সুরিয়ালিজমের ধারণা জটিল ও বৈশষ্ট্যময় এবং এটিকে নির্দিষ্ট ছকে ফেলা কঠিন। শিল্পীরা একই ছাতার নিচ থেকে ছবি আঁকলেও তাদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই এই মতবাদটি সম্পর্কে একেকজন একেকভাবে চিন্তা করেছেন। সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সরিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক বিষয় এবং এটি কেবল তাই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেনন-এর ভাষায়, ” সুরিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছিল। কেননা আমি উপলব্ধি করেছিলাম কল্পনা আমার উন্মাদনা নয়। বরং, সুরিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।” আন্দ্রে ব্রেতো বলেন, ” ভাব, যথাযথ পদ্ধতি অনুধাবনের জন্য সুরিয়ালিজম আবশ্যক।” এ ধারায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশ্রণ হয় বলে সুরিয়ালিজমকে স্বপ্ন ও বাস্তবতাও বলা হয়ে থাকে। (সুরিয়ালিজমের জগৎ: মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
সুরিয়ালিজমের ঢেউ খুব অল্প সময়েই শিল্পের সবগুলো শাখায় আঁচড়ে পরে। কবিতা, গান, নাটক, সিনেমা সব শিল্পে সুরিয়ালিজমের চেতনা আছন্ন করে রেখে। ১৯২৪ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত সুরিয়ালিজমের প্রভাবে অন্তত ৬টি সিনেমা নির্মিত হয়। এ ধারার প্রধান শিল্পীরা হলেন- জ্যাঁ আপ, মার্ক্স আর্নেস্ট, আন্দ্রে মেসন, সালভাদর দালি, রেনে ম্যাগরেট, পিয়েরো রয়, জোয়ান মিরো, পল ডেলভাক্স, ফ্রিদা কাহলো প্রমুখ।
এই ধারার চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৩১ সালে সালভাদর দালির আঁকা ‘দি পারসিসটেন্স অব মেমরি’ সবচেয়ে আলোচিত চিত্রকর্ম। এটি কেবল এ ধারার আলোচিত চিত্রকর্মই নয়, বরং দালি’রও অন্যতম চিত্রকর্মের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই চিত্রকর্মটি দালি সময়ের বিচিত্র অবস্থাকে ফ্রেমবন্দী করতে চেষ্টা করেছেন। ‘মেটামরফসিস অব নার্সিসাস’, ‘নভিলিটি অব টাইম’, ‘প্রোফাইল অব টাইম’ প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সুরিয়ালিজম ধারার প্রধানতম চিত্রকর্মের মধ্যে রেনে ম্যাগরেটের ‘দ্য সন অব ম্যান’, ‘দিস ইস নট অ্যা পাইপ’, ডার্জিও দি চিরিকো-এর ‘দ্যা রেড টাওয়ার’, ম্যাক্স আর্নেস্টের ‘দি এলিফ্যান্ট সিলিবেস’ ইভ তগির ‘রিপ্লাই টু রেড’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। (সুরিয়ালিজমের জগৎ: মুহাম্মদ ফরিদ হাসান)
সুরিয়ালিজম বাংলা সাহিত্যেও বিদ্যমান; আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনান্দ দাশ, শামসুর রহমান প্রভৃতি লেখকগণ সুরিয়ালিজম তথা সুরিয়ালিজমকে বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন। সুরিয়ালিজমের প্রভাব নজরুলের লেখায়ও দেখা যায়।
আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই। ওই পাহাড়ের ঝর্ণা আমি ঘরে নাহি রই গো উধাও হ’য়ে বই।। …”
অথবা,
“মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির, চৈতী চাঁদের দুল”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও এমন সৃষ্টি রেখেছেন। ‘সোনার তরী’ কবিতায় সুরিয়ালিজমের ছোঁয়া আছে।
(কবিতার কথা, সুরিয়ালিজম তথা পরাবাস্তবতা: যাদব চৌধুরী)
জীবনানন্দ পরবাস্তববাদী ধারার আন্যতম একজন কবি। ‘নগ্ন নির্জন হাতকবিতায় সুরিয়ালিজমের প্রকাশ দেখতে পাই।
“আবার আকাশে অন্ধকারে ঘন হয়ে উঠেছে।
আলোর রহস্যময়ী সহোদরের মতো এই অন্ধকার।”
এখানে যদি’ আবার ‘শব্দটির দিকে তাকাই তবে বুঝা যায় কবির আকাশ আগেও অন্ধকার ছিল। আবার বলেছেন-
“যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।”
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সুরিয়ালিজম আন্দোলন থমকে যায়। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনটির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলনের মতো সুরিয়ালিজমের চর্চা বর্তমানেও হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনেও সুরিয়ালিজমের প্রভাব রয়েছে।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
সুরিয়ালিজম কাকে বলে? সুরিয়ালিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
সুরিয়ালিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন