নিম্নবর্গতত্ত্বের প্রধান প্রধান তাত্ত্বিকগণ:
- আন্তোনিও গ্রামশি
- দীপেশ চক্রবর্তী
- রণজিৎ গুহ
- শাহিদ আমিন
- ডেভিড হার্ডিম্যান
- পার্থ চট্টোপাধ্যায়
- বীণা দাস
- জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে
আন্তোনিও গ্রামশি:
সাবলটার্ন শব্দটি গ্রামশি ব্যবহার করেছেন অন্তত দুটি অর্থে। একটি অর্থে এটি সরাসরিভাবে ‘প্রলেটারিয়াট’-এর প্রতিশব্দ। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ‘সাবলটার্ন শ্রেণী’ হল শ্রমিকশ্রেণী। সামাজিক ক্ষমতার এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী শোষিত ও শাসিত হয়। এই বিন্যাসে ‘সাবলটার্ন’ শ্রমিকশ্রেণী বিপরীত মেরুতে অবস্থিত ‘হেগেমনিক’ শ্রেণী অর্থাৎ পুঁজিমালিক, ‘বুর্জোয়াসি’। শ্রমিকশ্রেণী/বুর্জোয়াশ্রেণী, এই বিশেষ অর্থে সাবলটার্ন/হেগেমনিক শ্রেণীর সামাজিক সম্পর্কের বিষয়ে গ্রামশির বিশ্লেষণ আধুনিক মার্কসবাদী আলোচনায় এক বিশিষ্ট অবদান। এই বিশ্লেষণে গ্রামশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির উপর যার মাধ্যমে বুর্জোয়াশ্রেণী কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না, সৃষ্টি করে এক সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব বা ‘হেগেমনি’। কেবল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে অবলম্বন করে এই সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘হেগেমনিক’ বুর্জোয়াশ্রেণী তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ‘সাবলটার্ন’ শ্রমিকশ্রেণীর কাছ থেকে সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয়। গ্রামশির বিশ্লেষণে তাই গুরুত্ব পায় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সম্পর্ক, জাতি, জনগণ, বুর্জোয়াশ্রেণী ও অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক, জাতীয় জীবনের একচ্ছত্র প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, বুর্জোয়াশ্রেণীর সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, ইত্যাদি প্রশ্ন।
কিন্তু আরও সাধারণ অর্থেও ‘সাবলটার্ন’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামশির লেখায়। কেবল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নয়, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অন্যান্য ঐতিহাসিক পর্বেও ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীর কথা বলেছেন গ্রামশি। স্পষ্টতই এখানে ‘সাবলটার্ন-এর অর্থ শিল্পশ্রমিক শ্রেণী নয়। বরং যে-কোনও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাবিন্যাসের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা উঠছে এখানে। এই বিন্যাসকে গ্রামশি দেখেছেন একটি সামাজিক সম্পর্কের প্রক্রিয়ার মধ্যে, যার এক মেরুতে অবস্থিত প্রভুত্বের অধিকারী ‘ডমিন্যান্ট’ শ্রেণী, অপর মেরুতে যারা অধীন সেই ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণী। বহুক্ষেত্রেই অবশ্য গ্রামশি বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে কর্তত্ব, প্রভুত্ব, শাসন এই শব্দগুলিকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে কর্তৃত্বের অধিকার, প্রভুত্বের অধিকার, শাসনের অধিকার, এই ধারণাগুলির মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে কি না, গ্রামশির আলোচনা থেকে তা বোঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
রণজিৎ গুহ:
রণজি গুহ অধীনতাকে বোঝার জন্য গ্রামশির মতোই বিপরীত যুগ্মপদ (আধিপত্য-অধীনতা) গ্রহণ করেছেন। কারণ নিম্নবর্গ সব সময় শাসকগোষ্ঠীর অধীন থাকে এমনকি বিদ্রোহ ও জেগে ওঠার মুহূর্তেও তারা শাসকবর্গের কর্মকাণ্ডের অধীন। তাঁর ব্যবহৃত dominance 3 subordination শব্দ দুটির অর্থ যথাক্রমে আধিপত্য ও অধীনতা। আধিপত্য মূলত এলিট বা উচ্চবর্গের প্রভুত্ব, প্রতাপ বা শাসনকে বোঝায় আর অধীনতা নিম্নবর্গের শাসিত হবার রূপটি উন্মোচিত করে। গ্রামশি প্রিজন নোটবুকসে একাধিক বার dominant classes, dominant groups, hegemony শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। এরই বিপরীতে রয়েছে সাবলটার্ন গোষ্ঠী। প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, শাসন বা প্রতাপের বিপরীতে অধীন, দলিত, শোষিত, নিপীড়িত এই দ্বিমাত্রিক অনুষঙ্গ বিজড়িত। ‘নিম্নবর্গ’ শব্দটা কার্যত বাইনারি বৈপরীত্যের আদলে গড়া। কেননা, আমাদের মননবিশ্বে বা ব্যক্তিক চেতনার সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হয়ে বসে ‘উচ্চবর্গ’ চেতনাটা। সুতরাং ওই অবস্থানটা অবশ্যগ্রাহ্য মেনে নিয়েই ‘নিম্নবর্গ’ ক্লাস।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়:
পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিম্নবর্গতত্ত্বের ইতিহাসের উত্তরাধিকার সম্পকে আলোচনা করেন। যে সময় উগ্রহিন্দুর আক্রমণে সেকুলার মতাবলম্বীরা কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ভারতবর্ষ যে নানা ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর মিলনভূমি, ভারতের জাতীয়তা যে ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের স্বার্থ যে আসলে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী-এসব কথা এখনও বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব এসে পড়েছে। ওদিকে উগ্রহিন্দুরা চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, গণতান্ত্রিক ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও হিন্দুর স্বার্থ কেন স্বীকৃত হবে না, অথচ সংখ্যালঘুর স্বার্থ কেন মর্যাদা পাবে? রাষ্ট্রের আইনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দেওয়াটাই তো সাম্প্রদায়িকতা, তা তুলে দেওয়ার দাবিই যথার্থ সেকুলার রাষ্ট্রের দাবি। উগ্রহিন্দুরা আরও বলছেন, বিদেশি আক্রমণের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে প্রকৃত জাতীয়তার হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করতে হবে; এক্ষেত্রে ইংরেজ যে-অর্থে বিদেশি, পাঠান বা মুঘল শাসকেরাও সেই অর্থেই বিদেশী। উগ্রহিন্দুদের অভিযোগ, এই দাবির বিরোধিতা করে সেকুলাররা প্রকৃত জাতীয়তারই বিরোধিতা করছেন।
ডেভিড হার্ডিম্যান:
ডেভিড হার্ডিম্যান নিম্নবর্গতত্ত্বের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে দেবীর আর্বিভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। উনিশশো বাইশের নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে, দক্ষিণ গুজরাটে কাতারে কাতারে আদিবাসী বা উপজাতীয় কৃষকরা সলাহবাই নামে এক দেবীর উপদেশ শোনার জন্য জমায়েত হতে শুরু করে। এই ‘দেবী’ বা ‘মাতা’ -র কোনও মূর্তি নেই, ভক্তদের ধারণা তিনি পুবের পাহাড় থেকে আসেন আর লোকের ওপর ‘ভর’ করে তাঁর আদেশ জানান। এইরকম এক একটি জমায়েতে বেশ কতকগুলি গ্রামের আদিবাসীরা এসে জড়ো হত এবং সেখানে তাদের অনেকেরই ভর হত। ভরগ্রস্তরা প্রচণ্ড মাথা ঝাঁকাত আর সেই অবস্থায় যেসব কথা বলত, লোকের ধারণা ছিল সেসব হচ্ছে দেবীর প্রত্যক্ষ আদেশ। প্রধান আদেশগুলি ছিল, মাংস ও মদ বর্জন, প্রতিদিন স্নান, শৌচের জন্য পাতার পরিবর্তে জল ব্যবহার, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন রাখা, খাওয়া বা বলিদানের জন্য পালিত ছাগল, মুরগি ইত্যাদি ছেড়ে বা বিক্রি করে দেওয়া, পারসি শুঁড়ি আর জোতদারদের বয়কট করা। সাধারণের বিশ্বাস ছিল, দেবীর এই সব আদেশ যে মানবে না, তার ওপর নানান বিপদ নেমে আসবে, সে পাগল হয়ে যেতে পারে এমনকী তার মৃত্যুও ঘটতে পারে। সাধারণত একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন এই রকম জমায়েত চলার পর দেবী সরে যেতেন আর এক গ্রামে এবং সেখানে একই ঘটনার পুনরাভিনয় হত ।
মার্ক্সীয় যে পলিটিক্যাল ইকোনোমি বা মার্ক্সীয় সোসিওলোজি তারই এক ধরনের অধিকতর ধাপ হচ্ছে নিম্নবর্গতত্ত্ব। বস্তুত ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর লেখকরা নিম্নবর্গের নিজস্ব ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। ইতিহাস অবশ্য ব্যক্তিগত কারো নয়। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ইতিহাসও হয় না, এ জন্য নিম্নবর্গের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, পরিবর্তনশীল। তবে এই ইতিহাস ‘অবদ্ধ ও সচল’। নিম্নবর্গের সংগ্রামের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার জন্য এখনো এ ইতিহাসচর্চা চলছে। প্রকৃত ইতিহাস উচ্চ/নিম্নবর্গের মিলিত জীবন ও সংগ্রাম; একে অপরের সম্পর্কে নির্মিত হয়। এ কারণে রণজিৎ গুহ উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের রাজনীতির বেণিবন্ধনের কথা বলেছেন। ঔপনিবেশিক যুগের রাজনীতির ক্ষেত্রটি দ্বিধাবিভক্ত। কিংবা অন্য উপমায় বলা যায় যে, উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের চৈতন্য ও কর্মের বাহন দুটি স্বতন্ত্র ধারা বয়ে চলেছে ওই রাজনীতির মধ্যে। তবে সেই সঙ্গে এ কথাও বেশ জোর দিয়েই বলা দরকার যে স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও ওই ধারা দুটি পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। নিরপেক্ষ নয় তাদের বৈপরীত্যের জন্যেই। বিপরীত বলেই যেকোনো দ্ব্যণুক সম্বন্ধের রাশি দুটির মতো তাদের একটি অপরটির অস্তিত্ব সূচনা করে, ঘোষণা করে। উচ্চবর্গের উদ্যোগ থেকে নিম্নবর্গের উদ্যোগ স্বতন্ত্র, মতাদর্শের বাইরে তার কর্মকাণ্ড। অথচ এই উভয় বর্গ একত্রিত সমাবেশে মিলতে চেয়েছে। উচ্চবর্গের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের উপলক্ষে বিরাট সমাবেশে হাতিয়ার হিসেবে নিম্নবর্গ কাজ করেছে। কিন্তু নেতাদের আপসের মনোবৃত্তি, প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা, জঙ্গি গণ- আন্দোলন ভীতি এবং সর্বোপরি নিম্নবর্গের চৈতন্যের নানা সীমাবদ্ধতা এই সম্মিলিত আন্দোলনকে স্থায়ী হতে দেয়নি। আন্দোলনে স্থবিরতা আসলে বেণিবন্ধ শিথিল হয়ে পড়েছে। ফলে আবার রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা অব্যাহত থেকেছে। এ জন্যই উচ্চবর্গ ইতিহাসকাঠামো থেকে বের হয়ে আসার প্রস্তাব দেয় ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’। উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের মধ্যেকার বৈপরীত্য ও সম্পৃক্তি যথাযথভাবে বর্ণনা করতে হবে এবং একারণেই ইতিহাসে নিম্নবর্গের ভূমিকাকে যথার্থ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে বলেন এ গোষ্ঠীর লেখকরা। আর এখানেই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য বিশ্ব জ্ঞানকাণ্ডের একটি বিশিষ্ট সংযোজনাও।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
নিম্নবর্গতত্ত্ব কী বা নিম্নবর্গতত্ত্ব কাকে বলে?
নিম্নবর্গতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
নিম্নবর্গতত্ত্বের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন