বিংশ শতকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য আন্দোলন হল উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য আন্দোলন। মূলত সাবেক ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তিগুলোর অধীনস্থ দেশগুলোতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। উত্তর-উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক ও লেখকরা, উপনিবেশিকতাবাদ সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর উপনিবেশিক প্রভাবকে মেনে নেননি। তারা এই প্রভাব থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণে প্রয়াসী। উপনিবেশবাদীরা যেখানে প্রাক-উপনিবেশিক যুগের সব কিছুকে বর্বর বলে খারিজ করে দেয়, উত্তর উপনিবেশবাদী লেখকরা সেখানে প্রাক ঔপনিবেশিক যুগের সংস্কৃতির মাঝে গর্বের উপাদানগুলো অনুসন্ধান করে, ঔপনিবেশিক আমলের নৃশংসতার স্বরূপ উন্মোচন করে। মানুষের উপনিবেশিক মনস্কতার দর্শন ও মনস্তত্বকে চিনিয়ে দেওয়া এবং তার থেকে উপনিবেশিতদের টেনে বের করা উত্তর-উপনিবেশবাদীদের লক্ষণ। উত্তর- উপনিবেশী সাহিত্যিকরা প্রায়ই ইউরোপীয় লেখকদের উপস্থাপিত দৃষ্টিভঙ্গির পাল্টা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, যাকে বলা হয় কাউন্টার ডিসকোর্স (Counter discourse)।
বিশ্ব সাহিত্যে উত্তর-উপনিবেশিকতার তাত্ত্বিক সূত্রপাত আমেরিকা প্রবাসী ফিলিস্তিনী পন্ডিত এডওয়ার্ড সাইদের হাত ধরে।
উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলমের মতে, “উপনিবেশী শাসকদের উদ্যেগে সমর্থনে পরিচালিত স্বার্থসংশিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞানচর্চার কারণে উপনিবেশিত দেশ ও জাতির ঐতিহ্য অভিজ্ঞতা ও ভাবনার জগৎ ও তার ক্ষেত্রে যেসব নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে সেগুলো চিহ্নিত ও দূর করা এবং আধিপত্যমুক্ত জ্ঞানচর্চার পথ খুলে দেয়ার কিছু তাত্ত্বিক প্রণোদনা ও উপায় এবং একরকম আন্দোলন বলা যেত পারে উত্তর-উপনিবেশবাদ। চরিত্রের দিক থেকে এটি একটি পাল্টা জ্ঞানভাষ্য।” [আলম, ফয়েজ (২০০৬), উত্তর- উপনিবেশী মন ঢাকা; সংবেদ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১১]
আধুনিকতার প্রতি উত্তর-উপনিবেশবাদীদের বিরোধীতা বহুলাংশে ইতিবাচক। কারণ তাদের বক্ত্যবে আধুনিকতার পরিচয় চরম বিদ্বেষ, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার চিহ্ন ও সুযোগ পরিলক্ষিত হয় না, যৌক্তিক শৃঙ্খলা, কাঠামো, স্তরবিন্যাস, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ভেঙে ফেলার বাসনা নেই, রয়েছে উপনিবেশবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র-প্রান্ত, জাতীয় বিন্যাস ভাঙার উদ্দেশ্য। তবে আধুনিকতাবাদীদের দুঃখ, ক্ষয়, জীবনের প্রতি বিবমিষা, সর্বগ্রাসী হতাসা ও অর্থহীনতার বোধ থেকে উত্তর- উপনিবেশবাদীরা মুক্ত। তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে ইতিবাচক ও আশাবাদী। উপনিবেশী শাসনপুষ্ট শিক্ষাব্যাবস্থা ও জ্ঞান চর্চার কারণে এক শ্রেণির মানুষের দ্বারা অন্য শ্রেণির মানুষের ওপর যে শোষণ চালিত হয় তা দূর করার প্রণোদনাও উত্তর উপনিবেশবাদে রয়েছে।
১৯৭৮ সালে ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড ডাব্লিউ সাঈদের ‘অরিয়েন্টালিজম’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর উপনিবেশবাদ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এর সাথে যুক্ত হয় ইব্রাহিম ফ্রানৎজ ফানোর ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’ ও ‘রেচেড অব দি আর্থ’ বই দুটোই উপনিবেশিত মানুষের উপনিবেশী শাসনের নেতিবাচক প্রভাবের দুর্দান্ত মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ। এর আগে বিষয়টি ছিল শুধুই রাজনৈতিক স্বাধীনতা- পরাধীনতা বিষয়ক আলোচনায় সীমাবদ্ধ। সাঈদ তার বইয়ে বিশ্লেষণ করে দেখান কীভাবে পশ্চিমের রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কয়েকশত বছর ধরে বিভিন্ন গ্রন্থাদি লিখে প্রাচ্যকে সকল দিক থেকে হীন এবং পশ্চিমকে উন্নত বলে প্রচার করেছে। এক পর্যায়ে পশ্চিমের মানুষ তা বিশ্বাসও করে।
পরে প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ দখল করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রাচ্য সম্পর্কিত এই হীন ধারনা প্রাচ্যের মানুষদের মনেই গেঁথে দেওয়া হয় এই ধারণা উপনিবেশী শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে।
এইসব উপনিবেশী প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দেশজ ঐতিহ্য, নিজস্ব জ্ঞান এবং ঐতিহাসিক অর্জন ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজেদের নতুনভাবে গড়ে নিতে চান উত্তর – উপনিবেশবাদীরা।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)