নারীবাদী তত্ত্ব : নারীমুক্তি সম্পর্কে কয়েকটি তত্ত্বাদর্শ রয়েছে; এগুলো হচ্ছে রক্ষণশীল মতবাদ, উদার (মানবতাবাদী) বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ, মার্কসীয় নারীবাদ, আমূল নারীবাদ।
* রক্ষণশীল মতবাদ
এটি নারীমুক্তির বিরোধী। রক্ষণশীল নারীবাদ মনে করে, ‘নারীর জন্ম শুধু পুরুষের জন্য’-এ কথাটি সর্বাংশে যথার্থ, চিরন্তন সত্য নারী সংসার নিয়ে থাকবে। এই সংসার বৃত্তেই নারী নিজেকে গড়ে তুলবে। স্বামী ও সংসারের মধ্যেই তার বিকাশ ও তৃপ্তি। নারীবাদের লড়াই এ মতবাদের বিরুদ্ধেই। এ মতবাদ মেলে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে: ধর্মগ্রন্থ, আইন, দর্শন সবখানেই এ মতবাদ ছড়িয়ে আছে। এ মতবাদ অনুসারে নারীরা যে অসাম্য ভোগ করছে, তা অন্যায় ন্যায়; এ চিরন্তন শাশ্বত । রক্ষণশীলদের মতে কোনো কোনো নারী পোহায় নানা দুর্ভোগ, তবে সমাজ নারীদের সুপরিকল্পিতভাবে পীড়ন করে না। রক্ষণশীলেরা মনে করেন নারীর যে অবস্থা, তা প্রকৃতিনির্ধারিত, বা বিধাতার নির্দিষ্ট, প্রকৃতি বা বিধাতাই ঠিক করে দিয়েছে যে নারী- পুরুষ অসম, পুরুষ প্রভুত্ব করবে, নারী থাকবে তাঁর অনুগত। এটা কোনো অন্যায় নয়, এটা ধ্রুব বিধান।
* উদারপন্থী নারীবাদ
উদারপন্থী নারীবাদ বা লিবারেল নারীবাদ নারী স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ নারীবাদ পুরুষ অধিকারের পাশাপাশি নারী অধিকারের ওপর সমান মূল্য আরোপ করে। তাই লিবারেল নারীবাদ মনে করে যে, নারী-পুরুষ সমতা অর্থাৎ সম অধিকার অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করা হবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। যুগে যুগে সমাজ নারীর সামাজিক ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করেছে এবং পুরুষের ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। নারী-পুরুষ ভূমিকার মাঝে সমতা আনয়ন এ নারীবাদের মূলমন্ত্র। এ মতবাদের উদ্ভব ঘটে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ‘ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব ওম্যান’-এ (১৭৯২), এবং পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘দি সাবজেকশন অব উইমেন’-এ (১৯৬৯)।
এ প্রসঙ্গে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁরা মনে করেন যে, পরাধীন সত্তার মুক্তির আন্দোলন হলো লিবারেল নারীবাদ।” এ মতবাদের বক্তব্য হচ্ছে কোনো ভূমিকায় প্রতিষ্ঠার জন্য বিবেচনা করতে হবে শুধু ব্যক্তিকে, ব্যক্তির যোগ্যতাকে, আর কিছু নয়। প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণের কোনা মূল্য নেই: তাই বিচার করতে হবে শুধু ব্যক্তিটিকে। উদার নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, ব্যক্তিগত ব্যাপারে রাষ্ট্র যত কম হাত দেয়, ততই ভালো; তাই রাষ্ট্রের নারীর অভিভাবকত্বের কোনো দরকার নেই। নারীকে আগে থেকেই বিশেষ কোনো ভূমিকার আটকে ফেলা অন্যায়; নারী সব ভূমিকায় নিজেকে পরখ করে একদিন নিজেই দেখছে সে কোন ভূমিকার উপযুক্ত।
* মার্কসীয় নারীবাদ
মার্কসীয় নারীবাদ ঐতিহাসিক ধারায় নারীর অবনত অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার দিকে জোর দেয়। ঐতিহাসিক ধারায় লক্ষ করা যায় যে, মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে পুঁজিবাদ। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, অধস্তনতার নীতি এবং মূল কাঠামোর বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে পারলে নারীমুক্তি ও নারী-পুরুষ সমান অধিকার সম্ভব বলে মনে করে মার্কসীয় নারীবাদ। লিবারেল নারীবাদ যেখানে নারীসত্তার দিকটির ওপর বারবার গুরুত্ব আলোপ করেছে মার্কসীয় নারীবাদ সে ক্ষেত্রে শোষিত জনসমাজের একটি অংশ হিসেবে শোষিত নারীর বস্ত্রগত অবস্থানকে তুলে ধরেছে।
মার্কসীয় দর্শনের ভিত্তিতে মার্কসীয় নারীবাদ গড়ে উঠেছে। তাই মার্কসীয় নারীবাদ মনে করে যে, পুঁজিবাদের সমাজ কাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে। যে সমাজ অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রাখে তা থেকেই ঐ সমাজে অন্যান্য বৈষম্য গড়ে ওঠে। তাছাড়া পরিবারে অভ্যন্তরে নারীর অবদমিত অবস্থা, এমনকি কর্মস্থলে নারীর অধস্তন অবস্থা পুঁজিবাদী ধনতন্ত্রের অন্তর্গত।
মার্কসীয়দের মতে নারী ও শ্রমিকের স্বার্থ একই, কেননা নারী ও শ্রমিক একই রকমে শোষিত, মার্কসীয় নারীবাদের উদ্ভব ঘটে এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৮৪) সন্দর্ভে। মার্কসীয়রা বলেন যে, নারীশোষণ পুঁজিবাদের সৃষ্টি; তবে তাদের মতে পুঁজিবাদ নারীশোষণ বহুগুণে বাড়িয়েছে, এবং নারীকে অবনতির শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। তাঁদের মতে পুঁজিবাদ আর পুরুষাধিপত্য অবিচ্ছেদ্য, একটি শক্তিশালী করে আরেকটিকে, এঙ্গেলস বলেছেন, ‘সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কৃত হয়ে স্ত্রী- ই হলো প্রথম ঘরোয়া ঝি’, এবং ‘সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে গোটা স্ত্রী জাতিকে আবার নিয়ে আসাই হচ্ছে তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত।’ তখন নারী আর স্বামীর ওপর ভরণ-পোষণের জন্যে নির্ভর করবে না, নারী স্বাধীন হবে। তবে এর জন্যে দরকার সমাজের মৌলিক রূপান্তর।
* আমূল নারীবাদ
এই শ্রেণির নারীবাদীগণ সংস্কারে বিশ্বাসী নয়। তারা নারীর সচেতনতার ওপর জোর দেন। তারা মনে করেন, সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নারী নির্যাতন বন্ধ করে বৈষমে শিকড় উৎপাটনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যে সমাজে নারী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সে সমাজের সকল কাজে নারী অংশ নিতে পারবে এবং যৌন স্বাধীনতাও ভোগ করবে। তারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থা বিশেষত জেন্ডার ব্যবস্থা তুলে দিতে চান। নারীর অধস্তনতাকে তারা ‘নারী- পুরুষের জৈবিক সম্পর্কের ফল হিসেবে দেখেন। তারা মনে করেন, গর্ভধারণ করতে গিয়েই তাদেরকে দূরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে পুরনো ও মৌলিক পীড়ন হচ্ছে নারীর দেহকে পুরুষের অধীনে সমর্পণ করা। বিয়ে, সমাজ বা প্রজন্ম রক্ষা ইত্যাদি যে নামেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, নারীর দেহই নারীর নিয়তি।
আমূল নারীবাদ নারীর পীড়নকে দেখে লৈঙ্গিক পীড়ন’ হিসেবে। আমূল নারীবাদ মনে করে, নারী আর এককভাবে সন্তান ধারণের দায়িত্ব নেবে না। এ দায়িত্ব তাদের একা হতে পারে না। নারীমুক্তির জন্য তারা ‘জৈবিক বিপ্লব’ দরকার বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, আধুনিককালে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে কৃত্রিমভাবে সন্তান জন্মদান সম্ভব। জৈবিক বিপ্লবের ফলে জৈবিক পরিবার বিলুপ্ত হলে শুধু যৌন পীড়নই বন্ধ হবে না, নারী সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে নিজেই নিজের ভূমিকা ঠিক করে নিতে পারবে; নারী প্রকৃতিপ্রদত্ত নিজ দেহের ওপর কর্তৃত্ব ফিরে পাবে। তখন কে কার সাথে ও কোন ধরনের যৌন সম্পর্কে জড়িত হবে, তা স্থির করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে প্রতিটি নর-নারীর। তখন সমকাম-পুরুষের সাথে পুরুষের, নারীর সাথে নারীর- নিন্দিত থাকবে না, বিকল্প বলেও গণ্য হবে না; যে যার রুচিমত বেছে নেবে বিশেষ ধরনের যৌন সম্পর্ক; উদার নারীবাদীদের মতে সমকাম বিষমকামের বিকল্প, মার্কসীয়দের মতে সমকাম পুঁজিবাদী বিকৃতি; আমূল নারীবাদীদের মতে এটা স্বাভাবিক। তাঁদের মতে জৈবিক বিপ্লবের ফলে ‘সমকাম’ ‘বিষমকাম’ প্রভৃতি ধারণাই লোপ পাবে; লোপ পাবে ‘যৌনসঙ্গম’ নামের ‘সংস্থাটি’ও, যাতে নারী-পুরুষ পালন করে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা
মর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতে সমাজে নারীর অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নারীবাদ তৎপর, নারীবাদী আন্দোলন নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকার প্রভৃতি বহুবিধ বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি নারীর আত্মসম্মানের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে। নারীবাদী চর্চার প্রয়োগ রাজনৈতিক এবং প্রথা অনুযায়ী অরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারীবাদীরা প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন প্রকার আইন বিরোধী কর্মকান্ড বিশেষত: অন্যান্য কর্মকান্ড সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। নারীবাদ সাক্ষাৎকার পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার পুনরাবির্ভাবের জন্য প্রদত্ত যুক্তিসমূহ সাক্ষাৎকার, পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত ধারণাকে প্রভাবিত করেছে। নারীবাদের বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে নারীবাদের মধ্যকার এবং বাইরের অনেক চিন্তাবিদদের মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তাই সমাজ, সংস্কৃতি, জনমানুষের বিদ্যমান বাস্তবতাকে বিবেচনা করে যৌক্তিক ব্যাপারগুলো গুরুত্ব দেয়াতেই কল্যাণ। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিককে বিশেস্নষণ করেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে সকলকে সজাগ ও সচেতন হতে হবে।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
নারীবাদের স্বরূপ ও পরিসর সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদ কী বা নারীবাদ কাকে বলে? নারীবাদের সংজ্ঞার্থ প্রদান করুন
নারীবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
নারীবাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদী তত্ত্ব কী? নারীবাদী তত্ত্ব কত প্রকার ও কী কী – আলোচনা করুন
নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ বা নারীবাদের ধারাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করুন