ইংরেজী সাহিত্যে ন্যাচারালিজমের প্রধান প্রধান সাহিত্যিক
১.এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২): এমিল জোলাকে ন্যাচারালিজমের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর প্রধান কাজ Genminal (১৮৮৫), Therse Raquin, The Experimental Novel (১৮৮০)। তাঁর Genminal (১৮৮৫) উপন্যাস কয়লাখনির অত্যন্তরে খনি শ্রমিকদের কীরুপ কর্মধারা কীভাবে কয়লা কাটায়, কীভাবে খনির রন্দ্রপথে জলের অনুপ্রবেশ ঘটে, ধ্বস নামে, যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি রক্তাক্ত খনি শ্রমিকের কর্মঘটের পুর্ণাঙ্গ চিত্রায়ন ঘটেছে। শ্রেণিসমাজে স্বাভাবিক তা প্রতিফলিত হয়েছে। সেকালের পটভূমিকায় পরিস্ফুট হয়েছে একটি রাজনৈতিক প্রগতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা শোষনে পিষ্ট খনি শ্রমিকদের বঞ্চনা ও আর্তনাদের অবিকল প্রতিচ্ছবি একেঁছেন। অগ্নিগর্ভ প্রতিবাদী খনি শ্রমিকদের প্রতিবাদী মিছিলের রুদ্ধশ্বাস বিবরণ দিয়েছেন। পাশাপাশি মালিক শ্রেণির অভ্যন্তরে একটা মানুষকে খুঁজেছেন। এক্ষেত্রে পরিবেশবাদ বা যথাযথবাদ অর্থাৎ আলোচ্য ন্যাচারালিজমের বৈশিষ্ট্যে অন্বিত উপন্যাসে বাস্তববাদের ডাইমেনশন বেড়েছে, তাও অগ্রাহ্য করা যায় না।
২. গি দ্য মোপাসাঁ (১৮৫০-১৯৩) : এমিল জোলা যেমন ন্যাচারালিজম সাহিত্যের জনক কা অগ্রনায়ক তেমনি ন্যাচারালিজমের ভ্যানগার্ড বলা যায় মোপাসাঁকে। তাঁর কাজ ure vie (১৮৮৩), Bel – Ami (১৮৮৫), Pierr Jeam (১৮৮০) For Comme la mort (১৮৮৯) এই রচনাগুলোতে ন্যাচারালিজমের অজর উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। স্বোপার্জিত ব্যাধি ও Melancholia’ য় অভিশপ্ত, ব্যাক্তিজীবন, ফলে নারী সম্পর্কে, সমাজের নানা স্তরের মানুষ সম্পর্কে, জীবনের সর্ববিষয়ে রুঢ় সত্য উন্মেচনই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর ইবষ-অসর তে যেমন ফ্রান্সের “অভিজাত সম্প্রদায়ের নৈতিক অধ:পাত” পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করেছে, তেমনি তার যন্ত্রনা দগ্ধ হৃদয়ের রক্তাক্ত প্রতিবিম্বন ঘটেছে, ‘চর্বির গোলা (Boul de suit) গল্পে। তাঁর অসংখ্য গল্পের মধ্যে একটি আনুবীক্ষনিক প্রক্রিয়ায় চরিত্রের উন্মোচনে বা রুপায়নে মোপাসাঁ ন্যাচারালিজমের ভূমিকায় নির্ধারিত হয়েছে। তাঁর গল্পে অবলীলায় ; তাঁর গল্পে অবলীলায় গণিকা পল্লী, গণিকা জীবন নীচুতলার সমাজ স্থান পেয়েছে। কিন্তু ফ্লাবেয়ার বা জোলার মধ্যে রোমান্টিক মানসতা প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন রূপে যদি ও বা পাওয়া যায়, মোপাসাঁর মধ্যে তা একান্ত দুর্লভ। ‘অবক্ষয়িত নাগরিকতা’ ও ‘মনোব্যাধির আচ্ছান্নতা’ হয়তো মোপাসাঁর গল্পকে ন্যাচারালিজমের অন্ত:সারে নিষিক্ত করে নেয়, তথাপি ছোটগল্পে তাঁর শিল্পচরিতার্থতা তলস্তয়ের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা সঞ্চারিত করেছে।
৩. স্টিফেন ক্রেস (১৮৭১-১৯০০): স্টিফেন ক্রেন একজন ন্যাচারালিজমের প্রবক্ত। তাঁর প্রধান কাজ ‘ম্যাগি’ ‘রাস্তার একটি মেয়ে’, ‘সাহসের লাল ব্যাজ’ (১৮৯৫), ‘সাহসের লাল ব্যাজ’ ক্রেনকে আন্তজাতিকভাবে বিখ্যাত করে। আমেরিকান আলোতে ক্রেনের প্রধান অবদান হলো তাঁর প্রকৃতি পরিক্ষা ‘দ্য রেড ব্যাজ অব কারেজ’ উপন্যাসে হেনরি ফ্লেমিংয়ের গল্প, একজন যুবক যিনি গৃহযুদ্ধে লড়াই তালিকাভূক্ত। এই আখ্যানে ক্রেন ন্যাচারালিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণ করেন।
৪. জ্যাক লন্ডন (১৮৭৬-১৯৭৬) : তাঁর কাজ গুলো, ‘ওকল্যান্ড’, ‘ক্যালিফোর্নিয়া’, ‘পরের বছর’। ন্যাচারালিজমের দৃষ্টান্ত।
৫. ফ্র্যাঙ্ক নরিস/ বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন নরিস (১৮৭০-১৯০২) : আমেরিকার ন্যাচারালিজমের বিকাশকারী প্রধান লেখকদের একজন, জোলার মতে ফ্র্যাঙ্ক নরিসের কাজ বিশুদ্ধ ন্যাচারালিজমের কাছাকাছি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলি হল- ‘Mc teaque A story of san francisco’, ‘The octopus; A story of California’ and ‘The pit; A story of chicago’.
৬. থিওডোর ড্রেইজার (১৮৭১-১৯৪৫) : তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা ‘sister carrie’, ‘American tragedy’. ন্যাচারালিজমের যে কোনো আলোচনায় ‘An American tragedy’ এবং ‘sister carrie কে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাসাহিত্যে ন্যাচারালিজম:
সমাজবিকাশের ধারায় পুরোনো ও নতুন সমাজ ব্যবস্থার দ্বন্দো, ব্যবস্থার অন্তর্গত শ্রেণিদ্বন্দে যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটে, মূল্যবোধের রুপান্তরে অতীন্দ্রিয়তায় ঋদ্ধ রোমান্টিক রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরোধিতায় বাংলা গল্প উপন্যাসে দখল নিল বাস্তবতা, অনিবার্য সূত্রে ন্যাচারালিজম, যান্ত্রিক-ন্যাচারালিজম ও বিষন্ন বাস্তবতা ন্যাচারালিজম বালজাক, ফ্লাবেয়ার, জোলা, মোপাসাঁ সাদরে গৃহিত হয় বাংলা সাহিত্যে। যুদ্ধোত্তর কালের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সমস্যা, আশাহীনতা, জীবন-সম্পর্কে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বিদ্রোহ দ্রুত গ্রাস করতে থাকে। ন্যাচারালিজম সাহিত্য রচয়িতাদের সৃষ্টিসমূহ:
১. অচিন্তাকুমার : ‘বেদ’, ‘বিবাহের চেয়ে বড়’, ‘প্রাচীর ও প্রানতর ;
২. জগদীশ গুপ্ত : রতি ও বিরতি অসাধু সিদ্ধার্থ
৩. বুদ্ধদেব বসু : এরা ওরা আরও অনেকে’, ‘রাত ভোরের বৃষ্টি’।
৪. তারাশঙ্কর : ‘হাসুলী বাঁকের উপকথা’ ।
৫. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।
৬. বিভূতিভূষনের বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘অশনি সংকেত’ ; পঞ্চাশের মন্বন্তবের পটে লেখা দুর্ভিক্ষকাতর জীবনের নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন।
৭. প্রেমেন্দ্রমিত্র : ‘বিকৃত ক্ষুবার ফাঁদে’; অপগত যৌবনা পতিতা জীবনের দুঃসহ এক বাস্তব চিত্র বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া সংসার সীমানতে’ তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা।
৮. নারায়ন গজ্ঞোপাধ্যায় : ‘টোপ’, ‘হাড়’, পয়সাওয়ালা মানুষের খেয়াল, বিলাস ও কামনাভোগের কাছে বিত্তহীন, ক্ষুৎপীড়িত মানুষের নিরর্থক হাহাকারের নির্মম আলেখ্য।
৯. শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় : তাঁর ‘কয়লাকুঠির’র গুল্পগুলি খনিজ শ্রমিক জীবনের প্রেম, বঞ্চনা, মালিকের ইন্দ্রিয় লালসা ও আত্মিক যন্ত্রনাহীনতার চমৎকার দলিল।
১০. সমরেশ বসু : ‘প্রজাপতি’, ‘বিবর’ উপরোল্লোখিত রচনাগুলি বাংলা সাহিত্যে ন্যাচারালিজমের অন্যতম দৃষ্টান্ত।
সাধারণত একটি রচনায় মধ্যে, উগ্র বস্তুপ্রিয়তা, সরল বর্ণণাপদ্ধতি, নৈরাশ্য, মানুষের মনুষ্যত্বের অন্তরালস্ত জান্তব ধর্মের উন্মেচন খুঁজে পাওয়া যায় না এবং গেলে ও সে রচনার পাঠ্যগুণ থাকে না। তাছাড়া লেখকেরা যদি প্রতিমূহূর্তে পাঠকদের সচেতন করে দেন যে, মানুষের প্রতিটি ভোগ ও কর্ম পূর্বনির্দিষ্ট, ইচ্ছার স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, তাইলে ইবসেনের অসওয়ালেডর মতো অসহায় নিরপেক্ষভাবে পূর্বপুরুষের কৃতকার্যের যন্ত্রা ভোগ করতে হয় মাত্র। অসওয়ালেডর পরিণতি অঙ্কনে ইবসেন বংশগতি কে প্রধান্য দিয়েছেন ন্যাচারালিস্ট পদ্ধতিতে। এর ফলে ন্যাচারালিজমের লেখকেরা বাস্তব জীবন সমস্যার রূপ দিতে গিয়ে পাত্রপাত্রীর নৈরাশ্য ও আত্মিক যন্ত্রণাকেই পাঠকের একমাত্র প্রাপ্তি করে তুলেছেন। ন্যাচারালিস্টরা বিজ্ঞানের নিরপেক্ষতা দাবী করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে গবেষককে নির্ধারিত লক্ষ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব সত্য বলে ধরে নিতে হয়, অপ্রাসঙ্গিক তথ্য বর্জনও করতে হয়। অতএব বিজ্ঞানীকেও নির্বাচন করে নিতে হয় তবে গবেষণায় ও অগ্রসর হতে হয়। অন্যদিকে, একজন শিল্পীকেও প্রথমে ‘নির্বাচন’ অতঃপর ‘রূপায়ণ’ করার মাধ্যমে শিল্পরচনা করতে হয়। সুতরাং নিরপেক্ষ সত্য নিয়ে বিজ্ঞান হয় না সাহিত্য ও হয় না। তাই ন্যাচারালিস্টরা যে নিরপেক্ষতার মহিমা দাবী করেন তা যথাযথ নয়।
ন্যাচারালিস্টদের মধ্যে অনেকেই বিশুদ্ধ ন্যাচারালিস্ট ছিলেন না। তাঁরা ধীরে ধীরে ন্যাচারালিজমের কূল বৈশিষ্ট্য থেকে দূরে সরে গেছেন। যেমন তেইন ও পল বুরগেট ঝুঁকেছিলেন ধর্মের দিকে, ইবসেন-হাপ্টম্যান প্রতীকতা ও মিষ্টিসিজনের দিকে এবং স্ট্রিন্ডবার্গ নয়ারোমান্টিকতার পোষক হয়ে পড়লেন।
ন্যাচারালিজমে ন্যাচারালিস্টরা যেহেতু কোনো কিছুর হুবহু অনুকরণ করে, তাই অনেকেই একে ‘ফটোগ্রাফি’ বলে সমালোচনা করেছেন।
ন্যাচারালিজম আন্দোলন অন্যান্য আন্দোলনের মতো স্থায়ীপ্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও শ্রমজীবীর জীবন রূপায়নে ছলনাভরা নীতিজ্ঞানের সমালোচনায় জীবন ও শিল্পের মধ্যবর্তী অবকাশ দূরীকরণে যে সাফল্য ন্যাচরালিস্টরা লাভ করেছিলেন, সাহিত্যের জগতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সেই কারণেই।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
ন্যাচারালিজম কী বা ন্যাচারালিজম কাকে বলে?
ন্যাচারালিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
ন্যাচারালিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
ন্যাচারালিজমের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের পরিচয়