নিম্নবর্গতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য :
১. বিকেন্দ্রায়ণের মধ্য দিয়ে প্রতিসন্দর্ভের কার্যকরী আদল গড়ে তোলাই নিম্নবর্গীয় চেতনার লক্ষ।
২. নিম্নবর্গীয় রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্য এলিট কর্তৃত্বের প্রতিরোধ তার নিম্নবর্গের নিজের নিয়মেই এই চেতনা সুসংগঠিত হতে পারেনি। নিম্নবর্গের মানুষেরা এলিটদের কাছে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত প্রবঞ্চিত লুণ্ঠিত হয়েছে, তাদের রাজনীতিতেও তাই বঞ্চনা ও লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা একটা বড়ো উপাদান। বঞ্চনার অভিজ্ঞতা থেকে নিম্নবর্গের রাজনীতির ইতিহাসে তৈরি হয়েছে বহুধরনের স্বতন্ত্র বাক্-রীতি ও বাগবিধি, বিভিন্ন শব্দ, পরিভাষা, নিম্নবর্গ একটা আলাদা রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়।
৩. মার্কসবাদের বহুমাত্রিক পাঠ দেখা যায়। সে অর্থে সাবলটার্ন স্টাডিসও মার্ক্সবাদী। বর্তমানে মার্কসবাদকে ব্যাখ্যার বহুত্বের এক উন্মুক্ত পরিসর ভাবা হয়, এরকম চিন্তা নব্য মার্কসবাদীরাও মূল অঙ্গীকারে বিশ্বাসী, সে কারণে সব রকম অসাম্য ও বিষময়তার বিপক্ষে, হোক তা প্রাণীর কিংবা জাতির। এই অঙ্গীকারের কারণেই নব্যমার্কসবাদ বুর্জোয়া-লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন। সাবলটার্ন স্টাডিস বা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা মুক্ত মার্কসবাদের কথা বলে।
৪. ধর্মভাব নিম্নবর্গের চৈতন্যের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। ধর্মভাব বলতে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্থার প্রতি আনুগত্য বোঝায় না। যা পার্থিব বা ঐহিকতাকে অলৌকিক বলে ভাবা, যা একেবারেই মানবিক তাকে দৈব বলে মনে করা, এটি এই ধর্মভাবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে ধর্মভাবও একটি সচেতনতা গড়ে তুলতে পারে। ধনতন্ত্রের পূর্ণবিকাশের আগে ও পরে দীর্ঘদিন মফস্বল ও গ্রামের সাধারণ মানুষের চোখে রাষ্ট্রশক্তি ছিল অনেক দূরের জিনিস। রাষ্ট্রশক্তিকে তারা দৈবশক্তির আধার মনে করে ও এর থেকেই তৈরি হয় এক অলীক রাষ্ট্রের ধারণা।
৫. Subaltern mentality’ অর্থাৎ সাবলটার্নদের যাপিত জীবনচর্চায় দুটি দিক আছে। একদিক তার কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে, আর একদিকে করে প্রতিবাদ, বিরোধিতা। নিম্নবর্গ যখন আধিপত্য ও কর্তৃত্বের দ্বারা নিদারুণ পীড়িত হয়, তখন যে উদাহরণ (Paradigm) তারা তৈরি করে, তার ইতিহাস আর এলিটশ্রেণীর আয়ত্তে থাকে না, তখন ‘The subaltern as subjects of their own histories. ‘
৬. নানাবিধ ট্যাবু এবং শাস্ত্রানুশাসন সাবলটার্ন সংস্কৃতির একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য। প্রাক্- ঔপনিবেশিককাল থেকে সাবলটার্ন চেতনায় নানা সংস্কার ও ধারণা এমনভাবে বদ্ধমূল থেকে আসছে যে, ভাগ্য, (destiny), মান্যতা (Subordination) ইত্যাদি বিষয় তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
৭. সমাজকাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস ও পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়াগুলিকে তাদের মৌলিক উপাদান দেখাই উচ্চবর্গ। নিম্নবর্গের বিশ্লেষণের লক্ষ্য।
৮. উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের বিশ্লেষণ পদ্ধতি উৎপাদন-রীতির ধারণাটিকে বাদ দিয়ে বলতে পারে না। ৯. উচ্চবর্গের চেতনার বিপরীত অবস্থানে নিম্নবর্গের চেতনাও কোনও না কোনও ভাবে তার স্বকীয়তা, তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়।
১০. প্রভুত্ব ও অধীনতা যেমন দ্ব্যণুক বৈপরীত্যের সূত্রে বাধা, অধীনতাও তেমনি একটি দ্ব্যণুক সত্তা যা নিজেই আবার দুটি রাশির বৈপরীত্য দিয়ে গড়া। সেই রাশি দুটি হচ্ছে সহকারিতা ও প্রতিরোধ। নিম্নবর্গের ইতিহাসে দুটি রাশিই সক্রিয়ভাবে উপস্থিত, যদিও অবস্থাভেদে একটি অপরটির চেয়ে জোরদার হয়ে ওঠে এবং অধীনদের চৈতন্যে হয় একটি বা অন্যটি তার প্রাধান্য কায়েম করে সাময়িকভাবে। তাই একথা মনে করা ভুল হবে যে প্রতিরোধই নিম্নবর্গের চৈতন্যের একমাত্র উপাদান।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
নিম্নবর্গতত্ত্ব কী বা নিম্নবর্গতত্ত্ব কাকে বলে?
নিম্নবর্গতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
নিম্নবর্গতত্ত্বের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন