘর্ষের জন্ম নেবেই। এই সংঘর্ষ বা সংগ্রাম থেকেই দমিত জ্ঞান গুলি পুনরুত্থিত হয়।
ক্ষমতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ক্ষমতার আলাপ যে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। তাই আমাদের অধিকার বোধকে জাগ্রত করে, পালন করতে শেখায়, অধিকার বোধ এর সীমা মানতে শিখায়। অধিকার বিষয়টা আসলে প্রভুত্বের ক্ষমতা পরিণত হয় প্রভুত্বে। এই প্রভুত্ব সমাজে একটা শ্রেণির প্রভুত্ব, অন্য শ্রেণির ওপরে। অধিকার সম্পর্কিত প্রথাগুলি প্রভুশেণির ও অন্য বর্গীয় শ্রণির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধরনের প্রথা গুলি, আইনকাননগুলি, ডিসকোর্সগুলি ওই সম্পর্ক নির্ধরনের জন্যই রচিত। মূল বিষয়টি হল আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের। প্রধানত নিয়ন্ত্রিতদের জন্যই মূলত ডিসকোর্স। ক্ষমতা বস্তুতপক্ষে একটা প্রবাহের সূত্রের মতো শৃঙ্খলের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। সেই শৃঙ্খলের সংযোগ গ্রন্থিগুলির মধ্যে রয়েছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, শ্রণি সবকিছুই এবং ক্ষমতা রয়েছে প্রবাহমান অবস্থায় তার মধ্যে দিয়েই। ফুকো মনে করেন ক্ষমতার কোন কেন্দ্র বা উৎসহ থাকে না। ক্ষমতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ অনু পরিমান প্রক্রিয়াগুলি তাদের নিজস্ব ইতিহাস ধরে নিজস্ব পথ ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জ্যাক ডেরিডা
জ্যাক ডেরিডা একজন ফরাসি দার্শনিক। তিনি ১৫ জুলাই ১৯৩০ সালে আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯ই অক্টোবর ২০০৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে মৃতুবরণ করেন। ফুকো যেমন কেন্দ্রহীনতার কথা বলেছেন, তেমনি ডেরিডা ও এই কেন্দ্রহীনতার যুগে কেন্দ্রের পাদপীঠ অনুসন্ধান করে ‘বাইনারি অপজিমন ‘বা বিরোধার্থক শব্দগুলোর সন্ধান পেয়েছিলেন। এর উপর ভিত্তি করেই তিনি বিনির্মাণতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু বিনির্মাণতত্ত্বের নিমার্ণে তিনি সমস্যাজনক কেন্দ্রটিকেই বিকেন্দ্রীকৃত করার চেষ্টা করেছিলেন। ডেরিডার কাছে কেন্দ্রের চিন্তাটাই সমস্যাজনক। কেন্দ্র নাই অথচ কেন্দ্রের আশ্রয় ছাড়া আমাদের চলে না। কেন্দ্র সব সময়ই যেন বর্জন করার চেষ্টা করে। বর্জন করতে গিয়ে কেন্দ্র অবঙ্গা করে, দমন করে এবং অন্য সব কিছুকে প্রান্তে ঠেলে দেয়।
যেকোন শব্দজোড়া মধ্যে যেমনঃ হিন্দু- মুসলিম, সাদা-কালো,কমিউনিস্ট-গণতন্ত্র, ইত্যাদি যদি একটা কেন্দ্রে থাকে। তাহলে অন্যটি সংঘর্ষের ফলে একেবারে প্রান্তে চলে যায়। কেন্দ্র অবস্থিত শব্দটিই বাস্তবে হয় ওঠে। অন্যটি দমতি হয়ে যায়। এভাবে অপর শব্দটি কেন্দ্রে আসলে অন্যটি প্রান্তে চলে যায় এবং দমিত হয়ে যায়। এটিই হল বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া। ডেরিডা চিন্তার মাঝে কেন্দ্রের সমস্যার কথা থাকলে ও তাতে আছে কেন্দ্রকে ঘিরে পাবার চিন্তার।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
পোস্ট মডার্নিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
পোস্ট মডার্নিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ