নারীবাদের বিভিন্ন ধারার প্রধান প্রধান শিল্পী ও তাঁদের কাজ :
১) উদারতাবাদী/উদারপন্থী নারীবাদ: এটি সাধারণ নারীবাদ নামেও অভিহিত যা নারীবাদের একটি প্রধান শাখা। উদরতাবাদী গনতন্ত্র কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক এবং আইন সংশোধনের মাধমে লিঙ্গ সমতা অর্জন এর লক্ষ্য। এটি নারীবাদী চিন্তার “ভিনটি বড় বিদ্যালয়ের” একটি। প্রচলিত নারীবাদ থেকে এর উ পত্তি ঘটে এবং ১৯ শতকের শেষের দিকে এটি সামাজিক নারীবাদের সাথে জড়িত হয়। উদারবাদী নারীবাদীরা যেসব আইন লিঙ্গ সমর্থন করে এবং নারীদের প্রতি বৈষম্য করে এ প্রথাগুলোকে নিষিদ্ধ করেন। উদারপন্থী নারীবাদ মানুষের যুক্তিবাদী মনন ও চিন্তা বিশ্বাসী এবং সেই যুক্তি দিয়েই মনে করে যে পুরুষ ও নারীর মধ্যে চিন্তা, বুদ্ধি ও মেধার দিক থেকে কোনো তারতম্য নেই। সেই কারণেই সমাজে বসবাসকারী নারী পুরুষের একই অধিকার উপভোগ করা উচিত। এই কারণেই নারীদের পুরুষদের মতো ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, সমান আইনি অধিকার থাকা উচিত।
উদারপন্থী নারীবাদের সূচনা ঘটে মেরি উলস্টোনক্রাফটের রচনার মধ্যে দিয়ে A Vindication of the Rights of Women বইতে তিনি নারী ও পুরুষের সমঅধিকার নিয়ে কথা বলেন, এছাড়াও উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন- জন স্টুয়ার্ট মিল, হেলেন টেইলর, এলিজাবেথ ক্যাডি স্টেনটোন এবং বেটি ফ্রাইডেন, রেবেকা ওয়াকর উল্লেখযোগ্য।
ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট: (১৭৫৯-১৭৯৭)
পূর্বেই বলেছি তাঁর লেখা বিখ্যাত বইটিতে তিনি নারী পুরুষের সমঅধিকার নিয়ে বলেছেন। এছাড়াও তিনি বলেছেন নারীবাদেরদ জন্য তৈরিকৃত সিদ্ধান্ত সমূহ থেকে বেরিয়ে নিজেদের কন্ঠস্বর কাজে লাগিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে।
তিনি জুদিথ সারজেন্ট মুরে এবং ফ্রান্সেজ রাইট এর সাথে রাজনীতিতে নারীরযুক্ত হওয়ার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সমর্থকদের একজন ছিলেন।
জন স্টুয়ার্ট মিলস: (১৮০৮-১৮৭৩)
এর মতে আইনের অধীনে উভয় লিঙ্গের সমান অধিকার পাওয়া উচিত এবং যতক্ষণ সমতার অবস্থা না তৈরি হবে ততক্ষণ নারী ও পুরুষের প্রাকৃতিক পার্থক্য এবং তা কতটা বিকৃত হয়েছে তা নির্ণয় করতে পারবে না। মিলস প্রায়ই এই ভারসাম্যহীনতার কথা উল্লেখ করতেন। ম্যারির মতো তিনি যৌন বৈষম্যকে দাসত্বের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর বই- দা সাবজেকশন অব ওমেন-এ লিখেছেন-নারীদের জীবনের তিনটি অংশ তাদের ক্ষতি করে। – ১) গঠন ২) শিক্ষা ৩) বিবাহ। তিনি আরও বলেন যে, যৌন বৈষম্য মানব সভ্যতার প্রগতিতে চরমভাবে বাধা প্রদান করছে।
এলিজাবেথ ক্যাডি স্টেনটোন:(১৮১৫-১৯০২)
তিনি ছিরেন একজন মার্কিন সমাজকর্মী এবং তিনি সেনেকা ফোলস এ অনুষ্ঠিত সেনেকা ফোলস সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর কাছে শুধু ভোটাধিকার আন্দোলনই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না বরং তিনি নারী পৈত্রিক এবং তত্ত্বাবধান, বিবাহ বিচ্ছেদ, আইন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক অধিকারের সাথে ও জড়িত ছিলেন। তার সঙ্গে আন্দোলনে সমান গুরুত্বপূর্ণ সুজান বি অ্যানথোনি। তারা দুজন যৌথভাবে জাতীয় নারী ভোটাধিকার সংগঠন (এনডাবলিউএসএ) গঠন করেন, সংগঠনটি ভোটাধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে কার্যকরী আইন এবং আদালতের দিকে মনোযোগ প্রদান করে।
২) উগ্রপন্থী নারীবাদ: এরা মূলত সমাজে চলা পুরুষতন্ত্রবাদের শেকড় তুলে ফেলার জন্য তীব্র এবং সহিংস আন্দোলন গড়ে তুলে থাকেন। উগ্রনারীবাদীরা সমাজকে মৌলিকভাবে একটি পুরুষতন্ত্র হিসাবে দেখেন যেখানে পুরুষেরা নারীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং নিপীড়ন করে। এর সমাজে বিদ্যমান সামাজিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে অন্যায়যুক্ত সমাজ থেকে সবাইকে মুক্তি দেওয়ার সংগ্রামের লড়াইয়ে পুরুষ তন্ত্রকে এক ফ্রন্ট হিসাবে বাতিল করার চেষ্টা করেছেন।
এধারার বিখ্যাত নারীবাদীগন হলেন- কেট মিলেট, রবিন মরগান, মেরি দালি, সুলামিথ ফায়ারস্টোন, সুসান ব্রাউনমিলার, এলিন উইলিস, ক্যাথরিন ম্যাককিনন জারমেন গিয়ার, জিল জনস্টন প্রমুখ। এই ধারার নারীবাদীদের সংগঠনগুলোর একটি রেডস্ট কিংস। ১৯৬৯ এ সুলামিথ ও এলিনের উদ্যোগে গড়ে উঠে এই রেডস্ট কিংস।
সুলামিথ ফায়ারস্টোন:
নিউ ইয়র্ক র্যা ডিকেল উইমেন নামে আরেকটি সংগঠনের কো- ফাউন্ডার ছিলেন। তার বিখ্যাত বই The Dialectic of Sex প্রকাশ হয় ১৯৭০ সালে। এ বইয়ে তিনি বলেছেন-নারীর উচিত নিউক্লিয়ার পরিবারের কাঠামোর ধারণাটি উল্টে দেয়া।
কেট মিলেট: (১৯৩৪-২০১৭)
তিনি ছিলেন মার্কিন নারীবাদী লেখক ও সমাজকর্মী। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তার বই Sexual Politics তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ভিনি নারীদের জৈবিক জায়গাটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর বইটিতে তিনি জানিয়েছেন- পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতে নারীর পক্ষে যৌনভাতৃপ্তি অসম্ভব কারণ এই যৌন নিপীড়নের মাধ্যমেই নারীর উপর শোষণ চালায় পুরুষ। এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধনই নারীমুক্তির সম্ভাব্য পথ হিসেবে বিবেচনা করেছেন তিনি।
৩) সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ : সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ হল একটি দ্বি-মুখী তত্ত্ব যা নারীর নিপীড়নে পুঁজিবাদের ভূমিকার জন্য মার্কসবাদী নারীবাদের যুক্তি এবং লিঙ্গ ও পুরুষতন্ত্রের ভূমিকার উগ্র নারীবাদের তত্ত্বকে বিস্তৃত করে। সমাজ তান্ত্রিক নারীবাদীরা উগ্র নারীবাদের প্রধান দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে যে পিতৃতন্ত্রই নারীর নিপীড়নের একমাত্র বা প্রাথমিক উস। কয়েকজন প্রধান সমাজতান্ত্রিক তাত্তিক হলেন :- জুলিয়েট মিশেল, আইরিশ ইয়ং।
জুলিয়েট মিশেল
জুলিয়েট মিশেল সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের প্রধান প্রবক্তা। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী হিসেবে নারী জাগরণের জন্য তিনি এক তান্ত্রিক ভিত্তি বিনির্মাণ করেন। তারা রচিত সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী গ্রন্থগুলো হলো Women: The Longest Revolution, Women’s Estate Psychoanalysis and Feminism. জুলিয়েট মিশেল পুঁজিবাদকে জড় বা বস্তুগত, অর্থনৈতিক বিষয়, আর পিতৃতন্ত্রকে অজড়, অবস্থাগত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
আইরিস ইয়ং
আরেকজন প্রখ্যাত সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী আইরিস ইয়ং। আইরিস ইয়ং এর মতে শ্রেণী কে বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করে নারীবাদীরা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে উভয় ব্যবস্থায় নারী নির্যাতনের কারণ ব্যাথা করতে পারবে না। তার মতে জেন্ডার ভিত্তিক শ্রম বিভাজনেই নারী অধি:স্তনতার মূল কারন। তিনি যৌনতা, মাতৃত্ব ও বুদ্ধি বৃদ্ধির মানদন্ডে নারীর বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাখ্যা করেছেন।
৪) মার্ক্সীয় নারীবাদ : ১৯শ শতকের শেষার্ধে মার্ক্সবাদী মতবাদকে কেন্দ্র করে যে নারীবাদী মতবাদ গড়ে ওঠে তা মার্ক্সীয় নারীবাদ নামে পরিচিত। ১৮৮৪ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস একটা গ্রন্থ লেখেন নাম দি অরিজিন অফ দ্যা ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রোপারটি এন্ড দ্যা স্টেট। এখান থেকে প্রথম মার্ক্সীয় নারীবাদের ধারণা পাওয়া যায়। এই মার্ক্সীয় নারীবাদ অনুসারে নারীর অধস্তনতার ও নির্যাতনের কারণ ব্যক্তির স্বেচ্ছাপ্রনোদিত কর্মকান্ডের ফল নয়, পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজ কাঠামোই নারীর অধ:স্তনতার মূল। এখানে স্বেচ্ছাপ্রনোদনা বলতে পুরুষের ইন্ডিভিজুয়ালি ক্যারেক্টারিসটিকের কথা বলা হয়েছে।
মার্ক্সীয় নারীবাদ ব্যক্তি মালিকাকানা কেন্দ্রিক শ্রেণিবিভক্ত সমাজকেই চিহ্নিত করে। এই মতবাদের প্রবক্তাগন মনে করেন লৈঙ্গিক পাথক নয়, পুঁজিবাদের দ্বারা সৃষ্ট শ্রেণি বৈষম্যেই নারীর অধ:সন্তনতার জন্য দায়ী। এই নারীবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রেণিহীন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, পুঁজিবাদের উচ্ছেদ সাধন, নারীর গৃহশ্রমের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ আর এগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের সকল নারীর মুক্তি। শালট পারনিস গিলম্যান (১৮৯৮) সহ আরও কিছু সমাজতান্ত্রিক লেখকদের উদ্ভব হয়, মার্ক্সস এসেলস এর পরবর্তী সময়ে। শারলট পারকিনস গিলম্যান এর লেখায় ক্ষতিপূরণযোগ্য পুনর্ পাদনশীল শ্রম তৈরীর ধারণা উপস্থিত আছে। ক্ষতিপুরণযোগ্য প্রচারণা হচ্ছে International Wages for Housework Campaign. এটি ১৯৭২ সালে ইতালিতে ইন্টারন্যাশনাল ফেমিনিস্ট কালেক্টিভ কর্তৃক চালু হয়। সালমা জেমস, মারিয়ারোসা, ডালা কোস্টা, ব্রিজেট গাল্টিয়ার এবং সিলভিয়া ফেডেরিচি এসময় একাডেমিক এবং পাবলিক ডোমেইন প্রচুর পরিমানে লেখা প্রকাশ করে।
৫) অস্তিত্ববাদী নারীবাদ: বিংশ শতাব্দীর সর্বগ্রাসী জীবব্যবস্থার ব্যক্তির পরিচয় নিরুপনে ব্যক্তিবাদী মতবাদ হিসেবে অস্তিত্ববাদ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, অস্থিত্ব ও স্বাভন্ত্যের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই অস্তিত্ববাদী নারীবাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। সেখানে নারীর তার নিজ সত্তাকে বিকশিত করবে এবং সেখানে নারী পুরুষের মাঝে সাম্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে। অস্থিত্ববাদী নারীবাদের প্রধান প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ভোয়ারী।
১৯৪৯ সালে তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ The Second Sex প্রকাশ করেন। উক্ত গ্রন্থটি বিংশ শতাব্দীর ৬০ দশকে মার্কিন নারীমুক্তি আন্দোলন এবং ৭০ এর দশকে ইউরোপীয় নারীদের আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেন। সিমন দ্যা বুভোয়ার বলেন অস্থিত্ববাদী নারীবাদে নিজ বা আত্ম এবং অন্য বা অপর এর ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে Self বা নিজ হচ্ছে পুরুষ এবং Other বা অপর হচ্ছে নারী। অপর অর্থ্যা] নারী হচ্ছে নিজ তথা পুরুষের জন্য হুমকি সরূপ। তাই পুরুষ নিজের স্বাধীনতা রক্ষার্থে নারীকে অবনত করে রাখে। সিমন দ্যা বুভোয়ার মনে করেন এভাবেই পুরুষ নিজের সত্তার মধ্যে নারীকে ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়া নেয়ায় নারী ও পুরুষের মাঝে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়।
অর্থ্যা নিজ পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করলে “অপর” এর সাথে বিরোধ বাঁধে। বুভোয়ার নারী পুরুষের এই সংঘাতকে অস্তিত্ববাদের সংঘাত হিসেবে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটলেই আপনা আপনি সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্কে সম্যতা আসবে। কিন্তু সিমন দ্যা বুভোয়ার বলেন, নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য পুরুষ নানা কাল্পনিক কাহিনী সৃষ্টি করে। নারীকে চিত্রিত করে রহস্যময়ী, বিচারশক্তিহীন, বহুরুপী হিসেবে। আর এভাবেই কল্প লেখকদের লেখনী নারীকে “অপর” এ পরিণত করে। তাই সিমন দ্যা বুভোয়ার মনে করেন নারী তার “নিজ” কে সাবজেক্টে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে নারীর প্রচলিত ভূমিকার অবসান ঘটাতে হবে এবং নারীকে নতুন রূপে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। তাহলে নারী আর পুরুষের “অপর” থাকবে না।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
নারীবাদের স্বরূপ ও পরিসর সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদ কী বা নারীবাদ কাকে বলে? নারীবাদের সংজ্ঞার্থ প্রদান করুন
নারীবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
নারীবাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদী তত্ত্ব কী? নারীবাদী তত্ত্ব কত প্রকার ও কী কী – আলোচনা করুন
নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ বা নারীবাদের ধারাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করুন